এবারের আন্দোলনই শেষ লড়াই: মির্জা ফখরুল
সরকার হটানোর এবারের আন্দোলনই ‘শেষ লড়াই’ বলে নেতা-কর্মীদের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুক্রবার (২ সেপ্টেম্বর) গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চে দলের ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় এই আহ্বান জানান তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এবারই শেষ লড়াই। আমাদেরকে জীবনমরণ লড়াই করতে হবে। এবার সেই জাগপার কথায় বলতে চাই, হয় জীবন না হয় মরণ। আসুন আমরা সেই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে একটা দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলি যা ওই উত্তাল সমুদ্রে যে সুনামি হয় সেই সুনামির মতো এই সরকারকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। দেশনেত্রীকে মুক্ত করব, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনব, এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আজকের এই ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অত্যন্ত সংকটময় মুহূর্তে পালন করছি। আমাদেরকে প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত সর্তকতার সঙ্গে নিতে হবে যেন কোনো মতে তারা সুযোগ না পায় আমাদেরকে ভেঙে দিতে, গুঁড়িয়ে দিতে।’
পুলিশ বাহিনীর প্রতি আহ্বান রেখে ফখরুল বলেন, ‘আমরা খুব পরিস্কার করে বলতে চাই, আমরা পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে নই, আমরা কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে নই। আমার ট্যাক্সের পয়সায় তাদের বেতন হয়, তাদের সংসার চলে, তাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে, তাদের বউ-বাচ্চাদের কাপড় দেয়- তাই না। তারা আমাদের লোকজনকে গুলি করে মেরে ফেলবে এটা কী আমরা মেনে নেব?’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা বলতে চাই, আপনাদেরকে আমরা কখনো প্রতিপক্ষ বানাতে চাই না। আপনারা দয়া করে জনগণের প্রতিপক্ষ হবেন না। আমাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু সাহেব বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রতিষ্ঠান র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আপনারা কি চান পুলিশের উপর এভাবে সেনশন আসুক? আপনারা কি চান এই দেশের মানুষ আপনাদের উপর সেনশন জারি করুক? আমরা এটা চাই? নিশ্চয় চায় না। আমরা সবাই আশা করব, পুলিশ জনগণের যে ন্যায্য অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটের অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার সেজন্য তারা সহযোগিতা করবে এবং যারা অন্যায় করছে, অবিচার করছে, যারা গুলি করে হত্যা করছে, যারা জোর করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর মতো জোর করে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে তাদের বিরুদ্ধে জনগণ জেগে উঠেছে, লড়াই শুরু করেছে, সেই লড়াইয়ে তারাও শরিক হবেন এই আশা আমরা করতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘অনেক চরাই-উতরাই পার হতে হয়েছে। বারবার আঘাত এসেছে বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য। বারবার বিএনপিকে শেষ করে দেওয়ার কাজ হয়েছে। কিন্তু বিএনপি কখনো দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। বিএনপি প্রতিবারই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে এবং এদেশের মানুষকে সামনে নিয়ে আবারও তারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে গেছে বারবার।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘১/১১। ওরা ভেবেছিল বিএনপিকে শেষ করে দেওয়া যাবে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারুণ্যের প্রতীক, আমাদের আশা-ভরসার স্থল তারেক রহমানকে নির্বাসিত করে তাকে মিথ্যা সাজা দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে, আমাদের অসংখ্য নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে, গুম-খুন করে ভেবেছিল বিএনপিকে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে। কিন্তু এই ১৫ বছরেও বিএনপিকে ধ্বংস করা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আজকে আবার ওই গ্রামের আইলের মধ্যে, সেই ধানের ক্ষেতের মধ্যে, গ্রামে-গঞ্জে বিএনপি জেগে উঠতে শুরু করেছে। ধানের গুচ্ছে আবার রক্ত জমেছে। সেই রক্তকে অবশ্যই আমাদের ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে।’
ফখরুল বলেন, ‘আমরা যে গণতন্ত্রের সংগ্রাম শুরু করেছি আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে, সেই গণতন্ত্রকে যুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের জয়ী হতে হবে। যখন বিএনপি আন্দোলন শুরু করেছে মানুষের সমস্যাগুলো নিয়ে, জ্বালানি তেল, চাল-ডাল-তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে তখন তারা সেই আগের মতো গুলি করে হত্যা করছে আমাদের সহযোদ্ধাদের-সহকর্মীদের।’
তিনি বলেন, ‘গতকাল গুলি করে হত্যা করেছে আমাদের নারায়ণগঞ্জের যুবদলের কর্মী শাওনকে। কী লজ্জার কী ধিক্কার যে, কাল একজন এসপি বলছে যে, শাওন যুবদলের কর্মী নয়। আমি আজ সকালে গিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জে। আমাদের দলের প্রত্যেক নেতা-কর্মী, যুব দলের সব নেতা-কর্মী, শাওনের পরিবার, মা ও তার আত্বীয়-স্বজন সবাই বলেছে, অবশ্যই শাওন যুবদল করত। সে গতকাল মিছিলের অগ্রভাগে ছিল। সেই ছবি গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ওরা (পুলিশ) কত নোংরা হতে পারে। কী করেছে জানেন। গতকাল রাতে শাওনের মরদেহ তার আত্বীয়-স্বজনকে দেয়নি, আমাদের দলের নেতা-কর্মীদের দেয়নি। শাওনের লাশ তারা গোপনে পুলিশ পাহারায় নিয়ে গিয়ে দাফন করেছে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘শুধু তাই নয়, শাওনের ইমিডিয়েট বড় ভাই তাকে দিয়ে জোর করে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে তারা একটা মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। আমি হুঁশিয়ার করতে চাই, যারা এই ধরনের মিথ্যা মামলা করাবেন, যারা এভাবে গুলি করে আমাদের নেতা-কর্মীদের হত্যা করবেন, গণতন্ত্রের নেতা-কর্মীদেরকে হত্যা করবেন তাদের প্রত্যেকের সব হিসাব কড়ায়-গন্ডায় নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ভোলায় মামলা করেছি। ভোলায় নুরে আলম ও আব্দুর রহিমের হত্যা মামলা করেছি, আমরা অবশ্যই শাওনের হত্যা মামলা করব। আপনারা যারা জেলায় জেলায় আমাদের কর্মীদেরকে আহত করছেন তার প্রত্যেকটির হিসাব নেওয়া হবে।’
ফখরুল বলেন, ‘ভয় পেয়ে গেছে। সেজন্য তারা আবার সেই ২০১৩,২০১৪, ২০১৫, ২০১৮ এর মতো মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা শুরু করেছে। এই কায়দায় এটা করছে। সিরাজগঞ্জে করেছে, সেখানে আমাদের এক কর্মীর চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, নড়াইলে করেছে, নেত্রকোনায় করেছে, নারায়ণগঞ্জে করেছে। তারা ভেবেছে এভাবে আগের মতো গুলি করে, গুম করে যেমন ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে, চৌধুরী আলমকে গুম করেছে, আমাদের ছাত্র নেতাদের গুম করেছে সেভাবে গুম করে তারা আবারও ক্ষমতায় টিকে থাকবে। সেই চিন্তা করবেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার মানুষ জেগে উঠেছে, দেশের তরুণরা জেগে উঠেছে, দেশের যুবকরা জেগে উঠেছে। আপনাদের ক্ষমতার মসনদ গুঁড়ে দেবে এবং অবশ্যই আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যে স্লোগান সেই স্লোগান হচ্ছে ফয়সালা হবে কোন পথে? রাজপথে। আমরা কী বলব- টেক ব্যাক বাংলাদেশ।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আজকে দেশের যে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এই নাজুক পরিস্থিতিতে আমাদেরকে প্রথম দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, এই সংকটের সমাধান হবে রাজপথে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজপথে আমাদেরকে সেইভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আসুন এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমরা শপথ নিই। আগামী দিনের নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য সবাই আমরা রাস্তায় থাকব এটাই হোক আজকের শপথ।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের গত কয়েকদিনে পাখির মতো গুলি করে মেরেছেন, তারা পিছপা হয় নাই। আমি বলতে চাই, এই কর্মীরা ভয় পাওয়ার কর্মী নয়। এরা ভয় পেতে পেতে এই জায়গায় এসেছে। আর কত ভয় দেখাবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনার (সরকার) হাতে আছে কী? আপনার হাতে কিছুই নাই। পুলিশ বাহিনী ছাড়া এই সরকারের হাতে কিছুই নাই এবং একসময় জনগণের চাপে রোষের মুখে এই পুলিশ একদিন পলায়নপর হয়ে পালাতে বাধ্য হবে।’
মহানগর নাট্যমঞ্চে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভার শুরুতে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির উপর জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) আয়োজনে ‘হরিলুটের রাজা’ শীর্ষক পথ নাটক মঞ্চস্থ হয়।
বিএনপি মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীমের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, শামসুজ্জামান দুদু, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, যুবদলের সুলতান সালাহ উদ্দিন টুকু, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, স্বেচ্ছাসেবক দলের আবদুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েল, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাদেক আহমেদ খান, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসাইন ও কৃষক দলের শহিদুল ইসলাম বাবুল বক্তব্য রাখেন।
এমএইচ/এসজি