যে কারণে আলোচিত ছিলেন জয়নাল হাজারী
রাজনীতির ব্যাডবয় খ্যাত জয়নাল হাজারী মারা গেছেন। সেই সঙ্গে তার বহুল আলোচিত রাজনৈতিক জীবনেরও পরিসমাপ্তি ঘটলো। একসময় রাজনীতিতে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রেওয়াজ ছিল। যে এলাকায় সন্ত্রাসীদের রাজত্ব থাকতো সেখানে একজন গডফাদারকে দিয়ে প্রতিপক্ষ ঘায়েল করা হতো।
১৯৭৫ সালের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ফেনীর রাজনীতিতে আর্বিভাব হয় জয়নাল হাজারীর।
১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি এমন ছিল যে, সভা-সমাবেশ, মিছিলেও গুণ্ডাবাহিনী হামলা করতো, বাধা দিত। সেজন্য পাল্টা গুণ্ডাবাহিনী রেখে সেই সমাবেশ করতে হতো অনেক ক্ষেত্রে। এ কারণে পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মতো একটি গণতান্ত্রিক এবং জননির্ভর রাজনৈতিক দলেও অনুপ্রবেশ ঘটে সন্ত্রাসের। মাঠ দখলের জন্য তারা দলে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। এই সময়ে লিয়াকত, হান্নান, আওরঙ্গের মতো নেতারা আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কাজ করেছিলেন। তখনই আর্ভিভাব ঘটে জয়নাল হাজারীর।
ফেনীর রাজনীতির একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া বগুড়া কেন্দ্রিক রাজনীতির পাশাপাশি ফেনীর রাজনীতিতেও একটি প্রভাব রেখেছিলেন। তার পৈত্রিক নিবাস বিবেচনায় তিনি ফেনীতে বিএনপির শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। এ সময়ে খালেদা জিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো একমাত্র নেতা ছিলেন জয়নাল হাজারী। এই চ্যালেঞ্জ জানানোর পথ এবং পদ্ধতি যে সবসময় রাজনৈতিক ছিল, তাও নয়। এজন্য হয়তো হাজারী বাহিনী বা তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলতে হয়েছিল।
২০০১ সালের ১৬ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ফেনীর মাস্টার পাড়ায় জয়নাল হাজারীর বাড়িতে অভিযান হয়। তখন তিনি গ্রেপ্তার এড়িয়ে ভারতে পালিয়ে যান। ২০০৪ সালে তিনি আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশে ফিরে আসেন। এরপর আদালতে আত্মসমর্পণের পর কিছুদিন কারাগারে থেকে জামিনে ছাড়া পান। কিন্তু তিনি আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হননি।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সর্বশেষ সংসদ সদস্য থাকাকালে তিনি ও তার বাহিনীর নির্যাতনের কথা সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রকাশ হয়। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বাইরে ‘স্টিয়ারিং কমিটি' নামে একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে সন্ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তোলার অভিযোগ ওঠে। তবে এ বিষয়ে হাজারীর দাবি ছিল,‘স্টিয়ারিং কমিটি মানুষের জন্য কাজ করেছে।’
এক সময় ফেনীর রাজনীতি মানেই জয়নাল হাজারী। তার কথায় প্রশাসনসহ সকল রাজনৈতিক নেতারা চলতো। জয়নাল হাজারীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতো না। তার এই কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগও বিব্রত হয়। পরবর্তীতে সন্ত্রাসী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করেন এই নেতা। তবে মূল ধারার রাজনীতিতে আর সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
জয়নাল হাজারী ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় বিশ বছরের বেশি সময় ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-২ (ফেনী সদর) আসন থেকে ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
জয়নাল হাজারী সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি দীর্ঘ দিন যাবৎ কিডনি, হৃদরোগসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
এসএম/এএন