প্রশাসনে বাধ্যতামূলক অবসর, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সমালোচনা
শেষ হচ্ছে ২০২২ সাল। নানা ঘটনার ঘনঘটা ছিল প্রশাসন অঙ্গনেও। বছরের শুরু থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে প্রশাসন।
অন্যদিকে, বছরের শেষ দিকে কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো নিয়েও সৃষ্টি হয় বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা।
এ বছরই প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তন এসেছে, মাঠ প্রশাসনের জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদেও এসেছে বড় পরিবর্তন। এ বছর দুবার পরিবর্তন আসে সরকারি অফিস সূচিতে। আবার চলতি বছর দফায় দফায় পদোন্নতি কর্মকর্তাদের প্রাপ্তির ঝুলিকে কেবল সমৃদ্ধই করেছে।
বড় আলোচনায় ছিল কর্মকর্তাদের নানা কর্মকাণ্ডে সমালোচনা-বিতর্ক। সরকারি কর্মকর্তাদের ‘জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস’ বাড়াতে লাইব্রেরির জন্য বই কেনার তালিকায় একজন অতিরিক্ত সচিবের ২৯টি বই স্থান পাওয়ার বিষয়টি চরম বিতর্কের জন্ম দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাসের জন্য এক হাজার ৪৭৭টি বইয়ের তালিকা করা হয়। সেই তালিকায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামেরই ২৯টি বই স্থান পেয়েছিল। সমালোচনার মুখে গত ২৯ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তখনকার সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম সাংবাদিকদের জানান, নবীরুল ইসলামের বই থাকা সেই তালিকাটি বাতিল করা হয়েছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর আলীকদম উপজেলার ২ নম্বর চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের রেপারপাড়া এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আবাসিক স্বাধীন যুবসমাজের উদ্যোগে আন্তঃইউনিয়ন ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় আবাসিক জুনিয়র একাদশ বনাম রেপারপাড়া বাজার একাদশ অংশ নেয়।
খেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউএনও মেহরুবা ইসলাম। খেলায় সমাপনী বক্তব্যে এবং পুরস্কার বিতরণ করার একপর্যায়ে ইউএনও জনসাধারণের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বিজয়ী ও রানার্সআপ দলের ট্রফি (কাপ) ভেঙে ফেলেন। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরে ইউএনও মেহরুবা ইসলামকে ঢাকায় বদলি করা হয়। এ বছর আলোচনায় ছিল এ ঘটনাটি।
বছরের এক পর্যায়ে আলোচনায় আসে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নিয়ে খবর প্রকাশের জেরে কক্সবাজারের সাংবাদিক সাইদুল ফরহাদকে দাপ্তরিক মোবাইল নম্বর থেকে কল করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন কক্সবাজারের টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কায়সার খসরু। ঘটনাটি ২১ জুলাই রাত পৌনে ১০টার। গালিগালাজের ওই অডিও রেকর্ড ফাঁস হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে তিনি প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে পার পান।
এরপর, ২৫ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, এরই মধ্যে ইউএনও কায়সার খসরুকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়েছে।
বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে গুচ্ছগ্রাম-দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে গাইবান্ধা সদরের সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুর রহমানের পদাবনতি হয়। একইসঙ্গে আত্মসাৎ করা ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮০ টাকা ফেরত দেওয়ারও নির্দেশনা জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে নানা অভিযোগে উপসচিব মো. লোকমান আহমেদকে শাস্তি দেয় সরকার। তিন বছরের জন্য তার বেতন গ্রেড নিম্নতর ধাপে নামিয়ে আনা হয়।
এ বছরেই একজন সাংবাদিককে হয়রানিমূলকভাবে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনের পর তখনকার রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দীনের শাস্তি মাফ করে দেওয়া হয়।তাকে একধাপ পদাবনতির শাস্তি থেকে অব্যাহতি দিয়ে চলতি বছরের ৭ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ ঘটনা সমালোচনার জন্ম দেয়।
বাধ্যতামূলক অবসর
চলতি বছরে মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে উপসচিব এ কে এম রেজাউল করিমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। গত ২১ নভেম্বর তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
বড় আলোচনায় আসে আর একটি ঘটনা। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠায় সরকার। গত ১৬ অক্টোবর তাকে অবসর দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এরপর থেকেই বাধ্যতামূলক অবসর নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।
পুলিশ প্রশাসনেও বাধ্যতামূলক অবসর
গত ১৬ অক্টোবর পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা মো. আলী হোসেন ফকিরকে সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। এরপর গত ১৮ অক্টোবর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী ও মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের এসপি (টিআর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরীকে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অবসরে পাঠানো হয়।
এদিকে পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. মুনির হোসেনকে অবসরে পাঠিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এরপর ৩১ অক্টোবর দুই অতিরিক্ত ডিআইজিকেও বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। তারা হলেন ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাহবুব হাকিম ও সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আলমগীর আলম। গত ২১ নভেম্বর সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে এসপি ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমানকে।
শীর্ষ পদে পরিবর্তন, ২৩ ডিসি বদলি
প্রশাসনের শীর্ষ দুটি পদে এ বছরই পরিবর্তন এসেছে। বছরের শেষ দিকে এসে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব পদে পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব পদেও।
এ বছরে গত ৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নতুন মুখ্যসচিব নিয়োগ পান প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। একই দিন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়।
গত ১১ ডিসেম্বর নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ পান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। গত ১৫ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়।
২৩ নভেম্বর মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ওইদিন রাতে ২৩ জেলার ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়। ঢাকা, কুমিল্লা, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল, বরিশাল, সুনামগঞ্জ, খুলনা, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, ঝালকাঠি, ফরিদপুর, খাগড়াছড়ি, ময়মনসিংহ, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কক্সবাজার, জয়পুরহাট ও মাগুরায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়।
চলতি বছর যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব, উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে বড় ধরনের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ৬ এপ্রিল প্রশাসনে ৯৪ জন যুগ্মসচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার।
২৯ জুন জনপ্রশাসনে ৮২ জন উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর বছরের শেষ দিকে এসে গত ২ নভেম্বর ফের ১৭৫ জন উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। গত ১ নভেম্বর প্রশাসনে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি পান ২৫৯ জন কর্মকর্তা।
অফিস সূচিতে দুবার পরিবর্তন
চলতি বছর সরকারি অফিসের সময়সূচিতে দুবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে সরকারি অফিস সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত লেনদেন আর লেনদেন পরবর্তী আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো ৬টা পর্যন্ত।
প্রথমে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গত ২৩ আগস্ট থেকে অফিসের সেই সূচিতে পরিবর্তন আনে সরকার। ওই সময়ে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত অফিস করেন সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা-কর্মচারীরা। ব্যাংক লেনদেন পরিচালিত হয়েছে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত।
পরে শীতকাল বিবেচনায় ১৫ নভেম্বর থেকে অফিসের সময়সূচিতে ফের পরিবর্তন আনে সরকার। নতুন নিয়মে সকাল ৯টায় অফিস শুরু হয়ে শেষ হচ্ছে বিকাল ৪টায়।
বিধিনিষেধে
চলতি বছরের শুরুতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ফের বেড়ে যায়। কিছুটা সময় বিধিনিষেধে কেটেছে। বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। করোনার নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’সহ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি সারাদেশে বিধিনিষেধ জারি করে সরকার, যা ১৩ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। তখন ১১টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে ২১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরে ২৪ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্ধেক জনবল নিয়ে সরকারি-বেসরকারি অফিস পরিচালনার নির্দেশনা দেয় সরকার। পরে চলমান বিধিনিষেধের মেয়াদ ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
ঘচনাবহুল বছরটি জনপ্রশাসনে বেশ অস্থিরতা বিরাজ করে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এবং অনেক কর্মকর্তার মনে আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়ে।
এনইচবি/এমএমএ/