বিএনপির টার্গেট ঢাকা
রাজনৈতিক সমঝোতার দৃশ্যত পরিবর্তন দেখছে না বিএনপির হাইকমান্ড। দুই দফায় আন্দোলন-সংগ্রামে সারাদেশের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেও সেই অর্থে ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে আন্দোলন ছিল ততটাই নিস্ক্রিয়। ফলে সফলতার মুখ দেখেনি দলটির সরকার পতনের আন্দোলন। এবার ব্যর্থতার তকমা গোছাতে নগর বিএনপিকে আন্দোলনমুখী হিসেবে গড়ে তুলতে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। নির্দেশনায় নগর উত্তর-দক্ষিণ বিএনপিকে অভ্যন্তরীণ দ্বিধা-দ্বন্ধ ভুলে ঐক্য গড়ে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিতে বলা হয়। ফলে দাবি আদায় করতে সরকার পতনে এবার ‘ঢাকায়’ আন্দোলনের মূলকেন্দ্র গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত দলটির। সেই লক্ষ্য নগর বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে প্রয়োজনীয় কৌশল নেওয়া হচ্ছে। বিএনপির দায়িত্বশীল বেশকয়েকজন নেতার সঙ্গে ঢাকাপ্রকাশ-কে এ তথ্য জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ইতোমধ্যে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ইউনিটে কমিটি ঘোষণা করেছে দুইভাগে বিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপি। ওয়ার্ড ও ইউনিটের কার্যক্রম শেষ হলে থানা কমিটি গঠন করা হবে। থানা কমিটির গঠন কার্যক্রম শেষে নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে এরইমধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত আহ্বায়কদ্বয় সক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হলে- আন্দোলনের স্বার্থে প্রয়োজনে কমিটি ভেঙে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার বিষয়েও বিকল্প ভেবে রেখেছেন দলটির হাইকমান্ড। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা পৌছাতে ব্যর্থ হলে বিএনপি হাইকমান্ডের ভাবনা শেষ পর্যন্ত বাঁকা পথে হাঁটার দিকেই। একইসঙ্গে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনে যেতে সরকারবিরোধী সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা পর্বেও ইতি টানার নীতিগত সিদ্ধান্ত বিএনপির।
সোমবার ২ আগস্ট ২১ সালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৪৭ সদস্য বিশিষ্ট ঢাকা মহানগর উত্তর এবং ৪৯ সদস্য বিশিষ্ট ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির দুটি আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন করেন। উত্তরে আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান দক্ষিণে আহ্বায়ক করা হয় আবদুস সালামকে, আমিনুল হককে উত্তরের এবং রফিকুল আলম মজনুকে দক্ষিণের সদস্য সচিব করা হয়।
২০১১ সালে ১৪ মে সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও আবদুস সালামকে সদস্য সচিব করে ১৯ সদস্যের মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে ১৮ জুলাই মির্জা আব্বাস কে দায়িত্ব দিয়ে ৫২ সদস্যের নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে বিএনপি। কমিটিতে সদস্য সচিব রাখা হয় হাবিব উন নবী খান সোহেলকে। কমিটিতে উপদেষ্ঠা হিসাবে রাখা হয় আ স ম হান্নান শাহ, রফিকুল ইসলাম মিয়া, সাদেক হোসেন খোকা ও আবদুস সালামের মতো অভিজ্ঞ নেতাদের।
কিন্তু সেই কমিটিও তাদের পূর্ব উত্তরসূরি সাদেক হোসেন খোকা-আবদুস সালাম কমিটির পথ অবলম্বন করে। আন্দোলনের মাঝখানে খেইল হারিয়ে ব্যর্থতার তকমা থেকে বের হতে পারেনি আব্বাস-সোহেল। পরবর্তীতে এই নিয়ে দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সকল নেতাদের সভা-সেমিনারে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের তুপের মুখে পড়তে দেখা গেছে।
এদিকে বিগত দিনের মতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে আসছে- সংবিধান মোতাবেক দলীয় সরকারে অধীনেই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পক্ষান্তরে বিএনপির দাবি- নির্বাচনকালিন সরকার ও সরকার প্রধান হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নিবে না, দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম তার রাজনৈতিক গুরু-খ্যাত প্রয়াত নেতা সাদেক হোসেন খোকার পথেই হাটঁছেন। মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দুই বলয় দলের ভেতরে-বাইরে দৃশ্যত বিরাজমান। কোন্দল, বিভক্তি কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও দেখা যায়। ধারাবাহিকতায় সাদেক হোসেন খোকা যখন নগর বিএনপির দায়িত্বে আসেন তখন তিনি মির্জা আব্বাসের বলয় অর্থাৎ নেতা-সমর্থকদের কোণঠাসা করে রাখা হয়, পরবর্তীতে মির্জা আব্বাস দায়িত্বে এসে তাকেও খোকার পথই অনুসরণ করতে দেখা গেছে।
এইবার নেতৃত্বে আব্বাস-খোকা না থাকলেও তাদের কোন্দলকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বিবেচনায় আবদুস সালাম এখনো জিইয়ে রেখেছেন বলে নেতা-কর্মীদের অভিযোগ উঠেছে। বাস্তবতায় মহানগর দক্ষিণের বিভিন্ন ওয়ার্ড- ইউনিটের কমিটি ঘোষণায় তেমনটাই দৃশ্যত হয়। কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে আবদুস সালামের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন নগর বিএনপির বেশকয়েকটি ওয়ার্ড-ইউনিটের নেতা-কর্মীরা। শুধু তাই নয় কয়েকটি ওয়ার্ড-ইউনিটে বিকল্প কমিটিও গঠন করেছে মির্জা আব্বাসের কর্মী সমর্থকরা। ফলে সেই সকল নেতা-কর্মীদের শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে কেন বহিষ্কার করা হবে না, সেই মর্মে আবদুস সালামের পক্ষে নবী উল্লাহ নবী কারণদর্শানোর নোটিশ প্রেরণ করেছেন।
আহ্বায়ক কমিটির দ্বারা ফের নতুন করে কমিটি গঠন প্রক্রিয়াকে সাংগঠনিকভাবে সংগঠন গোছানোর নামে সময়ক্ষেণের মাধ্যমে পুনরায় ‘বলয় বন্দি’র চক্র হিসাবে দেখছে নগর বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা।
নেতা-কর্মীদের ভাষ্য- অতীতে ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে যাদের কে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তারাই আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে নিজের ‘বলয়’ তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। তাই সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালি করার মানেটা যদি হয়- শুধুমাত্র নতুন কমিটিতে নতুন কিছু নেতা-কর্মীর পুনর্বাসন, তাহলে কাজের কাজ কিছুই হয় না, অতীতেও হয়নি। আহ্বায়ক কমিটিও পূর্ণাঙ্গ কমিটির মুখ দেখে না, আন্দোলন-সংগ্রামেও নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততা থাকে না। কমিটির বাইরে থাকা বৃহত্তর একটি অংশের নেতা-কর্মীদের খুব একটা সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে না। ফলে আন্দোলন-সংগ্রাম তীড়ে এসে তরী ডুবার মতো মুখ তুবড়ে পড়তে দেখা গেছে।
নগর বিএনপির দায়িত্ব পালন করেছেন এমন একাধিক নেতারা ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান- প্রয়াত বিএনপির নেতা প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা এবং মির্জা আব্বাস, হাবিব উন নবী সোহেলের মতো নেতারা যেভাবে ‘নিজস্ব বলয়’ তৈরিতে গিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যর্থ হয়েছেন। একইভাবে বর্তমান নেতৃত্ব আমান উল্লাহ আমান, আব্দুস সালাম, রফিকুল আলম মজনু, আমিনুল হক দের মতো নেতারাও যদি নিজস্ব বলয় তৈরিতেই সময় অতিবাহিত করে যায়- তাহলে দুই ভাগ নয়, চার ভাগ করেও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে না মহানগর বিএনপি ও বিএনপির সরকার বিরোধী সরকার পতনের আন্দোলন।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘চলতি মাসেই আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডের ইউনিট কমিটি গুলো কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ করা হবে। ওয়ার্ড ও ইউনিট কমিটি শেষে থানা কমিটি গঠনে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অতীতে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তারা বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে যথাসাধ্য অবদান রেখেছেন, তবে কতটুকু অবদান রাখতে পেরেছেন- সেটা সবাই অবগত। এবার দায়িত্ব নিয়েছি- এখন বলতে পাচ্ছি না.. সময় বলে দিবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় আগামীদিনে সরকার পতন আন্দোলনে সাংগঠনিকভাবে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারব। এতটুকু বলতে পারি- চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না।’
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আন্দোলনে যাওয়ার জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাও দাবি আদায় করার জন্য বলছি- তবে সরকার যদি না শুনে তাহলে রাজপথে কঠোর আন্দোলনের বিকল্প নেই। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় যুগপৎ আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে সরব হওয়ার সেই লক্ষ্যে নগর বিএনপিকে শক্তিশালী করতে কাজ করা হচ্ছে।’
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এবার ভিন্ন কৌশলে আমাদেরকে সাংগঠনিক কার্যক্রমে অগ্রসর হতে হচ্ছে। মহানগরের তৃণমূল থেকে শুরু করে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে অগ্রগামী হচ্ছি। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে রাজপথ আন্দোলন উপযোগী নেতৃত্ব তৈরির মাধ্যমে মহানগর বিএনপি ভূমিকা রাখবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আছে, থাকবে। কোন কোন্দল নেই যা আছে তা নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ আমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, 'প্রথমে ইউনিট কমিটি থেকে শুরু করেছি, ধারাবাহিকভাবে ওয়ার্ড কমিটি, থানা কমিটির কার্যক্রম কাউন্সিলের মাধ্যমে শেষ করে মহানগর কমিটিকে কিভাবে আগামী দিনের আন্দোলন সংগ্রামে উপযোগী করে গড়ে তোলা যায় সেই বিষয়ে নানা কৌশল অবলম্বন করে কাজ করে যাচ্ছি।'
তিনি বলেন, 'আমরা মহানগরের তৃণমূল থেকে সংগঠনকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি ওই সাংগঠনিক শক্তির মাধ্যমে অনির্বাচিত এই সরকারকে পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব। তখন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে,দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরে আসবে জবাবদিহিতা ও জনপ্রতিনিধিত্ব সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।'
বিএনপির সূত্র জানা গেছে, আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান ও আব্দুস সালামের নেতৃত্বে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে এবং আগামী দিনের আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন প্রকার ব্যত্তয় ঘটাতে পারে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হলে তাদেরকে দুই জনকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে আমিনুল হক আহ্বায়ক বা সভাপতি তার সঙ্গে তাবিদ আউয়াল এবং রফিকুল ইসলাম মজনুকে আহ্বায়ক সভাপতি এবং তার সঙ্গে ইশরাক হোসেন কে দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য ঢাকা মহানগর (উত্তর দক্ষিণে ) বিএনপির কমিটির নির্ধারণ সুযোগ থাকছে।
এএজেড