একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভা
জামায়াত-হেফাজতের সমালোচনা ইসলামবিরোধী না
গণকমিশন প্রকাশিত শ্বেতপত্র কখনও ইসলামীবিরোধী নয়। জামায়াত-হেফাজতের জাতি ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমের সমালোচনা কখনও ইসলামবিরোধী হতে পারে না বলে দাবি করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। আজ শনিবার (২১ মে) নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশনে’র বৈঠক এ কথা বলা হয়।
সভায় বলা হয়, ‘গণকমিশনের বিরুদ্ধে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির মূল বক্তব্য হচ্ছে- বর্তমান শ্বেতপত্র ইসলামবিরোধী। আমরা এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলতে চাই- আমাদের শ্বেতপত্র কখনও ইসলামীবিরোধী নয়। কমিশনে এবং এর সচিবালয়ে ইসলামিক চিন্তাবিদ আলেম ওলামারা যেমন আছেন অন্যান্য ধর্মের নেতারাও আছেন। আমাদের শ্বেতপত্রে ওয়াজের নামে ধর্মব্যবসায়ী তথাকথিত আলেমরা ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার বিরুদ্ধে কী বলেছেন, হেফাজত-জামায়াতের নেতারা কোন কোন জঙ্গি সন্ত্রাসী বলয়ের সঙ্গে যুক্ত, কীভাবে জঙ্গিবাদের অর্থায়ন হচ্ছে, ওয়াজ ব্যবসায়ীদের আয়ের স্বচ্ছতা ইত্যাদি বিষয়ে বলা হয়েছে, যার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই।’
এতে আরও বলা হয়, ‘‘জামায়াতে ইসলামী ’৭১ সালে তাদের যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধকে ইসলামের নামে বৈধতা দিতে চেয়েছে এবং ইসলামের নামে তারা গণহত্যা ও নারীধর্ষণ করেছে। জামায়াত-হেফাজতের জাতি ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমের সমালোচনা কখনও ইসলামবিরোধী হতে পারে না। আমরা আবারও সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছি- বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য যারা ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলার ঘোষণা দিয়েছে, যারা প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে কদর্য ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছে তাদের কঠোরভাবে দমন করা না হলে তারা দেশ ও জাতির জন্য সমূহ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।’’
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মহাখালীর অস্থায়ী কার্যালয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের সদস্য রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সংসদের সদস্য রাজনীতিবিদ হাসানুল হক ইনু, শিক্ষাবিদ কলাম লেখক মমতাজ লতিফ, লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মাদ আলী শিকদার, ইসলামী চিন্তাবিদ হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান, কমিশনের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ, কমিশনের সচিবালয়ের সমন্বয়কারী কাজী মুকুল, সদস্য এডভোকেট আসাদুজ্জামান বাবু, ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী, সাংবাদিক আবু সালেহ রনি, মাওলানা হাসান রফিক, সাংবাদিক সৈয়দ নূর-ই-আলম, সমাজকর্মী শেখ আলী শাহনেওয়াজ, সমাজকর্মী মো. সাইফউদ্দিন রুবেল, সমাজকর্মী তপন দাস, সমাজকর্মী শিমন বাস্কে ও সাংবাদিক সাইফ রায়হান।
সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়- ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ শীর্ষক শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি কমিশনের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে যেমন অভিনন্দন জানিয়েছেন, এর বিপরীতে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি- বিশেষভাবে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম এবং সমচরিত্রের সংগঠনগুলো এই শ্বেতপত্রকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে কমিশনের সদস্যদের প্রতি অশ্লীল ও কদর্য ভাষায় বিষোদগার করছে।’
‘বাংলাদেশে যা কিছু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমার্থক তার প্রতি জঙ্গি মৌলবাদীদের এ ধরনের বিষোদগার নতুন কোনো বিষয় না’ উল্লেখ করে বলা হয়, ‘তারা (মৌলবাদী) যেভাবে কমিশনের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের মে মাসের মতো রাজপথে নেমে তাণ্ডবের হুমকি দিচ্ছে, যেভাবে রাস্তায় মিছিল করছে, তাতে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চলমান ধারা এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে বলে আমরা মনে করি। জামায়াতে ইসলামী ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণকমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করে মাঠে নামার পাঁয়তারা করছে। এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।’
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত কমিশন সম্পর্কে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য পর্যালোচনা করে সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়- ‘‘গণকমিশন সম্পর্কে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য বিভিন্ন দৈনিকে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কোথাও মন্ত্রীর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে তিনি বলেছেন ‘গণকমিশনের কোনো ভিত্তি নেই’, কোথাও বলা হয়েছে- ‘গণকমিশনের আইনি কোনো ভিত্তি নেই’। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার। আমরা কখনও দাবি করিনি আমাদের গণকমিশন দেশের আইন দ্বারা গঠিত কোনো প্রতিষ্ঠান। আমাদের নামেই বলা হয়েছে এটি ‘গণকমিশন’, সরকার কর্তৃক গঠিত কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এ ধরনের কমিশন নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে অতীতে বহুবার গঠন করা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক গণকমিশন বা গণআদালত বহু দেশে গঠিত হয়েছে- সমস্যা নিরসনে জনমত সংগঠনের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার জন্য। আমাদের গণকমিশনের আইনি ভিত্তি না থাকলেও এর রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি অবশ্যই আছে।’’
এতে আরও বলা হয়, ‘‘বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য ভাঙার ঘোষণা, পরবর্তীকালে বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও ম্যুরালের উপর জঙ্গি মৌলবাদীদের হামলা এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বানচালের উদ্দেশ্যে সারা দেশে জামায়াত-হেফাজতের তাণ্ডবের প্রেক্ষাপটে সরকারকে আমরা বার বার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের কথা বলেছিলাম, যা করা হয়নি। এসব হামলার জন্য মাঠ পর্যায়ের কিছু মৌলবাদী দুষ্কৃতকারীকে গ্রেফতার করা হলেও তাদের হুকুমদাতা বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন অধরা থেকে গিয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের স্বরূপ উন্মোচনের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটনে সরকারকে সহযোগিতার জন্য আমরা শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি। আমরা আশা করব যারা গণকমিশনের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ভাষায় হুমকি দিচ্ছে তাদের বিষয়ে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, কারণ তারাই বার বার বিশৃঙ্খলার হুমকি দিচ্ছে এবং কেউ কেউ ইতোমধ্যে মাঠে নেমে গিয়েছে।’’
এপি/