অন্তত গণহত্যার স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে চায় বাংলাদেশ
পঁচিশ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি নয়, বাংলাদেশ এখন চেষ্টা করছে অন্তত গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির বিষয়টি নিশ্চিত করতে। এ লক্ষ্যেই এখন যাবতীয় কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে।
প্রথমে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়েছিল। জাতিসংঘের কাছে সরকাররে আর্জি ছিল ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির। কিন্তু ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এটি আর্মেনিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এমন স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু এই গণহত্যার কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি এখনো। অনেকে দাবি করছেন, ৯ ডিসেম্বর নয়, ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের।
তবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, আর্মেনিয়ার গণহত্যার পর জাতিসংঘ আর কোনও গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসংঘে একটি গণহত্যা দিবস আছে এবং সে কারণে ২৫ মার্চ বিশ্বব্যাপী গণহত্যা দিবস করা যাবে না। তাই যেসব রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা হয়েছে বলছে; তাদের আমরা বলছি-বাংলাদেশে আরও ব্যপক গণহত্যা হয়েছে এবং সেটিকেও স্বীকৃতি দিন।
২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘে প্রস্তাবটি তোলে আর্মেনিয়া। এ প্রস্তাবে সমর্থন দেয় ১৯৩টি সদস্য দেশ। বাংলাদেশও সমর্থন দেয়। এ কারণে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস করার কোনো সুযোগ বাংলাদেশের নাই। এমন দাবিও করতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নয়, গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়েই বাংলাদেশের মনোযোগ দেওয়া উচিত।
জানা যায়, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জেনোসাইড ওয়াচ এবং লেমকিন ইন্সটিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সংঘটিত অপরাধযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সহায়ক হবে বলে মনে করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অভিযোগ, জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পরে দশকের পর দশক জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টি চাপা পড়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে এ ব্যপারে কাজ শুরু করেন এবং সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বুকলেট প্রকাশসহ নানামুখী উদ্যোগ চলমান রয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে মূলত স্বীকৃতি আদায়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। বিদেশের বাংলাদেশ মিশনগুলোতে গণহত্যা বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত পাঠানো হয়েছে। জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের প্রতিটি দূতাবাসকে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে কাজে লাগাচ্ছে সরকার।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, আমরা ২০০৭ সালে ইউনেস্কোকে চিঠি দিয়েছি আন্তর্জাতিক গণহত্যার দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু এমন প্রস্তাব আসলে সরকারের পক্ষ থেকে যেতে হয়। ২০১৫ সালে আর্মেনিয়ার প্রস্তাবকে বাংলাদেশও সমর্থন দিয়েছে। কাজেই আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি আমরাই হেলায় হারিয়েছি।
যেসব গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ
মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হারুন হাবীব ২৫ মার্চ এক নিবন্ধে লিখেছেন, জাতিসংঘ এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রাচীন ও সাম্প্রতিক গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে। অটোমান টার্কদের হাতে ১৯১৫ সালে ১৫ লাখ আর্মেনীয় হত্যা; ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় ৮ লাখ তুতসি জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজিদের হাতে ইউরোপে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা প্রভৃতি। এছাড়া ১৯৯২ সালের বসনিয়া ও ১৯৭৫ সালের কম্বোডিয়ার গণহত্যাকেও স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে যে ৩০ লাখ বাঙালির পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ ঘটে ১৯৭১ সালে; তার কোনো স্বীকৃতি আজও দিতে পারেনি বিশ্ব সংস্থা! এমন একটি ব্যর্থতা কেবল দুঃখজনক নয়; বিশ্ব সংস্থার চরম ব্যর্থতা ও দৈন্যেরই বহিঃপ্রকাশও বটে।
এনএইচবি/এমএমএ/