আস্থা-অনাস্থার দোলাচলে মহাজোট
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি ধারা বহমান। একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী, আরেকটি জাতীয়বাদে বিশ্বাসী। দুই চেতনার রাজনীতির মূল লক্ষ্য থাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে দেশের উন্নয়ন করা। তবে এই দুই চেতনার দুই জোটের নিয়ন্ত্রণ সবসময় থাকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির হাতে। জোটে অন্য দল থাকলেও নির্বাচনী মাঠে তাদের ভূমিকা খুবই সামান্য। অনেক দল আছে তাদের ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার সক্ষমতাও নেই। শুধু জোটে যুক্ত থেকে নিজেদের পরিচয়টা টিকিয়ে রাখেন। বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট ও মহাজোটের রূপরেখায় ভোটের মাঠে দাপট দেখিয়েছে। আবারও জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, তাই জোট-মহাজোটের হিসাব-নিকাশ কষার সময় চলে এসেছে। আগামী বছরের শেষে বা ২০২৪ সালের প্রথম দিকেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হতে পারে। তাই কোন জোটে কে থাকবে না থাকবে তা নিয়ে এখন থেকেই শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা।
এরইমধ্যে মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এককভাবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে, ১৪ দলীয় জোটের কোনো কোনো দল জোটে থাকলেও নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। আবার কোনো কোনো দল নানা ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতানৈক্যে পৌঁছতে পারছে না বলে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। তবে নির্বাচনে ভূমিকা না রাখতে পারলেও আদর্শিক যে জোট, সেটা অব্যাহত রাখার পক্ষে অনেক দলই ঐকমত্য।
জোট-মহাজোটের এই রূপরেখায় দেখা দিয়েছে আস্থা-অনাস্থার দোলাচল। মহাজোটের বড় শরিক জাতীয় পার্টি মনে করছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকায় নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ওয়ার্কার্স পার্টি মনে করছে, নিজেদের যে একটি প্রতীক রয়েছে, সেটাই মানুষ ভুলতে বসেছে। তাই জোটে থাকলেও নিজেদের প্রতীকেই নির্বাচন করতে চান। আবার আওয়ামী লীগ মনে করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও নিজেদের আদর্শিক জোট টিকে থাকবে, পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির সঙ্গে জোট সম্প্রসারণ হতে পারে।
জোট-মহাজোটের এই খেলায় শেষ পর্যন্ত কি হয় বলা মুশকিল। তবে চাওয়ার পাওয়ার হিসাব মেলাতে গেলে অনেকেই নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে কোন দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভবনা বেশি সেই জোটের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে অনেক দল। আওয়ামী লীগ টানা তিনটি সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় জোটের শরিকদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তারা মনে করে তাদের ব্যবহার করেই ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ।
তবে ওইসব দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিশেষ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর শরিক দল থেকে কাউকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না দেওয়ায় মনোকষ্টে ভুগছেন অনেক নেতা। তবে আওয়ামী লীগ মনে করছে, জোটে যারা আছে তাদের উপর থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছায়া সরে গেলে অনেকেই টিকে থাকতে পারবে না।
জোট-মহাজোটে এখন কারা আছেন
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল আদর্শিক জোট। ২৩ দফার ভিত্তিতে এই জোট গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণফোরাম, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও ১১ দলীয় জোট মিলে এই জোট গঠিত হয়। জোট গঠনের পরপরই ১৪ দল থেকে বেরিয়ে যায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও গণফোরামসহ কয়েকটি ছোট দল। তবে জোটটি ১৪ দল নামেই এখনও সক্রিয় আছে।
বর্তমানে জোটে আছে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), জাসদ (আম্বিয়া), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, বাসদ, জাতীয় পার্টি-জেপি (মঞ্জু) ও গণআজাদী লীগ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোট হলো মহাজোট। ১৪ দলের শরিকদের পাশাপাশি এ জোটে আছে জাতীয় পার্টি ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট।
নির্বাচনী এই জোট একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর অনেকটাই যার যার মতো হয়ে গেছে। আগামী নির্বাচনের আগে সেই জোট থাকবে, না কি অন্য জোটে চলে যাবে–সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আদর্শগত যে জোট, সেটি ভাঙার সুযোগ কম। কেননা বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকায় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী দলগুলো সেই জোটে ভেড়ার সম্ভাবনা কম।
জোট বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘জোট তো বাড়তে পারেই। যেহেতু রাজনীতি করি জোটের রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি। জোট বাড়তে পারে। কিন্তু যাদের সঙ্গে জোট হবে তাদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হতে হবে, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে সেই শক্তিকে নিয়েই আমরা জোট সম্প্রসারণ করতে পারি। সেই সম্ভাবনা আছে।’
নির্বাচনী জোট ও ১৪ দলের জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘জোট আমাদের আছে, থাকবে। তবে ১৪ দলের যে আদর্শিক জোট সেখানে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখতে পারছি না। গেল কয়েকটি ইস্যুতে আমরা সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারিনি। শুধু বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক কিছু প্রোগ্রাম হয়। এ ছাড়া জাতীয় ইস্যুতে আমরা ভূমিকা রাখতে পারছি না। নির্বাচনী যে জোট সেটা থাকবে, তবে আমাদের দাবি থাকবে এবার নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করা।’
জোট প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, জোট আছে, জোট থাকবে। মহাজোট নিয়ে কোনো কথা হয়নি আমাদের মধ্যে। আগামী নির্বাচনে কারা থাকবে না থাকবে, সে বিষয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা হয়নি। একটা জোটে দশ জন থাকলে দশ রকম মত থাকতে পারে। তবে জোটে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের জোটে কোনো দূরত্ব তৈরি হয়নি।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আমরা একটা অবস্থার প্রেক্ষিতে জোটে গেছি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর আমরা আর মহাজোটের কেউ না, মহাজোট বলতে কিছু নেই। আমরা জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দল। আমাদের নিজস্ব রাজনীতি আছে, আমরা আমাদের নিজস্ব রাজনীতি করছি। জাতীয় পার্টি কোনো জোট নিয়ে ভাবছে না। আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য তিন শ আসনেই প্রার্থীতা চুড়ান্ত করার কাজ করছে জাতীয় পার্টি।’
এ বিষয়ে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘১৪ দল তো আছেই, আমরা ১৪ দলেই আছি। নির্বাচন তো এখনও দুই বছর বাকি। যখন নির্বাচনের ঘোষনা আসবে, তখন দেখা যাবে কোন দিকে কে থাকে। আমাদের কোনো দূরত্ব নেই।’
জাসদ সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘১৪ দলীয় জোট আছে কি না আদৌ সেটা ঠিক জানি না। আমরা ১৪ দলে থাকব কি না সেটি সময়ই বলে দেবে। এখন জোটের কোনো কার্যকারিতা নেই। জোটের কোনো ইতিবাচক ভূমিকা নেই। আওয়ামী লীগের বড় শরিকদের সরকার আছে। তারা সব লুটপাট অনাচারে ব্যস্ত আছে। আওয়ামী লীগও সেটিকে সাপোর্ট করছে। জোটে মাঝে মাঝে বিভিন্ন দিন উদযাপন করে, যা আমরা দলের মধ্য থেকেই করি।’
বাসদের একাংশের আহ্বায়ক রেজাউর রশীদ খান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘১৪ দলীয় জোট আছে, কার্যক্রম আছে। ভার্চুয়ালি কার্যক্রম চলছে। আদর্শিক কারণে আমরা জোট করেছিলাম, সেটা ঠিক আছে। কিছু সংঘাত আছে। ১৪ দলীয় জোট আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে আগামীদিনে।’
এসএম/কেএফ/এসএ/