গোপনে দলিলপত্র সরাচ্ছে এস আলম গ্রুপ, এক আওয়ামী লীগ নেতার বাসায় ১৫ বস্তা নথি
গোপনে দলিলপত্র সরাচ্ছে এস আলম গ্রুপ, এক আওয়ামী লীগ নেতার বাসায় ১৫ বস্তা নথি। ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপের প্রধান কার্যালয় থেকে অন্তত ১৫ বস্তা গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কাগজপত্র অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। গত ২৬ আগস্ট এসব কাগজপত্র প্রথমে চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁওয়ে এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে এ নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলে চারদিন পর সবকিছু সরিয়ে নেওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে।
গত ২৮ আগস্ট বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকদের টাকা লুট করে যে সহায় সম্পত্তি গড়েছে তা গোপনে বিক্রি করতে চাইছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। ওই সময় এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, ‘শোনা যাচ্ছে বাজেয়াপ্ত হওয়ার ভয়ে গোপনে সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে এস আলম গ্রুপ। আইনি জটিলতার কারণে এখনি হস্তক্ষেপ করতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শিগগিরই আইনি উপায় খুঁজে বের করা হবে। তাই সর্বসাধারণকে সাবধান করা হচ্ছে, এস আলম গ্রুপের সম্পদ কেউ কিনবেন না। সেই সম্পত্তি কোনো সচেতন মানুষের কেনা উচিত হবে না। এস আলমের কোনো সম্পত্তি কিনে বিপদে পড়লে তার দায় সরকার নেবে না।’
গত ১৫ বছর ধরে হঠাৎ করে ফুলেফেঁপে ওঠা এস আলম গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরপরই গা ঢাকা। অনেকে চলে যান দেশের বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে গোপনে সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে এস আলম গ্রুপ- বিভিন্ন সূত্রে এমন খবর মিলছে।
গণমাধ্যমের হাতে আসা এক ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ২৬ আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে রূপালী রঙের একটি কার চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও এলাকার শমসেরপাড়ার একটি বিল্ডিংয়ের নিচে এসে থামে। সেই গাড়ি থেকে নামেন এস আলম গ্রুপের ভূ-সম্পত্তি বিভাগের এস্টেট ম্যানেজার সাইফুদ্দিন। এর পরপরই সেখানে এসে হাজির হয় একটি কাভার্ড ভ্যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেশকিছু শ্রমিক এনে অন্তত একঘন্টা ধরে সেই কাভার্ড ভ্যান থেকে কমপক্ষে ১৫টি বস্তা নামানো হয়। সেগুলো বিল্ডিংটির পার্কিংয়ের ভেতরে নিয়ে রাখা হয়। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পুরো বিষয়টি সমন্বয় করেন এস আলমের এস্টেট ম্যানেজার সাইফুদ্দিন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চান্দগাঁওয়ে যে বাড়ির পার্কিংয়ে ১৫ বস্তা কাগজপত্র রাখা হয়, সেই বাড়িটি সাইফুদ্দিনের ভগ্নিপতি মোহাম্মদ ইসমাইলের। চট্টগ্রাম আদালতে তিনি স্ট্যাম্প ভেন্ডর হিসেবে কর্মরত। আবার ইসমাইলের ভাই চান্দগাঁও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক আয়ুব মুন্সীও দলিললেখক হিসেবে কাজ করেন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা আয়ুব মুন্সীর মাধ্যমে এস আলমের জমি কেনাবেচার বড় একটি অংশ করিয়ে আসছিলেন সাইফুদ্দিন। সরকার পতনের পর আয়ুব মুন্সীকে নগর বিএনপির এক শীর্ষ নেতার অনুসারীরা এলাকায় ‘প্রটেকশন’ দিচ্ছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এর সূত্র ধরে আয়ুব মুন্সী বাড়িকে নিরাপদ স্থান বিবেচনা করে সেখানে জায়গাজমির দলিলপত্র এনে রেখে নয়ছয় বা বিক্রি করার চেষ্টা করা হয়েছিল- সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এমন আভাস দিয়েছেন।
সাইফুল আলম মাসুদের ভাগ্নে মোস্তান বিল্লাহ আদিল বর্তমানে এস আলম গ্রুপের ভূ-সম্পত্তি বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি ও তার স্ত্রী সাদিয়া জামিলের বিরুদ্ধে নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক থেকে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। এস আলমের ভূ-সম্পত্তি বিভাগে আদিলের প্রধান সহযোগী হলেন এস্টেট ম্যানেজার সাইফুদ্দিন।
জানা গেছে, ১৫ বস্তা কাগজপত্র সরানোর বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলে গত ৩১ আগস্ট বিকেলে সব কাগজপত্র একে একে সরিয়ে নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘৩১ আগস্ট বিকেল পৌনে ৫টার দিকে দুটি মাইক্রোবাস ও একটি মিনি ট্রাকে করে কয়েক ধাপে কাগজপত্রগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়।’
এস আলমের জায়গাজমির দলিলপত্র নিজের বাসায় সরানোর পুরো বিষয়টি আয়ুব মুন্সীর পরিকল্পনাতেই হয়েছে- স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে এমন কথা জানা গেলেও শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) বাড়ির মালিক চান্দগাঁও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক আয়ুব মুন্সী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার বড় ভাইয়ের শ্যালক এস আলমের বস্তাভর্তি কাগজপত্রগুলো যে আমাদের পার্কিংয়ের ভেতরে রেখেছে, সেটা আমরা জানতাম না। পরে অফিস থেকে বাসায় ফিরে বিষয়টি জানার পর সাইফুদ্দিনকে বস্তাগুলো সরিয়ে নিতে বলি।’
তিনি বলেন, ‘এর কয়েকদিন পর দুটি নোহা মাইক্রোবাস ও একটি ছোট মিনি ট্রাক এনে এস আলমের বস্তাগুলো অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয় সাইফুদ্দিন।’
বস্তাগুলোতে কোনো টাকা ছিল কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে আয়ুব মুন্সী বলেন, ‘বস্তাগুলো আমি ধরে ধরে দেখেছি, সেখানে টাকা ছিল না। এগুলো এস আলমের জায়গা-জমির দলিল বলে মনে হয়েছে।’
অন্যদিকে এস আলম গ্রুপের এস্টেট ম্যানেজার সাইফুদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নানা সমস্যায় আমাদের গ্রুপের অনেক জায়গাজমির নামজারিসহ বিভিন্ন কাজকর্ম করা যাচ্ছে না। আমার ভগ্নিপতির ভাই দলিললেখক হওয়ায় দলিলপত্রগুলো তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। পরে তিনি মানা করায় আবার সেগুলো নিয়ে এসেছি।’
এতেগুলো দলিলপত্র কোথায় সরালেন- এমন প্রশ্নের জবাবে এস্টেট ম্যানেজার বলেন, ‘খাতুনগঞ্জে আমাদের অফিসেই নিয়ে এসেছি।’