এখনও বহাল তবিয়তে শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত আমলারা!
মো. মাহবুব হোসেন (বাম থেকে), নাজমুল আহসান, মোহাং সেলিম উদ্দিন, মো. মোস্তফা কামাল, ফরিদ আহাম্মদ, মো. হাবিবুর রহমান, হুমায়ুন কবির খোন্দকার, গোলাম সারওয়ার। ছবি: সংগৃহীত
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। সেই সঙ্গে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। তবে ক্ষমতায় থাকাকালীন সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে আমলা তথা সচিবরা। বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো বরাবরই বিশ্বস্ত সচিবদের পদায়ন করতেন তিনি। এর মাধ্যমে মন্ত্রীদের পাশ কাটিয়ে সচিবদের মাধ্যমে চালানো হতো বিকল্প সরকার। এদের অনেকেই বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও পদোন্নতি। শুধু তাই নয় অবসরের পর বেশ কয়েকজন আমলা আওয়ামী লীগের টিকিটে করেছেন জাতীয় নির্বাচন; বনে গেছেন সংসদ সদস্য।
যদিও গত ৮ আগস্ট রাতে শপথ নেয়ার পর তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনও প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে পারেননি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একেবারেই যে সচিবালয়ে কোনো সংস্কার হয়নি এমন নয়। হাতে গোনা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে সচিবদের সরানো। তবে বেশিরভাগ সচিবই রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে প্রশাসনে নেই কোনো কর্মচাঞ্চল্য। সর্বত্রই গাঁ-ছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগ আমলাই কাজ করছেন দায়সারা ভাব নিয়ে। নিয়ম রক্ষার্থে প্রতিদিন সচিবালয়ে এলেও সময় পার করছেন ফাইল চালাচালি করে। অনেকে বিশ্বস্তদের সঙ্গে বসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজকর্মের সমালোচনা বা রাজনৈতিক আড্ডায় সময় পার করছেন।
এদিকে প্রশাসনে বহাল বেশ কয়েকজন সচিবের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা দুর্নীতির অভিযোগ। এর মধ্যে অন্যতম বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান। গত বছর ১ জুন বিদ্যুৎ বিভাগে যোগদান করেন তিনি। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি কোম্পানিরও চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান। অভিযোগ রয়েছে, নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন, উন্নয়ন প্রকল্পে কেনাকাটা, ঠিকাদার নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বিশ্বস্ত এ সচিব নানাভাবে প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক বনে গেছেন।
শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত আমলাদের মধ্যে এখনও বহাল তবিয়তে আছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে এক বছর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং দুই বছর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যদিকে আইন ও বিচার বিভাগের বিতর্কিত সচিব মো. গোলাম সারওয়ার এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত এ সচিবের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের সময় গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) অফিসে ছয়জন ছাত্র সমন্বয়ককে আটকে রাখা ও তাদের বিরুদ্ধে ডিবি প্রধান হারুনের নানা কর্মকাণ্ডের তথ্য ফাঁস হয়েছে শেখ হাসিনার পতনের দিন। গণভবন থেকে ৫ আগস্ট দুজনের তথ্য আদান-প্রদানের নথি উদ্ধার করা হয়। এছাড়া তিনি সচিব হিসেবে বহাল থাকাবস্থায় সাবেক প্রধান বিচারপতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসানও শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত। আনসার বিদ্রোহে তার মদদের অভিযোগ উঠেছিল। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তিনি ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। এর আগে তিনি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হিসেবে লম্বা সময় দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলা প্রশাসক হিসেবেও তিনি কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। মো. হুমায়–ন কবীর খোন্দকার বর্তমানে রয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দায়িত্বে। শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত এ আমলা এর আগে নির্বাচন কমিশনের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মজীবনে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টার একান্ত সচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন জেলায় ডিসি ও জেলা প্রশাসকও ছিলেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মোহাং সেলিম উদ্দিন গত ১৯ মে সচিব হিসেবে যোগ দেন। শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত এ আমলা এর আগে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
এদিকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্বরত আছেন মো. মোস্তফা কামাল। তিনি গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি পান। এর আগে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত এ আমলা। মো. মোস্তফা কামাল নবম জাতীয় সংসদে সংসদ উপনেতার একান্ত সচিব এবং পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন (বিশেষ) কমিটিতে চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব হিসেবে সহায়ক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি জীবনে তিনি জ্বালানি বিভাগ, পেট্রোবাংলা, তিতাসসহ অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় ছিলেন।
ফরিদ আহাম্মদ বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন। আনসার বিদ্রোহে তারও প্রত্যক্ষ মদদের অভিযোগ উঠেছিল। তিনি ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর বর্তমান পদে যোগদান করেন। শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত এ আমলা এর আগে দেড় বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া সামরিক ভূমি ও ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে প্রায় ৩ বছর ১ মাস দায়িত্ব পালন করেছেন। তার আগে তিনি প্রায় আড়াই বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এছাড়াও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সবিব মো. হুমায়ুন কবির খোন্দকার, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ারের নামেও রয়েছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ।
এমন প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পুরো প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো সম্ভব হয়নি। পুরোনো আমলাদের সরানো তো যায়নি বরং বিভিন্ন সংস্থায় নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রেও ঢুকে পড়ছেন হাসিনার বিশ্বস্ত অনেকেই। তবে স্বস্তির খবর হলো, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা সচিব, পররাষ্ট্র সচিবসহ বিতর্কিত কয়েকজন আমলাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে গত দুই সপ্তাহে। এছাড়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ৯ জন সচিবের চুক্তি বাতিল করে অবসরে পাঠানো হয়েছে। তবে প্রশাসনে সংস্কার প্রয়োজন। আর এই সংস্কার যত বিলম্বিত হবে তা ততই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য।