কোরআনের শাসন দিয়ে বাংলাদেশ চলবে না : শাহরিয়ার কবির
ছবি: সংগৃহীত
কোরআনের শাসন দিয়ে বাংলাদেশ চলবে না বলে মন্তব্য করেছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।
রোববার (২৮ জানুয়ারি) ‘স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের বিষয় নিয়ে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সাম্প্রতিক ষড়যন্ত্র’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটের সাগর-রুনি মিলনায়তনে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার কবির বলেছেন, থার্ড জেন্ডার তো পাঠ্যপুস্তকে রয়েছে। থার্ড জেন্ডার আমাদের সংবিধান স্বীকৃতি দিয়েছে। থার্ড জেন্ডার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। স্রষ্টাই এভাবে মানুষকে তৈরি করেছেন। আপনি স্রষ্টার সৃষ্টির বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াবেন নাকি? তারা যেভাবে কোরআনের ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তারা কে কোরআনের ব্যাখ্যা দেওয়ার এবং সেটা আমাকে মানতে হবে কেন? আর কোরআনের শাসন দিয়ে তো বাংলাদেশ চলবে না। আমাদের তো একটি সংবিধান আছে। তারা (মৌলবাদী) দরকার হলে আফগানিস্তান-পাকিস্তানে চলে যাক। কিন্তু বাংলাদেশকে আমরা আফগানিস্তান বানাতে দেব না।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত সপ্তম শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ অধ্যায়ে ‘শরিফার গল্প’ নামে একটি রচনা রয়েছে। এটা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সম্পর্কে যথাযথ ধারণা দেওয়ার জন্য। পাঠ্যপুস্তকে মুদ্রণ এবং তথ্যগত ত্রুটি সম্পর্কে বিভিন্ন দৈনিকের কিছু প্রতিবেদন আমাদের নজরে এসেছে, যা নতুন কোনো বিষয় নয়। এ ধরনের ত্রুটি ধরা পড়লে তা সংশোধন করা যায় এবং করা উচিতও। পাঠ্যপুস্তকে এ ধরনের ত্রুটি কখনও কাম্য নয়। কিন্তু গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর একটি মিলনায়তনে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ শীর্ষক সেমিনারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব আলোচনার এক পর্যায়ে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের উপরোক্ত রচনাটি ছিঁড়ে ফেলে গণমাধ্যমের সামনে যে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন এটাকে হালকাভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। তার এই কর্মকাণ্ডের পর ঝিম মেরে বসে থাকা হেফাজতীরা এবং তাদের সহযোগী জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক সংগঠন মাঠে নেমে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ১৯ জানুয়ারির সেমিনারে মৌলবাদী শিক্ষকদের ফোরামের নেতারা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি বিষদগার করে বলেছেন নতুন পাঠক্রমের সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে হবে, কারণ এটি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য, ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য, যা তাদের ভাষায় ‘ইসলামবিরোধী’। এই অনুষ্ঠানের বক্তাদের সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য ইউটিউবে এখনও প্রচারিত হচ্ছে। অভিযুক্ত শিক্ষক তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি ও মর্যাদা বিষয়ক পাঠে সমকামিতা প্রচারের অভিযোগ এনেছেন বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। তিনি জানতেন এর প্রতিক্রিয়া কী হবে। তিনি বলেছেন ইসলামের মর্যাদা রক্ষার জন্য নাকি এ কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামীর ঘাতকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করতে গিয়ে ইসলামের নামে যেভাবে গণহত্যা ও গণধর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধসমূহ জায়েজ করতে চেয়েছে, সেই এজেন্ডা থেকে তারা এখনও বিচ্যুত হয়নি। এখন তারা ’৭১-এর ভাষায় পাঠক্রম পরিবর্তন করতে চাইছে। ৭১-সালে জামায়াত নেতা মুজাহিদ বলেছিলেন, পাঠ্যপুস্তকে কোনো হিন্দু লেখকের লেখা কিংবা ইসলামবিরোধী লেখা থাকতে পারবে না।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক নাগরিক সমাজের ধারাবাহিক আন্দোলনের কারণে এবং সাধারণ পাঠক্রম যুগোপযোগী করার প্রয়োজনে বর্তমান পাঠক্রমে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা সাধারণভাবে প্রশংসিত হলেও ৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সহযোগীরা যেভাবে নতুন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে, এটাকে কঠোরভাবে দমন করা না হলে দেশ ও জাতির সামনে সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে। আমরা আশা করব, পাঠ্যপুস্তকে মুদ্রণ ও তথ্যগত যেসব ভ্রান্তি আছে, তা দ্রুত নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে, কিন্তু কোনো অবস্থায় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির দাবি মেনে কোনো রচনা বা বিষয় প্রত্যাহার বা পরিবর্তন করা যাবে না।
শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারে আপাতদৃষ্টিতে যে বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে, সেখানে তারা থার্ড জেন্ডার, ট্রান্সজেন্ডার এবং ট্রান্সজেন্ডার থেকে সমকামীতা নিয়ে আসছে। কিন্তু এগুলো কোনো বিষয় নয়। সেদিনের আলোচনায় তাদের মূল বিষয় ছিল, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি থাকতে পারবে না, সমতাভিত্তিক শিক্ষানীতি থাকতে পারবে না৷ তাদের ভাষায় ইসলামে তৃতীয় লিঙ্গের কোনো স্বীকৃতি নেই। তারা সমতাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি চায় না, পাঠ্যক্রম চায় না। এটা করে তারা সংবিধানকে শুধু আঘাত করেনি, বাংলাদেশের অস্তিত্বকেও আঘাত করেছে। লড়াইটা হচ্ছে বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এখানে সরকার যদি কোনো রকম সমঝোতা করে, সেটা বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, পাঠক্রম নিয়ে বিতর্ক চলছে আজ প্রায় ৮০ বছর। বঙ্গবন্ধুর সরকার ব্যতীত আর কোনো সরকার শিক্ষা সংক্রান্ত নীতি বা পাঠক্রম দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। উপমহাদেশে, ভারতে এই বিতর্ক এখন চরমে। যেসব দেশে গণতন্ত্র স্থিতিশীলতা পেয়েছে এবং দৃষ্টিভঙ্গি মোটামুটি ধর্মনিরপেক্ষ সেসব দেশে পাঠক্রম নিয়ে বিতর্ক কমেছে। যুগোপযোগী পাঠক্রম তৈরির জন্য সেখানে আলাদা সংস্থা আছে।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, বই থেকে পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন কলামিস্ট মমতাজ লতিফ।