গুজবের বেড়াজালে আওয়ামী লীগ, দিশেহারা নেতাকর্মীরা
ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এখন চরম সংকটে। দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী আক্রমণ ও মামলার শিকার। সভাপতি শেখ হাসিনাসহ বেশিরভাগ নেতাকর্মী আত্মগোপনে রয়েছেন। নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায়, দলের নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গুজবের ওপর নির্ভর করছেন।
৫ আগস্ট ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা আর কোনো জনসমক্ষে আসেননি। কোনো বক্তব্য বা বিবৃতিও দেননি। তার সাম্প্রতিক ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর, দলের মধ্যে বিভ্রান্তি ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এদিকে, দেশে দলীয় নেতাদের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বক্তব্য, বিবৃতি ও প্রেসনোট ছড়ালেও, তাদের সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। অধিকাংশ নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
দলীয় পদ না থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় কয়েকবার ভিডিওবার্তা দিয়েছেন। তবে তার কথাবার্তায় অসামঞ্জস্য থাকার কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায়, নির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায়, নেতাকর্মীরা গুজবের ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া তথ্য যাচাই না করেই শেয়ার করছেন। অনেকেই এখনো মনে করছেন, ‘মাত্র ৭ মিনিটে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
হানিফের স্ট্যাটাস নিয়ে বিভ্রান্তি: ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার পর, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ৯ আগস্ট নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন। এতে তিনি লিখেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অভিনন্দন। দেশব্যাপী নারকীয় হত্যাকাণ্ড, বাড়িঘরে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
এই পোস্টের পর বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে, এটি আসলেই তার বক্তব্য কি না। কারণ তিনি এখনো এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো মন্তব্য করেননি।
নতুন কমিটি নিয়ে গুজব: ৬ সেপ্টেম্বর সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে আহ্বায়ক ও সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সদস্যসচিব করে আওয়ামী লীগের একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠনের গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিও বিভিন্ন ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রচারিত হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা বা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পক্ষে দেশে এসে দলের হাল ধরা সম্ভব নয়। তাই দলকে পুনর্গঠন ও সুশৃঙ্খল করতে এই অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী স্পষ্টভাবে জানান, “আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এ ধরনের গুজবের কোনো ভিত্তি নেই।”
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দলের বিভক্তি ও দুর্বলতা সৃষ্টির জন্য এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে। নেতাকর্মীদের গুজবে বিশ্বাস না করে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
নাছিমের বিবৃতি: নতুন কমিটি গঠন নিয়ে ৬ সেপ্টেম্বর রাতে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের নামেও একটি বিবৃতি প্রচারিত হয়। যদিও এর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। বিবৃতিতে নাছিম উল্লেখ করেন, “দেশ এখন সংকটকাল অতিক্রম করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। আমাদের নেতাকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হলেও, স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাদের মনোবল ভাঙতে পারেনি। তারা দলের নেতৃত্ব পরিবর্তনের গুজব ছড়াচ্ছে। আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিল, আছে এবং থাকবে।”
নানকের মনোবল চাঙা রাখার বার্তা: ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের নামে আরেকটি বার্তা সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়, যার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বার্তায় তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের সাধারণ জনগণ চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। মনোবল হারাবেন না, এই অন্ধকার কেটে যাবে।”
আলোচিত ফোনালাপ: ১৩ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়, যেখানে তিনি বেলজিয়ামে অবস্থানরত এক ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে কথা বলেন। ফোনালাপে তিনি দাবি করেন, সাংবিধানিক নিয়ম মেনে তিনি পদত্যাগ করতে পারেননি এবং চাননি লাশের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতায় থাকতে। তাই দ্রুত গণভবন ছেড়ে চলে গেছেন।
এর আগে, তানভীর নামে এক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীর সঙ্গে তার আরেকটি ফোনালাপ ফাঁস হয়, যেখানে তিনি বলেন, “আমি দেশের খুব কাছাকাছি আছি। যাতে আমি চট করে ঢুকে পড়তে পারি।”
এদিকে, আওয়ামী লীগের নামে ভুয়া প্রেস রিলিজ, পুরোনো ছবি-ভিডিও ব্যবহার করে স্ট্যাটাস দেওয়া এবং ভুয়া বিবৃতি ছড়িয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। অনেকে ‘মিষ্টির দোকান রেডি রাখুন, সুখবর আসছে’ এ ধরনের স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক জাগো নিউজকে জানান, “আমরা দেশেই আছি। আপাতত নীরব রয়েছি। পরিস্থিতি ছয় মাস পর্যবেক্ষণ করে করণীয় ঠিক করবো।”
দলের ভেরিফায়েড পেজ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, বিভিন্ন নামে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো বিবৃতিগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। দলীয় ফেসবুক পেজ, টেলিগ্রাম চ্যানেল, টুইটার (X) এবং ইউটিউব চ্যানেলের বাইরে অন্য কোনো মাধ্যম থেকে প্রকাশিত তথ্য যাচাইয়ের অনুরোধ জানানো হয়েছে। নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে, যাতে গুজবে বিভ্রান্ত না হন।