সংবাদ সম্মেলনে ক্যাপসের তথ্য
দেশের সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণ গাজীপুরে, কম মাদারীপুরে
দেশের সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণ এলাকা হচ্ছে গাজীপুর। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ। আর সচেয়ে কম বায়ু দূষিত শহর হচ্ছে মাদারীপুর, পটুয়াখালী এবং মেহেরপুর। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র(ক্যাপস) এর এক গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে।
ক্যাপস দেশের ৬৪ জেলা শহরে সাত ধরনের ভূমির ব্যবহারের উপর নির্ভর করে তিন হাজার ১৬৩টি স্থানের বস্তুকণার মান পর্যবেক্ষণ করে। এরপর সেটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদন দেয় সংগঠনটি।
বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন হলে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরেন ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামন।
এতে এই দূষণের হাত থেকে শহরগুলোকে রক্ষার জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী ১৫টি পরামর্শ দেওয়া হয়।
‘ক্যাপসের দেশব্যাপী ৬৪ জেলার বায়ু দূষণ সমীক্ষা ২০২১’-এর মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করে অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, তাদের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল তিনটি। দেশব্যাপী বায়ু দূষণের বেসলাইন তথ্য সংগ্রহ করা, জেলাগুলোর বায়ু দূষণের ক্রম এবং জেলা ভিত্তিক দূষণের মানচিত্র তৈরি করা।
এই তিনটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গত বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলা শহরে সাত ধরনের ভূমির ব্যবহারের উপর নির্ভর করে তিন হাজার ১৬৩টি স্থানের বস্তুকণা সংগ্রহ ও মান পর্যবেক্ষণ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করা হয়।
গবেষণায় সংবেদনশীল এলাকা ছিল ৫৩১টি, আবাসিক ৪৪০টি, মিশ্র ৪০৭টি, বাণিজ্যিক ৫৭৫টি, রাস্তার সংযুক্তি ৩৫৮টি, শিল্প ৪৩২টি এবং গ্রামীণ ৪২০টি এলাকা থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এসব স্থান থেকে স্বয়ংক্রিয় এয়ার কোয়ালিটি মনিটর ব্যবহার করে উপাত্ত সংগ্রহ করে পরবর্তীতে এসপিএসএস ও এআরসিজিআইএস সফটওয়্যার ব্যবহার করে বায়ু মান বিশ্লেষণ করা হয়।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, এই গবেষণা থেকে যে ফলাফল বেরিয়ে এসেছে তাতে দেখা যায় যে তিন হাজার ১৬৩টি স্থানের গড় অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫ ছিল, যা প্রতি ঘনমিটারে ১০২ দশমিক ৪১ মাইক্রোগ্রাম। দৈনিক আদর্শ মানের (৬৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে প্রায় এক দশমিক ৫৭ গুণ বেশি।
৬৪ জেলার মধ্যে শিল্প শহর হিসেবে পরিচিত গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি দূষণ পরিলক্ষিত হয়। এ জেলায় প্রতি ঘনমিটারে দূষণের মান ছিল ২৬৩ দশমিক ৫১ মাইক্রোগ্রাম। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা জেলা। এই জেলায় বায়ুমান ছিল ২৫২ দশমিক ৯৩ মাইক্রোগ্রাম। তৃতীয় অবস্থানে থাকা নারায়ণগঞ্জের বায়ুমান হচ্ছে ২২২ দশমিক ৪৫ মাইক্রোগ্রাম। এই শহরের বায়ুমান ছিল বাংলাদেশের আদর্শ মানের চেয়ে প্রায় ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি। এ জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সংস্কার কাজ, মেগা প্রকল্প, আশপাশের ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প কারখানা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানোকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ফলাফলে উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ুমান দূষণের দিক থেকে এই তিন শহরের পর চতুর্থ থেকে দশম স্থান পর্যন্ত রয়েছে যথাক্রমে হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম এবং কিশোরগঞ্জ।
আর সবচেয়ে কম বায়ু দূষণ শহর হচ্ছে মাদারীপুর। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী এই শহরের বায়ুমান হচ্ছে প্রতি ঘনমিটারে ৪৯ দশমিক ০৮ মাইক্রোগ্রাম। মাদারীপুরের পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী এবং সীমান্ত জেলা মেহেরপুর।
এর কারণে হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব এলাকায় গাছপালা এবং প্রাকৃতিক জলাধার রয়েছে। এসব এলাকায় রাস্তা সংস্কারের কাজ খুব একটা চোখে পড়েনি।
মূল প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাত ধরনের ভূমির ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণ পাওয়া গেছে মিশ্র এলাকায়। যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১১১ দশমিক ৯০ মাইক্রোগ্রাম। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বাণিজ্যিক এলাকা (১১১ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম), রাস্তার সংযুক্তি (১১০ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম), আবাসিক ও শিল্প এলাকা (১০৬ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম) এবং সংবেদনশীল এলাকায় ৯৭ দশমিক ৩ মাইক্রোগ্রাম। আর সবচেয়ে কম দূষণ পাওয়া গেছে গ্রামীণ এলাকায়, যার বায়ুমান হচ্ছে প্রতি ঘনমিটারে ৯৪ দশমিক ০২ মাইক্রোগ্রাম।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ৬৪ জেলার মধ্যে ভালো বায়ুমানের জেলাসমূহ হচ্ছে- কুড়িগ্রাম, নাটোর, জয়পুরহাট, রাজবাড়ী, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মেহেরপুর, পটুয়াখালী ও মাদারীপুর। এসব জেলায় প্রতি ঘনমিটারে বায়ুমান পাওয়া গেছে ৬৫ মাইক্রোগ্রামের নিচে।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, মধ্যম মানের দূষিত বাযুর জেলার সংখ্যা হচ্ছে ৩৬টি। এগুলো হচ্ছে- যশোর (১১১.১২ মাইক্রোগ্রাম), মুন্সিগঞ্জ (১০৩ দশমিক ৭২ মাইক্রোগ্রাম), মানিকগঞ্জ (১০১ দশমিক ৯১ মাইক্রোগ্রাম), শেরপুর (১০০দশমিক৪২ মাইক্রোগ্রাম), নেত্রকোনা (৯৯ দশমিক ৬৩ মাইক্রোগ্রাম), বরগুনা (৯৮দশমিক ৫৮ মাইক্রোগ্রাম), খাগড়াছড়ি (৯৮ দশমিক ১৭ মাইক্রোগ্রাম), সিলেট (৯৭ দশমিক ০২ মাইক্রোগ্রাম), গোপালগঞ্জ (৯৪ দশমিক ৪৭ মাইক্রোগ্রাম), নরসিংদী (৯৩ দশমিক ৬৫ মাইক্রোগ্রাম), গাইবান্ধা (৯৩ দশমিক ৩৩ মাইক্রোগ্রাম), রাঙ্গামাটি (৯২ দশমিক ০৭ মাইক্রোগ্রাম), চুয়াডাঙ্গা (৯০ দশমিক ৩ মাইক্রোগ্রাম), সুনামগঞ্জ (৮৯ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম), পিরোজপুর (৮৭ দশমিক ৯৩ মাইক্রোগ্রাম), বগুড়া (৮৭ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম), কুমিল্লা (৮৬ দশমিক ৭৭ মাইক্রোগ্রাম), মাগুরা (৮৬ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম), লালমনিরহাট (৮৬ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম), বান্দবান (৮৪ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম), নওগাঁ (৭৯ দশমিক ৪৭ মাইক্রোগ্রাম), চাপাইনবাবগঞ্জ (৭৯ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম), ঝালকাঠি (৭৭ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম), ভোলা (৭৮ মাইক্রোগ্রাম), নীলফামারী (৭৬ দশমিক ৮৭ মাইক্রোগ্রাম), শরীয়তপুর (৭৬ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম), দিনাজপুর (৭৪ দশমিক ৯৭ মাইক্রোগ্রাম), ঝিনাইদহ (৭৪ দশমিক ৫৮ মাইক্রোগ্রাম), বরিশাল (৭৩ দশমিক ৬৪ মাইক্রোগ্রাম), সাতক্ষীরা(৭২ দশমিক ৪৪ মাইক্রোগ্রাম), ফরিদপুর (৭২ দশমিক ২৪ মাইক্রোগ্রাম), বাগেরহাট (৭১ দশমিক ১১ মাইক্রোগ্রাম), রংপুর (৭০ দশমিক ১৩ মাইক্রোগ্রাম), নড়াইল ৭০ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম), কুষ্টিয়া ৭০ দশমিক ৩ মাইক্রোগ্রাম) এবং খুলনা (৬৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম)।
অতিরিক্ত দূষিত বায়ুদূষণ জেলার মধ্যে রয়েছে-হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, লক্ষীপুর, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, ঠাকুরগাঁও এবং জামালপুর। এসব জেলার বায়ু মান হচ্ছে প্রতি ঘনমিটারে ১২১ মাইক্রোগ্রাম থেকে তার উপরে।
বায়ুদূষণ রােধে ১৫ সুপারিশ
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে অঞ্চলভেদে বায়ু দূষণরোধে ১৫টি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশগুলো হলো:
স্বল্পমেয়াদে শুষ্ক মৌসুমে সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তর এর সমন্বয়ে দূষিত শহরগুলােতে প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানাের ব্যবস্থা করতে হবে।
নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও করে রাখা ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নিতে হবে।
রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা যেতে পারে।
অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে।
ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেস বিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে প্রয়ােজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।
মধ্যমেয়াদী সুপারিশের মধ্যে রয়েছে
সরকারী ও বেসরকারি উদ্দ্যোগে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদ বাগান করার জন্য সকলকে উৎসাহিত করতে হবে।
আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করতে হবে।
দূষিত শহর গুলাের আশেপাশে জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।
আগুনে পােড়ানাে ইটের বিকল্প হিসাবে সেন্ড বক্ল এর ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।
সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।
এবং দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষন স্টেশন (ক্যামস) এর ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এছাড়াও বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে।
গণপরিবহন সহ ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ু দূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য নির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করা ও ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ু দূষণের
পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা এবং পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, স্টামফোর্ড ইউনিভাসিটি উপাচার্য অধ্যাপক মাে. আলী নকি, অধ্যাপক ড. মােহাম্মদ জসিম উদ্দিন, পরিবেশ আন্দোলন নেতা শরীফ জামিল, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী, প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষ অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম, ক্যাপসের পরিচালক ও আইন উপদেষ্টা অ্যাডভােকেট মারুফা গুলশান আরা,
কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী প্রমূখ।
এনএইচবি/এসআইএইচ/