১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ছিল ২৫ শতাংশ। তবে শেয়ার ৫ শতাংশে নামিয়ে মালিকানা কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছে সরকার। এসব পরিবর্তন বাস্তবায়নের জন্য সরকার ইতোমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক আইন, ২০১৩ সংশোধনের একটি খসড়া প্রণয়ন করেছে।
খসড়াটি অংশীজনদের মতামত নেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, খসড়াটি প্রণয়নের আগে বিভাগের পক্ষ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের আইন উপদেষ্টাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এ পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকে সরকারের অংশীদারিত্ব এবং বোর্ডের প্রতিনিধিত্বকে ২০১১ সালের আগের কাঠামোতে ফিরিয়ে আনা।
১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ছিল ২৫ শতাংশ। তবে, পরবর্তী সরকারগুলো পরিশোধিত মূলধনে অবদান না রাখায় এ অংশীদারি ধীরে ধীরে ৫-৮ শতাংশে নেমে আসে বলে তিনি জানান।
২০১১ সালে মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের সময় সরকার ২৫ শতাংশ শেয়ারহোল্ডিং পুনঃস্থাপনের জন্য মূলধন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিল।
নতুন খসড়া অনুযায়ী, ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ৩০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হবে। ঋণগ্রহীতারা ধীরে ধীরে মূলধনে অবদান বাড়িয়ে ৯৫ শতাংশ মালিকানা অর্জন করবেন। বোর্ড ঘোষিত যেকোনো লভ্যাংশ মূলধনের ভিত্তিতে আনুপাতিকভাবে বিতরণ করা হবে।
সূচনালগ্ন থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ১২ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যানসহ সরকারের মনোনীত তিনজন পরিচালক এবং ঋণগ্রহীতাদের নির্বাচিত নয়জন পরিচালক রয়েছেন। নতুন প্রস্তাবে ঋণগ্রহীতারা বোর্ডে ১১ জন পরিচালক নির্বাচনের সুযোগ পাবেন।
বর্তমান আইনে বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে রয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত খসড়ায় চেয়ারম্যান নির্বাচন বোর্ডের সদস্যদের মধ্য থেকেই করার বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া, বর্তমানে আইনে বলা হয়েছে, চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে বা তিনি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে, সরকার তার মনোনীত দুই পরিচালকের মধ্যে একজনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে।
প্রস্তাবিত খসড়ায় এ বিধানটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান অক্ষম হলে, বোর্ডের সদস্যরা অন্য কোনো পরিচালককে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুমোদন দিতে পারবেন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডে চেয়ারম্যান এবং তিনজন পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে রয়েছে। তবে, ড. ইউনূসের অপসারণের আগে সরকার সাধারণত কেবল চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষমতা ব্যবহার করত।
তিনি বলেন, "২০১১ সালের পর থেকে সরকার চেয়ারম্যানের পাশাপাশি তিনজন পরিচালকও নিয়োগ দিতে শুরু করে।"
বর্তমান আইনের অধীনে, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সর্বোচ্চ ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারেন। প্রস্তাবিত খসড়ায় এ বিধান বহাল রাখা হয়েছে। তবে এতে নতুন একটি শর্ত যুক্ত করা হয়েছে—বোর্ডের অনুমোদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৬৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে, যদি ব্যাংকের কার্যক্রমে তা প্রয়োজনীয় মনে হয়।
বর্তমান আইনে পরিচালকদের মেয়াদ তিন বছর নির্ধারিত রয়েছে, এবং খসড়া অধ্যাদেশেও এটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে নতুন একটি সংযোজন করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, "নবনির্বাচিত পরিচালকেরা তাদের দায়িত্ব গ্রহণ না করার আগ পর্যন্ত নির্বাচিত পরিচালকেরা তাদের পদে থাকবেন।"
এছাড়া, বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন আঞ্চলিক অফিস খোলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু খসড়া অধ্যাদেশে এ শর্তটি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বর্তমান আইনে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জোবরা গ্রামে ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের কোনো উল্লেখ নেই। তবে খসড়া অধ্যাদেশে আইনের ধারা ৪-এ একটি ব্যাখ্যা যুক্ত করে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নতুন ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প বলতে ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধীনে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামে পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে বোঝায়। এ প্রকল্প পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পায় এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক এতে অংশগ্রহণ করে।
২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। সরকার জানিয়েছিল, ড. ইউনূস পদের জন্য নির্ধারিত ৬০ বছরের বয়সসীমা অতিক্রম করেছেন। তিনি এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করলেও আদালত তা খারিজ করেন।
ড. ইউনূসের পদত্যাগের পর ২০১৩ সালে সরকার গ্রামীণ ব্যাংক আইনে সংশোধনী আনে। তবে এ সংশোধনীতে ব্যাংকের মালিকানা ও পরিচালনা পর্ষদে সরকারের অংশীদারিত্ব বজায় রাখা হয়।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ করে। এছাড়া, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকটিকে কর মওকুফের সুবিধাও দেয়।