চট্টগ্রাম বন্দর
প্রথমবারের মতো ইউরোপ থেকে সরাসরি এলো কনটেইনার জাহাজ
ইতালি থেকে আমদানি পণ্য নিয়ে সরাসরি কনটেইনার জাহাজ ‘এমভি সোঙ্গা চিতা’ ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী ৬ দশমিক ২ মিটার ড্রাফটের জাহাজটি আজ ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে। ইউরোপ থেকে সরাসরি কোনো কনটেইনার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়ার ঘটনা এটিই প্রথম।
শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বন্দর বহির্নোঙরে ভিড়েছে। জাহাজটি ভিড়বে বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ২ নম্বর জেটিতে। জাহাজটিকে বহির্নোঙর থেকে জেটিতে নিয়ে আসতে সকাল সাড়ে ১১টায় পাইলট ভ্যাসেল রওনা দিয়েছে বহির্নোঙরে। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ জাহাজটি এনসিটিতে ভিড়বে বলে জানান বন্দর কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশে জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে রিলায়েন্স শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক (অপারেশন্স) জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা প্রকাশকে বলেন, জাহাজটি আজই (৫ ফেব্রয়ারি) জেটিতে ভিড়বে। এখন বন্দর বহির্নোঙরে আছে। আজ সকালেই জাহাজটি বহির্নোঙরে ভিড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, এমভি সোঙ্গা চিতা জাহাজটি ইতালির রেভেনা বন্দর থেকে ৯৪৫ টি (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে) খালি কনটেইনার এবং ৭টি গার্মেন্টস কাঁচামাল ভর্তি কনটেইনার নিয়ে গত ১৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে রওনা দিয়ে ইতালির বন্দর ত্যাগ করে। জাহাজটি আজই (৫ ফেব্রুয়ারি) জেটিতে ভিড়ার বার্থিং পাওয়ায় জাহাজ থেকে দ্রুত খালাস শেষ হবে। ফের রপ্তানি কনটেইনার নিয়ে আগামী ৭ অথবা ৮ ফেব্রুয়ারি ইতালির উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
বন্দরের পরিবহন বিভাগ সূত্র জানায়, জাহাজটি কাল পরশুর মধ্যে ১ হাজার ১০০টি রপ্তানি পণ্য ভর্তি কনটেইনার নিয়ে ইতালির বন্দরের উদ্দেশে রওনা হবে। এসব কনটেইনারে পণ্য থাকবে মোট ১৬ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ৯৮ শতাংশ তৈরি পোশাক এবং বাকি ২ শতাংশ হস্তশিল্প ও চামড়া, পাট জাতীয় পণ্য। পণ্যগুলো ইতালির রেভেনা বন্দরে পৌঁছার পর সেগুলো ক্রেতাদের চাহিদা মতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পৌঁছানো হবে।
শিপিং এজেন্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে ইতালিভিত্তিক কনটেইনার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপের রটারড্যাম, অ্যান্টওয়ার্প ও হামবুর্গের মতো মূল বন্দরে (বেজ পোর্ট) যাওয়ার আগে সিঙ্গাপুর, কলম্বো, তানজুম পালাপাস, কেলাস ও চীনের কিছু ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের আবার ইতালি যেতে হয়। এতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রপ্তানি পণ্য নিয়ে ইউরোপ পৌঁছাতে অন্তত ৪৫ দিন ব্যয় হতো। ঠিক একই ধরনের পণ্যবাহী জাহাজ সরাসরি ইতালি পৌঁছানোর কারণে সময় ব্যয় হবে ১৫ থেকে ১৬ দিন। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনারবাহী জাহাজ ইতালির বন্দরে পৌঁছাবে ১৫ থেকে ১৬ দিনে। এতে নতুন রুটে জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় পণ্য পৌছাতে সময় কমবে ২৪ দিন। পরিবহন বাবদ ব্যয়ও কমবে প্রায় ৪০ শতাংশ।
কেন দেরি হতো জাহাজ পৌঁছাতে ?
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপগামী কোনো জাহাজ সরাসরি ইউরোপের বন্দরে পৌঁছানোর সুযোগ ছিল না। এসব পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফিডার জাহাজ প্রথমে যেত ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে। এর মধ্যে আছে সিঙ্গাপুর,কলম্বো ও মালয়েশিয়ার কিছু ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর। ফিডার ভ্যাসেল থেকে ওই সব বন্দরে অবস্থানরত মাদারভ্যাসেলে (বৃহদাকার জাহাজ) করে পণ্য বোঝাই করে ইতালির বন্দরে পৌঁছানো হতো। আবার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে মাদারভ্যাসেল পাওয়া না গেলে পণ্য পরিবহন করা হতো আরেক দফা ফিডার ভ্যাসেলে কনটেইনার লোড করে। এভাবে সরাসরি পৌঁছানোর ১৫ থেকে ১৬ দিনের স্থলে লেগে যেত প্রায় ৪৫ দিন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেরিতে পণ্য হাতে পেলে ইউরোপের ক্রেতারা অসন্তুষ্ট হতো। তারা অন্য দেশ থেকে পণ্য আনা যায় কি না তা ভেবে দেখতেন। এক কথায় ইউরোপের পণ্য রপ্তানি আদেশ বাতিল হওয়ার ঝুঁকি ছিল। এ ঝুঁকি গ্রহণ করা ব্যবসায়ীদের বিশেষ পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানির অর্ডার বেশিরভাগই ইউরোপের দেশ থেকে আসা। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর ব্যবহার কঠিন হচ্ছে।
তারা জানান, এশিয়ার ছোট ছোট দেশের বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর, কলম্বো,মালয়েশিয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর ব্যবহার করে ইউরোপে পণ্য রপ্তানি হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এক সময় ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোর মাধ্যমে পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু সেই আগের চিত্র এখন নেই। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে এখন নানা সমস্যা। গত বছরের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে বাংলাদেশমুখী প্রায় ২৫ হাজার আমদানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার আটকা পড়ে। সব কনটেইনারে ছিল গার্মেন্টসের কাঁচামাল। এসব কাঁচামাল সময় মতো কারখানায় না পৌঁছায় উৎপাদন বন্ধের ঝুঁকি দেখা দেয়। আবার দেরিতে কাঁচামাল হাতে পেয়ে কারখানায় পণ্য উৎপাদন করতে দেরি হয়ে যায়। এতে সময়মতো ক্রেতার কাছেও পৌঁছানো যায়নি রপ্তানি পণ্য। এতে ব্যবসায়ীদের চরম আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। শ্রীলংকা ও মালয়েশিয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে আটকা কাঁচামাল পরে অতিরিক্ত ফিডার জাহাজ দিয়ে নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। বর্তমানে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে প্রায় সময় পণ্য জট দেখা দেয়। এখনই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রপ্তানি কিংবা আমদানি পণ্য পরিবহন শতভাগ সরাসরি করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন এমনটিই মনে করছেন তারা।
শিপিং এজেন্টরা জানান, এ রুটে আরেকটি কনটেইনার জাহাজ নিয়মিত পণ্য আনা-নেওয়া করবে চট্টগ্রাম ও ইতালির বন্দরে। ‘এমভি কেপ ফ্লোরেস’ নামে জাহাজটি মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী। এটির ড্রাফট ৮ দশমিক ৬৬ মিটার। কনটেইনার ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার ২০০টি (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে)। দৈর্ঘ্য ১৫৪ দশমিক ৪৭ মিটার ও প্রস্থ ২৫ দশমিক ১৯ মিটার।
প্রথম পরীক্ষামূলক চলাচল গত বছর
চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ইউরোপে পরীক্ষামূলকভাবে ছোট আকারের কনটেইনার জাহাজ চলাচল শুরু হয় গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর। ইতালির বন্দর থেকে খালি কনটেইনার নিয়ে আসা একটি জাহাজ এ দিন চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভিড়ানো হয়।
১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার পরিবহন শুরুর পর ইউরোপ থেকে সরাসরি কনটেইনার জাহাজ চলাচলের এটিই প্রথম ঘটনা। পরীক্ষামূলক চলাচল সফল হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর-ইতালির বন্দর সরাসরি কনটেইনার জাহাজ চলাচল শুরু হয়। আপাতত এ রুটে ২টি কনটেইনার জাহাজের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করা হবে।
এসএন