ব্যবসা স্থাপন দ্রুত ও স্বচ্ছ করার নিশ্চয়তা বাংলাদেশ কি দিতে পারে?
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, বাংলাদেশ কি বিনিয়োগকারীদের এই নিশ্চয়তা দিতে পারে যে এখানের ব্যবসা স্থাপন প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হয়? বুধবার (১১ মে) ঢাকায় ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম: বন্ধুত্বের ৫০ বছর’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্যে পিটার হাস এ প্রশ্ন তোলেন।
পিটার হাস বলেন, বিদেশে ব্যবসা করতে ইচ্ছুক একটি কোম্পানি অবশ্যই সেই দেশে একটি উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা, বিদ্যুত ও পানিতে সহজে প্রবেশগম্যতা এবং সু-প্রশিক্ষিত জনবল দেখতে চায়। এই চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু একটি কোম্পানি নিশ্চয়তাও চায়।
তারা যেখানে বিনিয়োগ করবে সেখানে সহজবোধ্য নীতি কাঠামো দেখতে চায় এবং তারা আইনের অব্যাহত প্রয়োগ দেখতে চায়। একটি কোম্পানি তার মেধাসম্পদের সুরক্ষার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আস্থা পেতে চায়। এছাড়াও তারা এটাও জানতে চায় যে, যদি কোন ধরনের বিরোধ তৈরি হয় তাহলে তারা আদালতের শরনাপন্ন হতে পারবে এবং আদালত কালবিলম্ব না করে দ্রুততার সাথে ও ন্যায্যতার সাথে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করবে।
বাংলাদেশ কি সততার সঙ্গে একথা বলতে পারে যে, একটি (পণ্যবাহী) কনটেইনার বাজারে পাঠানোর ক্ষেত্রে দেশটি যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ও যতোটা সময় নেয় তা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক?
বাংলাদেশ কি একথা বলতে পারে যে, প্রস্তাবিত বিধানগুলোর প্রভাব সম্পর্কে বাংলাদেশ পুরোপুরি বুঝতে পারে? উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন কী বুঝতে পারে তাদের অনলাইন বিষয়বস্তু পরিচালনা সংক্রান্ত প্রস্তাবিত আইন ডিজিটাল ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার বিষয়টিকে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করবে?
বাংলাদেশ কী একথা বলতে পারে যে এখানে পর্যাপ্ত আইনী কাঠামো রয়েছে যার অধীনে ব্যবসাগুলো পরিচালিত হবে? যখন (আমরা দেখি যে) মামলার শুনানির সময় পেতেই এখানে কয়েক বছর সময় লেগে যায়।
আমেরিকান কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমেরিকান কোম্পানিগুলো নিজেদের মতো করে খুঁজবে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপনের এই সময়ে আমি ভবিষ্যতের কথা ভেবে আনন্দিত। এবং আমি আগেও বলেছি যে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরো দৃঢ় ও সম্প্রসারিত করতে বাংলাদেশের সাথে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে চায়।
আমি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের সদস্যদের স্বাগত জানাতে পেরে বিশেষভাবে আনন্দিত। আমি নিশ্চিত যে, তারাও বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ সম্পর্ককে সম্প্রসারণে ইচ্ছুক।
সত্যি বলতে কী, আমি বুঝতে পারছি দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সকল ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো সবচেয়ে সম্ভাবনাময়।
এটা শুধু কথার কথা নয়। আমরা আমাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে কতোটা গুরুত্ব দিচ্ছি তার প্রমাণ হিসেবে এই গ্রীষ্মে বাংলাদেশস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ থেকে প্রথমবারের মতো একজন পূর্ণকালীন অ্যাটাশে-কে স্বাগত জানানো হবে। এর ফলে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে তুলবেন, সত্যি বলতে যা আরো আগেই হওয়া দরকার ছিল।
এছাড়াও, আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারিখাত ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত উপদেষ্টা সালমান এফ. রহমানের নেতৃত্বাধীন ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদলকে আগামী মাসে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চ-স্তরের অর্থনৈতিক ফোরামে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিয়েছি। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ বিভিন্ন খাতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করবে।
এক কথায় বলতে পারি, আমরা একত্রিতভাবে যে ভিত্তি গড়ে তুলেছি সেখানে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। তবে সম্পর্কের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার ক্ষেত্রে দু'টি বিষয় অবশ্যই ঘটতে হবে।
প্রথমত, আমেরিকান কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীদের অবশ্যই আরো ভালোভাবে জানতে হবে যে তাদের জন্য বাংলাদেশে কী ধরনের সুযোগ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে অবশ্যই আমেরিকান ব্যবসাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
আমি মনে করি না যে এতে আপনারা অবাক হবেন। কারণ, এটা তো ঠিক যে, বেশিরভাগ আমেরিকান কোম্পানির প্রধানরা সকালে একথা ভেবে ঘুম থেকে উঠেন না যে, হুম—আমার বোধহয় বাংলাদেশে ব্যবসা করা উচিত। তারা সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যবসা করার মাধ্যমে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখে। এখন তারা যদি আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে চায় তাহলে নিদ্বির্ধায় বলা যায় তারা সেখানেই ব্যবসা করতে যাবে যেখানকার বাজার তারা বোঝে।
মার্কিন ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ সম্পর্কে একদমই সচেতন নয় জানিয়ে পিটার হাস বলেন, তবে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলে যোগ দেওয়া ৫০ এর মতো কোম্পানি এখন জানে যে বাজার খুঁজে পাওয়ার সুযোগ নিতে বাংলাদেশের দিকে তাকানোর জোরালো কারণ রয়েছে। বাংলাদেশ তাদের মনোযোগ আকর্ষণের যোগ্য। কেন?
কারণ, প্রথমত বাংলাদেশে সামষ্টিক অর্থনীতির অগ্রগতির গল্পটা দারুণ। গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের দ্রুততম সময়ে বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই দেশের জিডিপি এমনকি কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়েও বেড়েছে এবং অর্থনীতি এই বছর ৬.৯ শতাংশ এবং পরের বছর ৭.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। দেশের অর্থ খাতের নেতৃবৃন্দ ভালভাবে ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছেন এবং তারা ধাক্কা সামলানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক রিজার্ভ আলাদা করে করেছেন।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে একটি বিশাল এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত -শ্রেণির জনসংখ্যা রয়েছে। ১৯৭১ সালে পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর কাতারে থাকা বাংলাদেশের ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটবে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি এখন ভারতের তুলনায় বেশি। ১৬ কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যা নিয়ে দেশটি এখন বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ, যেখানে যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি এবং কানাডার চেয়ে চারগুণ বেশি জনসংখ্যা রয়েছে। যে কোন কোম্পানি এখন বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারলে তাদের জন্য প্রজন্মান্তরে বিনিয়োগের লাভ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশে কর্মে আগ্রহী ও ইচ্ছুক জনবল রয়েছে। বাংলাদেশ এখন তাদের জনমিতিক সুবিধা নেওয়ার অবস্থানে রয়েছে। এই দেশের জনবল তরুণ-বয়সী এবং এখানে সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। বিজনেস কাউন্সিলের সদস্যরা তিন দিন ধরে ঢাকার রাস্তায় চলাচলের মধ্য দিয়ে দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যাপকতা বুঝতে পারবেন। এই দেশের রাস্তার প্রাণচাঞ্চল্য কারখানার উত্পাদনে ও অফিসের করিডোর পর্যন্ত প্রসারিত। কোন কোম্পানি যদি তাদের জনশক্তি তথা কর্মীবাহিনীর উপর বিনিয়োগে ইচ্ছুক হয়, তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয় ও কাজের জন্য পুরস্কৃত করে তাহলে দক্ষ ও উত্সাহী কর্মীরা তাদের জন্য আন্তরিকতার সাথে কাজ করে।
চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কোম্পানির জন্য বাংলাদেশ একটি অজানা অঞ্চল। যে কারণে তারা জানে না বাংলাদেশ তাদেরকে কী দিতে পারে। তার মানে এখানে এই বাজারে যে কোম্পানিগুলো শুরুর দিকে প্রবেশ করবে তারা পরিপক্ক বিনিয়োগ গন্তব্যগুলোর তুলনায় এখানে কম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে।
যে কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল গঠন করেছে তারা বাংলাদেশে কী ধরনের ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা আছে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে সচেতন রয়েছে।
প্রশ্ন হলো: বাংলাদেশ কী তাদের জন্য প্রস্তুত? অন্য কথায়, এই অঞ্চলের বা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ কী তাদের সময় ও সম্পদের বিনিয়োগের জন্য তুলনামূলকভাবে ভাল জায়গা? বাংলাদেশ যেহেতু মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছে, তাই বাংলাদেশ দেখতে পাবে যে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার জন্য আগ্রহী অনেক প্রতিযোগী তাদের রয়েছে।
যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির কারণ সস্তা শ্রম, কিন্তু কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে উদ্বেগগুলো আপনারা যখন মধ্যম-আয়ের দেশে পরিণত হবেন তখন বাণিজ্য সিদ্ধান্তের মূল বিষয় হয়ে উঠবে।
শ্রমিকের অধিকার এবং কাজের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগের কারণে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জেনারাইলজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্স ট্রেড বেনিফিট বা জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা হয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জানিয়ে দিয়েছে যে একই ধরনের উদ্বেগগুলোর পরিস্থিতি দ্বারা নির্ধারিত হবে বাংলাদেশ মধ্যম-আয়ের দেশ থেকে উত্তরণের পর তাদের জন্য বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত থাকবে কিনা।
এই ধরনের উদ্বেগগুলোর কারণে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বিনিয়োগ পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপমেন্ট ফিনান্স করপোরেশন বা ডিএফসি ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন নিয়ে কংগ্রেস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ডিএফসি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে মিলে জ্বালানি, স্বাস্থ্যসেবা, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও প্রযুক্তির মতো খাতগুলোতে প্রকল্প তৈরিতে কাজ করে।
ডিএফসি বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোর অর্থায়নের জন্য আদর্শ উত্স হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত যতোক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ জিএসপির জন্য যোগ্যতা অর্জন না করবে ততোক্ষণ পর্যন্ত তারা ডিএফসি-র অর্থায়নের যোগ্যতাও অর্জন করবে না। আমরা আশা করি যে, বাংলাদেশ শিগগিরই শ্রমিকদের অধিকার ও কর্মস্থলে নিরাপত্তার বিষয়ে অগ্রগতি সাধন করবে, ফলে অচিরেই দেশটি ডিএফসি-র বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য যোগ্যতা অর্জন করবে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরো বেশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে।
যেমনটা আমি শুরুতেই বলেছি যে, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দুই দেশের অংশীদারিত্বকে আরো দৃঢ় করতে বাংলাদেশের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যেতে চায়। আমি আরো বিশ্বাস করি যে, আমরা আমাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একসাথে দ্রুততম গতিতে এগিয়ে যেতে পারি। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস ডেলিগেশন আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশে সময় ও শক্তি বিনিয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাত কীভাবে ও কতোটা প্রস্তুত রয়েছে।
আরইউ/