রেলের গডফাদার তমা-ম্যাক্স গ্রুপ, ১৮শ' কোটি টাকার প্রকল্প হয়ে গেছে ১৮ হাজার কোটি!
তমা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আতাউর রহমান মানিক এবং ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর। ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী সরকারের আমলে বাজেটে সব থেকে বেশি বরাদ্দ পেত পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো খাত। নতুন রেলপথ, সড়ক, সেতু নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। আর এসব অবকাঠামোগত কাজগুলো করানো হতো তৎকালীন সরকারের পছন্দের কিছু ঠিকাদারদের দিয়ে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কন্সট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। এই দুই প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে রেলের সব মেগা প্রজেক্টগুলো নিয়ে।
সম্প্রতি দেশের একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়েতে কাজ করা স্থানীয় ঠিকাদারদের মধ্যে টাকার অংকে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। লাকসাম-চিনকি আস্তানা, কাশিয়ানি-গোপালগঞ্জ রেলপথসহ রেলওয়ের একাধিক অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে রেলের চলমান দুটি প্রকল্পের কাজ করছে ম্যাক্স। এর মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে ৩ হাজার ৫০২ কোটি টাকার। আর আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ প্রকল্পে চীন ও বাংলাদেশের দুই প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে ৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকার কাজ করছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
রেলের আরেক শীর্ষ ঠিকাদার তমা কনস্ট্রাকশন। দোহাজারী-কক্সবাজার ও আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ৬ হাজার ১৬১ কোটি টাকার কাজ করছে তমা।
প্রতিষ্ঠান দুটির কর্ণধার আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক ও গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর রেলের ‘গডফাদার’ এবং ‘কালো বিড়াল’ হিসাবে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তারা অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার কাজ কব্জা করেছেন। শুধু তাই নয় রেল ভবনের উচ্চ পদে নিজস্ব কর্মকর্তা বসিয়ে তারা গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। কাজ পাওয়ার পর দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বাড়িয়ে লোপাট করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। লুটের টাকার বড় অংশ ঠিকাদারি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানির নামে ভুয়া এলসি খুলে বিদেশে পাচারের অভিযোগও আছে প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে।
বিশাল এই অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের ঘটনা উদ্ঘাটনে দুই দফা অনুসন্ধান টিম গঠন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবারই প্রতিষ্ঠান দুটির কাছে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে চিঠি পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে দুদকের কাজ। তদন্ত প্রতিবেদন এখনো আলোর মুখ দেখেনি। দুদকে সেই পুরোনো ‘ভূত’ বহাল থাকায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও এদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কাজে গতি আসেনি। গণমাধ্যমের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে সত্যতাও মিলেছে। কিন্তু প্রভাবশালীদের চাপ থাকায় অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম সামছুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ম্যাক্স-তমা গ্রুপের আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি আমি নিজেই দেখেছি। মাটি ভরাটের কাজে নজিরবিহীন দুর্নীতি করা হয়েছে। এ প্রকল্পে প্রায় ১০ জন প্রকল্প পরিচালক ছিল। তারা চাপে ঠিক মতো কাজ করতে পারেনি। অনেক প্রকল্প পরিচালককে অসম্মান করে বদলি, ওএসডি করা হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললে তারা আর প্রকল্পের দায়িত্বে থাকতে পারেননি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, দোহাজারি-কক্সবাজার প্রকল্প গ্রহণের সময় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেই প্রকল্প ১৮ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু এখনও শেষ হয়নি প্রকল্পের পুরো কাজ। রেলের দুর্নীতিবাজ সব ঠিকাদার ও তাদের দুর্নীতির ভাগীদার মন্ত্রী, সচিব ও রেল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সময়।
এদিকে প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে উঠে আসা নানা রকম অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক প্রথম অনুসন্ধানে নামে ২০১৮ সালে। দুদকের সাবেক পরিচালক একেএম জায়েদ হোসেন খানকে টিম লিডার করে গঠিত ওই অনুসন্ধান কমিটি তমা-ম্যাক্স সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েল রেলপথ নির্মাণ কাজের টেন্ডার ছিনতাই ও চীনা কোম্পানি চায়না লিমিটেডের কর্মকর্তাদের অপহরণের তথ্য-প্রমাণও পায়। এরপরও তখন অনুসন্ধান আটকে যায়। তখন তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। এমনকি অনুসন্ধান নিষ্পত্তিও করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছেন, তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত সময়ে মূল কাজ শেষ করতে পারেনি। সেই সঙ্গে ধীরগতিতে কাজ করে তারা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি খরচও বাড়িয়ে নিয়েছে। এর ফলে গচ্চা গেছে সরকারি কোষাগারের শত শত কোটি টাকা।
জানা গেছে, রাজবাড়ী থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় রেললাইন স্থাপনের কাজ যৌথভাবে করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করতেই এই প্রকল্প নেওয়া হয়। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া এ প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০১০ সালে নেওয়া এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৫ বছর পর ২০১৮ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। ওই সময়ের মধ্যে তিনবার সময় বৃদ্ধির সঙ্গে নির্মাণ ব্যয় বাড়ানো হয় ৯৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ-১ হাজার ১০১ কোটি টাকার প্রকল্প গিয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকায়। শেখ হাসিনার ঘরের প্রকল্পেও (টুঙ্গিপাড়ায় রেলপথ) লোপাট করা হয়েছে অন্তত ১ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা।
১৮শ কোটি টাকার প্রকল্প হয়ে গেছে ১৮ হাজার কোটি: অনুসন্ধানে চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ভয়াবহ লোপাটের চিত্র পাওয়া গেছে বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রুটের ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ২০১৬ সালে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮শ ৩৪ কোটি টাকা। এই কাজও পায় ম্যাক্স ও তমা। এটা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্প।
অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটির কর্ণধাররা শেখ হাসিনার সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে নেন। রেলে কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী ম্যাক্স-তমার হয়ে কাজ করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ প্রকল্পের প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। তথ্য অনুযায়ী আমেরিকা, জাপান, চীনসহ উন্নত দেশেও সর্বোচ্চগতির রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে খরচ সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৮০ কোটি টাকা। দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্প নির্মাণ শেষে ওই রুটে বর্তমানে ৩টি ট্রেন চলাচল করছে। অথচ প্রকল্প সুবিধায় বলা হয়েছিল, প্রতিদিন গড়ে ২৪ থেকে ২৮টি ট্রেন চলাচল করবে।
এছাড়া তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের পরিচালকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি, প্রকল্পের কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানির নামে ভুয়া এলসি খুলে বিদেশে টাকা পাচার এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান করেছে দুদক। তবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হলেও অনুসন্ধান প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
রেলওয়ের পরিকল্পনা দপ্তরের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ম্যাক্স ও তমা রেলের গডফাদার। এরা রেলের ‘কালো বিড়াল’। প্রতিষ্ঠান দুটি নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রী-সচিবদের দিয়ে শুধু অনুমোদন করাতেন। যে মন্ত্রী-সচিব রেলে দায়িত্ব নেন-তাদের সবার ঘরের অন্দরমহলে ঢুকে যেতেন তমা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আতাউর রহমান মানিক। ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরও কম ছিলেন না। এরা এককভাবেই রেলে কাজ করেন এমনটা নয়-তারা বিভিন্ন কৌশলে নিজেদের কাজ পাওয়ার যোগ্যতা বাড়াতে চীন কিংবা অন্য দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনে রেখে ‘জয়েন্ট ভেঞ্চার’ কাজ হাতিয়ে নেন। নামে জয়েন্ট ভেঞ্চার হলেও-মূলত প্রকল্পের নিয়ন্ত্রক ম্যাক্স-তমা গ্রুপ।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে বক্তব্য জানতে তমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
প্রকাশ্যে আসা এসব অভিযোগের বিষয়ে বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, তার প্রতিষ্ঠান সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিটা কাজ করছে। রেলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাজ আর আমার ম্যাক্সের কাজে পার্থক্য রয়েছে। আমি প্রবাসী জীবন ছেড়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে চলে এসেছি। আমার সঙ্গে তমা গ্রুপের কোনো সম্পর্ক নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আখাউড়া-লাকসাম, দোহাজারি-কক্সবাজার প্রকল্পে আমরা কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি করিনি। অনেক অযোগ্য পিডি ছিল। আমরা প্রকল্প দুটি সক্ষমতার সঙ্গে শেষ করছি। আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্পে তমা গ্রুপও আছে। তমা গ্রুপ এক পর্যায়ে তার অংশটুকুর কাজ করতে পারছিল না। এতে এডিবি অর্থ ছাড় বন্ধের হুঁশিয়ারি দেয়। তখন আমি তমার অংশের কাজ শেষ করে দিই। এতে আমার কোটি কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সবই দেশের জন্য করেছি। রেলে ম্যাক্স গ্রুপ খুব দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে। এ জন্য সাবেক সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপিরাও আমার বিরুদ্ধে ছিলেন।