৭০০ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা ‘দ্য রেলওয়ে ম্যান’ অসিম কুমার
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার। ছবি: সংগৃহীত
সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নিমির্ত ভারতীয় ওয়েব সিরিজ ‘দ্য রেলওয়ে মেন’। যেখানে দেখা যায় গ্যাস লিকের ঘটনায় ভোপাল ট্রেন স্টেশনে কর্মরত স্টেশন মাস্টার ও তার সহকারীগণ কীভাবে অনেকগুলো মানুষের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলো। ১৯৮৪ সালে মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালে ঘটে এক ট্রাজেডির গল্প। অবিকল তেমন ঘটনা এখানে না ঘটলেও মানবকল্যাণে বা মানব হিতৈষী কাজে কম যান না আমাদের ‘রেলওয়ে মেন’। বাংলাদেশেও এমন একজন রেলওয়ে ম্যানের কথা জানা গেল, যার অক্লান্ত চেষ্টা আর দূরদর্শিতায় ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পান ট্রেনটিতে থাকা সাত শতাধিক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। এই অনন্য দৃষ্টান্তটি স্থাপন করেছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার।
মঙ্গলবার (৫ মার্চ) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছিল ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা (স্নাতক)। দুপুর সাড়ে ৩টায় শুরু হওয়ার কথা এই ইউনিটের চতুর্থ ও শেষ শিফটের পরীক্ষা।
এ পরীক্ষায় অংশ নিতে সকাল ৬টায় ‘ধূমকেতু এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ওঠেন ‘সি’ ইউনিটের চতুর্থ শিফটের ৭০০ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী। কিন্তু শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে রাজধানী ছাড়তে এ ট্রেনের দেরি হয়। হিসাব করে দেখা যায়, ট্রেনটি রাজশাহীতে পৌঁছানোর কথা দুপুর ৩টায়। যথাসময়ে ছাড়লে যেটি পৌঁছাতো বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে। কিন্তু ভাগ্য এতোই খারাপ, পথিমধ্যে ধূমকেতুর ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। ট্রেনে থাকা শিক্ষার্থীরা তখন ধরেই নিয়েছিলেন, জীবনের মহা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাটা হয়তো দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু ‘দ্য রেলওয়ে ম্যান’ অসীম কুমার তালুকদারের আন্তরিকতার কারণে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান তারা।
সেদিন রাতেই রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে বিষয়টি নিশ্চিত করে একটি পোস্ট দেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক।
অসীম কুমার তালুকদার লিখেছেন, প্রায় ৭০০ ছাত্র-ছাত্রীর ‘ধুমকেতু এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ঢাকা থেকে রাজশাহীতে গিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কথা। রেল ব্রোকেনের জন্য ধুমকেতু এক্সপ্রেস ঢাকা থেকেই বিলম্বে রওনা হয়। সকাল ১১টায় হিসেব করে দেখা গেল, ট্রেনটি বিকেল ৩টা নাগাদ রাজশাহী পৌঁছুবে।
তখন থেকেই কাজ শুরু করেন অসীম কুমার। পরীক্ষার্থীদের সময়ের ব্যাপারে চিন্তা করে ধূমকেতু এক্সপ্রেসকে এগিয়ে নিয়ে আসেন অন্য কয়েকটি ট্রেনকে বসিয়ে রেখে। কিন্তু বিধি বাম! লাহেড়ী মোহনপুর স্টেশনে এসে ধূমকেতুর ইঞ্জিন ফেইল করে। ফলে ট্রেনটির চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। কী করা যায়, কী করা যায়? ভাবছেন অসীম। এভাবে কি সমাপ্তি হবে শত শত পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন? যেই ভাবা, সেই কাজ। পরীক্ষার্থীদের কথা ভেবে শরৎনগরে থাকা ‘চিলাহাটি এক্সপ্রেস’ ট্রেনটির ইঞ্জিন কেটে এনে ধূমকেতু এক্সপ্রেসে প্রতিস্থাপন করা হয়। আবার চালু হয় ট্রেনটি। কিন্তু সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। ততোক্ষণে এক ঘণ্টার মতো ‘সময়’ নষ্ট হয়ে গেছে।
হিসেব করে দেখা যায়, ট্রেনটি বিকেল ৪টায় রাজশাহী স্টেশনে পৌঁছুবে। তখন তো পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে! পরীক্ষার্থীদের লালিত স্বপ্ন কি ধূলিসাৎ হয়ে যাবে? উপায়ান্তর না দেখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তারকে পরীক্ষার সময় পিছিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানান অসীম। ট্রেন ছুটছে, দুর্বার গতিতে ছুটছে। দুশ্চিন্তাও পিছু ছাড়ছে না– পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবে তো শিক্ষার্থীরা?
আন্তরিক যোগাযোগ রাখছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও। ফোন করে জেনে নিচ্ছেন ট্রেনের খবর। সময় বাঁচাতে আড়ানি স্টেশনের স্টপেজে ট্রেন না থামানোর নিদের্শ দেন অসীম কুমার। অবশেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে ট্রেনটি পৌঁছে বিকেল ৩টা ৩৮ মিনিটে। ভিসির কাছে ‘লেট এন্ট্রি’র বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন অসীম। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলেও তাই শুধুমাত্র তাদের জন্য হলে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল আরও ২০ মিনিট।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার জানান, ঈশ্বরকে খুব একটা ডাকেন না তিনি। কিন্তু সেদিন পরীক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে, তাদের স্বপ্নের কথা চিন্তা করে তিনি ঈশ্বরকে ডাকা শুরু করেন। ছোটোখাটো মানতও করে ফেলেন। ঈশ্বর বোধহয় সদয় হলেন। তার মনোবাঞ্ছা পূরণ হলো এবং ১২৫ জন পরীক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ পেলেন। এখান থেকে একজন শিক্ষার্থীও যদি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান, তাহলে হয়তো আবার ঈশ্বরের শরণাপন্ন হবেন অসীম।
বুধবার (৬ মার্চ) ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ক প্রেস বিফ্রিংয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, দুর্ভোগ বলে কয়ে আসে না। ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ায় ঠিক সময়ে ট্রেনটি আসতে পারেনি। ওই ট্রেনে মঙ্গলবারের ‘সি’ ইউনিটের চতুর্থ শিফটের ১২৫ জনের মতো ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ছিল। পরীক্ষা শুরুর ২০ মিনিট পর পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে চাইলে মানবিক বিবেচনায় তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয় বলে জানান তিনি।
খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তোলে। প্রশংসার স্তুতি বা বাহবার পাহাড় জমে অসীম কুমার তালুকদারের নামে। তাকে বা তার এই গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণের দাবি জানান অনেক নেটিজেন।
একজন ফেসবুকে লিখেছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এডমিশন টেস্ট ছিল। ঢাকা থেকে আসা একটি ট্রেনের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। থ্যাংকফুলি পশ্চিমাঞ্চল ট্রেনের মহাব্যবস্থাপক সেটা মনিটর করেছেন। নিজে রাবি’র ভিসির সঙ্গে কথা বলে পরীক্ষায় লেট এন্ট্রির ব্যবস্থা করেছেন। অন্য ট্রেনের ইঞ্জিন ওই নষ্ট ট্রেনে সেট করে দ্রুত রাজশাহী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন। এতো কষ্ট না করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমালেও কারও কিছু করার ছিল না। একটু সহমর্মিতা, একটু আন্তরিকতা দেখিয়েছেন বলে অন্তত ৭০০ শিক্ষার্থীকে চোখের পানি ফেলতে হয়নি। তার নাম অসীম কুমার তালুকদার।
আরেকজন লিখেছেন, একটা পচে যাওয়া সময়ে অসীম যা করেছেন, তা আসলেই রেলওয়ের ইতিহাসে লেখা থাকবে। আমরাও সুর মিলিয়ে বলতে পারি– অসীম, আপনি যা করলেন, তার জন্য ইতিহাস আপনাকে মনে রাখবে। এই শত শত শিক্ষার্থীর মধ্যে কেউ যদি ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না-ও হয়, তবু আপনার ঠাঁই হবে মহাকালের অনন্ত যাত্রায়।
যেখানে অন্ধরাই চোখে বেশি দেখে, সেখানে অসীমের মতো মানুষ আসে চশমার গ্লাস হয়ে। যেসময়ে শহর পুড়ছে নরকের মতো, তখন এইসব ‘রেলওয়ে মেন’দের গল্প আমাদের কাছে দেবদূতের মতো মনে হয়। আমরা তখন পোড়া শহরে বাঁচার গন্ধ পাই। আমরা তখন নিরীহ জমির ভেতর আশার বীজ বুনতে দেখি..