দলে মূল্যায়ন না পেয়ে বিএনপির ১২ নেতার পদত্যাগ!
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ওয়ার্ড কমিটি গঠনে পদ বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ এনে পদত্যাগ করেছেন অন্তত এক ডজন নেতা।
সাম্প্রতি ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ১০ ওয়ার্ডে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ্ আমান ও সদস্য সচিব আমিনুল হক এ কমিটির অনুমোদন দেন। এই কমিটি ঘোষণা করার পর থেকেই উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে মোহাম্মদপুর থানার ৩৩ নং ওয়ার্ডের অন্তত এক ডজন নেতা পদত্যাগ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজ নিজ আইডি থেকে পদত্যাগের বিষযয়ে পোস্ট করেছেন পদত্যাগকারীরা।
অনুমোদনকৃত কমিটি গুলো হলো-রূপনগর থানার ৬নং আঞ্চলিক ওয়ার্ড, শাহআলী থানার ৮ ও ৯৩ নং ওয়ার্ড, কাফরুল থানার ৪নং ওয়ার্ড, আদাবর থানার ৩০ ও ১০০ নং ওয়ার্ড, মোহাম্মদপুর থানার ৩১, ৩২, ও ৩৩ নং ওয়ার্ড এবং বনানী থানার ১৯ নং ওয়ার্ড।
পদত্যাগকারী নেতারা জানান, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ওয়ার্ড কমিটি ঘিরে এলাকা প্রীতি এবং পদ বাণিজ্য হয়েছে। যাদের বাড়ি ভোলা তাদের চাল চুলা কিছু না থাকলেও তারা কাউন্সিলে পাস করেছেন। আবার যারা অর্থ দিচ্ছে তারাও কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। পদত্যাগ থামানোর জন্য আমিনুল হক হুমকি ধামকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন পদত্যাগী নেতারা।
পদত্যাগকারী নেতারা
৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির নবগঠিত কমিটির যারা পদত্যাগ করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে শামসুর রহমান শাহীন-২নং সহ সভাপতি, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপি; মো. জাহাঙ্গীর সহ সভাপতি, সাবেক সহ-হকার্স কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদপুর থানা বিএনপি; মো. কফিল উদ্দিন কফিল-কোষাধ্যক্ষ, সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপি; মো. সালাউদ্দিন মৃধা-স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক যুগ্ম আহবায়ক; মো. কামাল সহ কোষাধ্যক্ষ, সাবেক সহ-প্রচার বিষয়ক সম্পাদক; মো. সোহাগ- সহ দপ্তর বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সদস্য আহ্বায়ক কমিটি; মো. লোকমান- সহ স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সদস্য ৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপি; মো. ইউসুফ-সদস্য ও সাবেক সদস্য ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপি, সাবেক সভাপতি ইউনিট বিএনপি; মো. মনির হোসেন পালোয়ান সদস্য ও সাবেক সদস্য ৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপি আহ্বায়ক কমিটি।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ১০০ নং ওয়ার্ড বিএনপির অন্তত আরও দুই ডজন নেতা পদত্যাগ করবেন বলেও জানা গেছে।
জানতে চাইলে পদত্যাগকারী মোহাম্মদ কফিল উদ্দিন কফিল ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রাজপথের ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাদেরকে বাদ দিয়ে নতুন লোক দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্যান্য ইউনিট থেকে লোক এনে এখানে পদায়ন করা হয়েছে। পূর্বের কমিটিতে যে পদে ছিলাম সেখান থেকে ডিমোশন কীভাবে দিচ্ছেন, আপনি কমিটি রাখতে না পারলে থেকে বাদ দিয়ে দিবেন, কিন্তু আপনি তো অবমূল্যায়ন করতে পারেন না। যাদের টাকা-পয়সা রয়েছে তারা ভালো পদ পেয়েছেন, আমার টাকা থাকলে হয়তো আমিও ভালো পদে যেতে পারতাম। যাদের কখনো আন্দোলন, সংগ্রাম ও রাজপথে দেখেনি তাদেরকে এনে কমিটিতে বসানো হয়েছে। ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করার কারণে আমিসহ অনেকেই গণপদত্যাগ করেছি।
তিনি বলেন, আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ইতিমধ্যে পদত্যাগের স্ট্যাটাস ক্রিনশট পাঠিয়েছি। অপেক্ষা করছি তারা কোনো পদক্ষেপ নেন কি না; যদি তারা আশ্বাস কিংবা কার্যকর পদক্ষেপ নেন তাহলে হয়তো বিবেচনা করব। অন্যথায় লিখিত আকারে পদত্যাগ পত্র খুব শিগগিরই জমা দেব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অর্থ লেনদেনের বিনিময়ে অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার’ বাদলের সহযোগী মোল্লা কাউসারকে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। বিভিন্ন ইউনিট থেকে অন্তত ১৫ জনকে এনে ওয়ার্ডের সদস্য করা হয়েছে। যদিও ইউনিটের কারও ওয়ার্ডে আসার সুযোগ নাই। ৩২ নং ওয়ার্ডের যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক মো. বিল্লাল হোসেনকে একই ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর থানা কৃষকদলের সহ-সভাপতি ফজলুর রহমান ভিক্ষুককে ৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির সাবেক সহ-হকার্স কল্যান সম্পাদককে ৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি বানানো হয়েছে। অথচ নিয়ম করা হয়েছে থানা কমিটির কেউ ওয়ার্ড কমিটিতে আসতে পারবে না।
৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক পদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া শাওন আহমেদকে স্বপনকে পূর্ণাঙ্গ কমিটির কোথাও রাখা হয়নি। সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বীকারী হাজী মো. মোস্তফাকেও কোনো পদে রাখা হয়নি। ৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির সদ্য সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক কাফিল উদ্দীন কাফিলকে অবমূল্যায়ন করে নতুন কমিটিতে ক্যাশিয়ার বানানো হয়েছে। ৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির সদ্য সাবেক ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক কারা নির্যাতিত রজ্জব আলী সুমনকে অবমূল্যায়ন করে নতুন কমিটিতে সহ-সম্পাদক করা হয়েছে। সাবেক সাংগঠনিক জহির হোসেন শাকিলকেও কোনো পদে রাখা হয়নি।
এ ছাড়া, ৩০ নং ওয়ার্ড বিএনপির কমিটিতে কারা নির্যাতিত নেতা সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হাসান জীবনের অনুসারী কাউকে কোনো পদে রাখা হয়নি। এই ওয়ার্ড এর কমিটি গঠিত হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ থেকে মনোয়নপ্রাপ্ত কমিশনার আবুল কাশেমের ছোট ভাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমেরিকা ফেরত স্বাধীনের নির্দেশে। অভিযোগ আছে আহ্বায়ক কমিটিতে বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রাজনীতির মাঠে সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয় স্বাধীনকে ১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়।
৩১ নং ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. আহসান উল্লাহ শহীদের অনুসারী কাউকে কোনো পদে রাখা হয়নি। ৩৪ নং ওয়ার্ড বিএনপি সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ফয়সাল ভূইয়া সোহেল, সভাপতি পদপ্রার্থী খাইরুল বাশার মুক্তি ও মহানগর বিএনপির সদস্য হাজী ইউসুফের অনুসারীদের কমিটিতে রাখা হয়নি। ২৯ নং ওয়ার্ড এর সাবেক কাউন্সিলর পদপ্রার্থী লিটন মাহমুদ বাবু, সাবেক সাধারণ আব্দুল কাদেরের অনুসারীদের কাউকে কমিটিতে রাখা হয়নি।
হাউজিং ব্যবসায়ী ও সাবেক সভাপতি এম এস আহমাদ আলী এবং বর্তমান সভাপতি মান্নান হোসেনের নির্দেশে ৩৩ নং ওয়ার্ড কমিটি গঠিত হয়েছে। এ ছাড়া, ২৯ নং ওয়ার্ড কমিটি গঠিত হয়েছে মোহাম্মদপুর থানা বিএনপি সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. এনায়েতুল হাফিজের নির্দেশে। ওয়ার্ডের অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
৩৪ নং ওয়ার্ড বিএনপির কমিটি গঠিত ঢাকা-১৩ আসনের এমপি সাদেক খানের ভাতিজা, মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক, বর্তমানে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি, বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মাসুম খানের নির্দেশে। এই ওয়ার্ডের কমিটি গঠনের বেলায় কাউন্সিলে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীদেরও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
৩১ নং ওয়ার্ড কমিটি গঠিত হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাবন্দী পিচ্চি হেলাল ও তার অনুসারী কমিশনার রাজু হত্যাকাণ্ডর অন্যতম আসামি সদ্য জেল থেকে মুক্তি পাওয়া পাপ্পুর নির্দেশে। পাপ্পুকে বিভিন্ন সমাবেশে দেখা গিয়েছে ৮০-৯০টি মোটরসাইকেল দিয়ে প্রটোকল দিতে ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুলকে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের নেতাদের হুমকিসহ ৩৩নং ওয়ার্ডের এক সম্পাদকের গায়ে হাত তোলার অভিযোগ আছে এই পাপ্পুর বিরুদ্ধে।
২৯নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কাদের বলেন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ওয়ার্ড সম্মেলন ঘিরে এলাকা প্রীতি এবং পদ বাণিজ্য হয়েছে। যাদের বাড়ি ভোলা তাদের চাল চুলা কিছু না থাকলেও তারা কাউন্সিলে পাস করেছে। আবার যারা অর্থ দিচ্ছে তারাও কমিটিতে জায়গা পাচ্ছে।
পদত্যাগকারী শামসুর রহমান শাহীন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন না করার কারণেই আমরা পদত্যাগ করেছি। আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিব হয়তো মনে করেন আমাদেরকে মোহাম্মদপুর দরকার নেই, এ জন্য হয়তো অবমূল্যায়ন করেছে। যাদেরকে কমিটিতে রাখা হয়েছে এদের মধ্যে অধিকাংশই নতুন মুখ। শুনেছি কমিটিকে কেন্দ্র করে অর্থ লেনদেন হয়েছে।
অনেকে পয়সার বিনিময় পদ পেয়েছেন এমনও শুনেছি। আমি ১৪টি মামলার আসামি, প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে সামনের সারিতে থেকে অংশ নিচ্ছি আর কমিটিতে এটাই প্রতিদান পেলাম।
তিনি বলেন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক যদি বলতে পারেন; আমার পূর্বে যাকে পদে রাখা হয়েছে তিনি কবে কখন থেকে বিএনপির রাজনীতি করে আসছেন। কোনো আমলে কোনো ইউনিট ও ওয়ার্ডে বিএনপির রাজনীতি করেছেন সেটা যদি স্পষ্ট করে বলতে পারেন তাহলে আমার কিছু বলার নাই।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা যারা পদত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। সাক্ষাৎ করেছেন তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে; অভিমান ছিল এখন সমাধান হয়েছে। সবাই ঐক্যেবদ্ধ আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক কিছুই হয় কাজেই সেখানে পদত্যাগ করলেই তো আর পদত্যাগ কার্যকর হয়ে যায় না।
কমিটিতে প্রভাব ও অর্থ লেনদেনে জড়িত থাকা কিংবা তার উপর অসন্তোষের বিষয়ে জানতে চাইলে আমিনুল বলেন, নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা আছে; আর অভিযোগ রাজনীতির বড় একটি অংশ। আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছেন, এটা সত্য নয়। আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর কারও কাছ থেকে এক কাপ চা কিংবা কফি খেয়েছি এটা কেউ বলতে পারবেন না।
গত ২ জুলাই ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির মোহাম্মদপুর থানার ৫টি ওয়ার্ড ২৯, ৩১,৩২,৩৩ ও ৩৪ কমিটির সন্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে কমিটি গঠনে পদ বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ সময় বিক্ষুব্ধ একটা গ্রুপ প্রতিপক্ষের উপর হামলা চালিয়ে মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান এবং সদস্য সচিব আমিনুল হককে লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এমএইচ/এমএমএ/