দুদকের ‘ধাওয়ায়’ বিদেশ পালিয়েছেন বেবিচকের ৭ কর্মকর্তা
ছবি: সংগৃহীত
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী মানব পাচার, টেন্ডার, নিয়োগ-বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি বেবিচকের ৩৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনিয়মের বিষয়ে অবহিত করে বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে কর্মকর্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। দুদক থেকে নিজেদের রক্ষা করতে কেউ কেউ বিভিন্ন দপ্তরে জোর তদবির চালাচ্ছেন। আবার কেউ পালিয়েছেন বিদেশে। এরইমধ্যে অন্তত সাত কর্মকর্তা-কর্মচারী দেশ ছেড়ে গেছেন।
জানা গেছে, নানা অনিয়ম করে এরইমধ্যে দেশ ছেড়ে গেছেন বেবিচকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল খালেক। তিনি প্রায় একশ কোটি টাকা হাতিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালিয়েছেন কানাডায়। আর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুজ্জামানও দেড়শ কোটি টাকা নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
এ বিষয়ে দুদকের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বেবিচকের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। নিজেদের রক্ষা করতে কেউ কেউ তদবির করছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।’
জানা গেছে, প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেবিচকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু কুমার গোস্বামীসহ ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবারও তলব করেছে দুদক। তা ছাড়া বেবিচকের নির্বাহী প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুজ্জামান, মো. মোকাব্বর আলী ও উপসহকারী প্রকৌশলী কাজী বায়েজিদ আহমেদকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেবিচকে কী কী প্রকল্পের কাজ হয়েছে তার তালিকা, এই দুই অর্থবছরে কেনাকাটা খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ, একই সময়ে নির্মাণ ও সংস্কার খাতে কত ব্যয় হয়েছে তার বিবরণ, আইটি খাতে কত বরাদ্দ ছিল এবং কী কী কাজ করা হয়েছে জানতে চেয়েছে দুদক।
মিজানুর রহমান। বেবিচকের নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তা। চাকরির আড়ালে মানব পাচারসহ নানা অপরাধ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। তা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। গত ২১ এপ্রিল মিজানের দুর্নীতির বিষয়ে দুদক চিঠি পাঠায় বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে। এই মিজানের মতোই অন্তত ৩৭ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের বিষয়ে চিঠি দিয়েছে দুদক।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকৌশল বিভাগ, হিসাব শাখা, লাইসেন্স নবায়ন শাখা, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল, সম্পত্তি শাখা, পুরনো মালামাল ক্রয়-বিক্রয় শাখা, কল্যাণ শাখায় অনিয়ম হচ্ছে। পাশাপাশি রাডার মেরামত, কেলিব্রেশন, এক্সপ্রোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম স্থাপন, বোর্ডিং ব্রিজের স্পেয়ার পার্টস ক্রয়, খান জাহান আলী বিমানবন্দর উন্নয়ন, সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নয়ন, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ, কক্সবাজার বিমানবন্দর, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ, প্যারালাল টেক্সিওয়ে, রানওয়ে সম্প্রসারণ এবং বিদ্যমান টার্মিনালের সম্প্রসারণ, কক্সবাজার বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ এবং উন্নয়ন-সংক্রান্ত মেগা প্রকল্পে অনিয়ম হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদকের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বেবিচক কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা আছে কি না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে ও তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের নামে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদ অর্জন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা-সংক্রান্ত কোনো ধরনের বিভাগীয় অনুমোদন গ্রহণ করা হয়েছে কি না তা জানতে চাওয়া হয়। তা ছাড়া সাত ধরনের প্রকল্পের কাজসহ ৯ ধরনের নথিপত্র তলব করা হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, প্রকৌশল বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নানা অনিয়মে জড়িত আছেন। আর এ কারণে তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম, কমিটির সিদ্ধান্ত, কার্যাদেশ ও পরিশোধিত অর্থের বিল ভাউচার, টার্মিনাল ভবনের ছাদে ওয়াটার প্রুফ কাজের অনুমোদিত প্রাক্কলন, দরপত্র, বিজ্ঞপ্তি (পেপার কাটিং), দাখিলকৃত দরপত্র, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সিদ্ধান্ত কার্যাদেশ, বেবিচকের কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদিত প্রাক্কলন, দরপত্র বিজ্ঞপ্তিগুলো (পেপার কাটিং), দাখিলকৃত দরপত্রগুলো, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সিদ্ধান্ত কার্যাদেশ, বেবিচকের এমটি ভবন নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদিত প্রাক্কলন, দরপত্র বিজ্ঞপ্তিগুলো (পেপার কাটিং), দাখিলকৃত দরপত্রগুলো, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সিদ্ধান্ত, কার্যাদেশ, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমপোর্ট কার্গো ভবনের পার্কিং শেড নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদিত প্রাক্কলন, বিজ্ঞপ্তি (পেপার কাটিং), ঠিকাদার কর্তৃক দাখিলকৃত দরপত্রসমূহ, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সিদ্ধান্ত, কার্যাদেশ, বেবিচকের নতুন ভবন নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদিত প্রাক্কলন ও দরপত্র বিজ্ঞপ্তি কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমার নীতি জিরো টলারেন্স। যারা অপরাধ করবে তারা শাস্তি পাবেই। দুদক যে কোনো সহযোগিতা চাইবে তাদের সবধরনের সহায়তা করা হবে। বেবিচকে শুদ্ধি অভিযান চালানো হচ্ছে। সব বিভাগে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
বেবিচক সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই বেবিচক ও বিমানের কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধান করে আসছে দুদক। কোন কোন খাতে বেশি দুর্নীতি হয় সেই তথ্য উদঘাটন করে সংস্থাটি। এর মধ্যে বেবিচকে ৩৬টি খাত নিয়ে বেশি অভিযোগ ওঠায় এসব তদন্ত শুরু হয়েছে। সেবাকে বাণিজ্য বানিয়ে কেউ কেউ অর্থ কামাচ্ছেন।
এরইমধ্যে দুদক একটি তালিকা করেছে। তালিকায় বলা হয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এয়ার কন্ডিশনার ডাক্ট স্থাপন, এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম আপগ্রেডেশন, বিমানবন্দরে কাউন্টার এবং কনভেয়ার বেল্ট স্থাপন, তার যন্ত্রাংশ সরবরাহ, নতুন বোর্ডিং ব্রিজ স্থাপন, পুরাতন বোর্ডিং ব্রিজে যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও স্থাপন, বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থানে এলইডি লাইট কেনা ও ফিটিংস, বাগান আলোকসজ্জা, এইচটি এবং এলটি সুইচগিয়ার স্থাপনকাজের নামে অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে। তা ছাড়া বিমানবন্দরের ফ্লোর মাউন্টেড এবং ওয়াল মাউন্টেড প্যানেল স্থাপন, বিমানবন্দরে বিভিন্ন সাইজের পাওয়ার কেবল সরবরাহ, এয়ারফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম স্থাপন, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, অ্যাপ্রোন লাইট ও লাইট ফিটিংস সরবরাহ, আবাসিক ভবনে ইন্টারনাল ইলেকট্রিফিকেশন কাজ, সিএএবির নতুন সদর দপ্তরের ভবনের বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট সরবরাহসহ ইএম-সংক্রান্ত কাজ, টার্মিনাল বিল্ডিংসহ বিমানবন্দরের অন্যান্য ভবনের ডেকোরেশেন-সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইএম কাজ, বিভিন্ন স্থানে অ্যাপ্রোন মাস্ট লাইট স্থাপন, সিসিআর বিল্ডিং-সংশ্লিষ্ট সব ইএম কাজ, রানওয়ে লাইটিংয়ের জন্য বিভিন্ন সাইজের কেবল সরবরাহ ও সংস্থাপন কাজেও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।
বেবিচকের কয়েকজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নানা অভিযোগ ওঠায় বেবিচকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল তৈরি করা হচ্ছে। আমাদের নিজস্ব ইন্টেলিজেন্সের পাশাপাশি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে প্রোফাইল তৈরি হচ্ছে। চাকরির তথ্যের পাশাপাশি তাদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, অপরাধ, মামলা-মোকদ্দমার তথ্য থাকবে ওই প্রোফাইলে।