সিজিএস গবেষণা: দুই বছরে ডিজিটাল আইনে অভিযুক্ত ২০৮ সাংবাদিক
গত ২৬ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মোট দুই হাজার ২৪৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ সময়ে ১০৮টি মামলায় ২০৮ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ৮৯০টি মামলায় আটক হয়েছেন ৮৪২ জন। শনিবার (২৩ এপ্রিল) সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘অন্তহীন দুঃস্বপ্ন-বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
ওয়েবিনারে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা কার্যক্রমের মুখ্য গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইসড প্রফেসর এবং সিজিএস-এর উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ড. আলী রীয়াজ। ওয়েবিনারে আলোচনায় অংশ নেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)- এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর এবং আর্টিকেল নাইনটিন-এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল।
গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করে গবেষণাটির মুখ্য গবেষক ড. আলী রীয়াজ জানান, এ প্রতিবেদনটি ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার অনুমোদিত প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম, অভিযুক্ত বা অভিযুক্তের পরিবার এবং তাদের নিকটজন, অভিযুক্তের আইনজীবী এবং থানা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে করা।
তিনি আরও জানান, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮৯০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২ হাজার ২৪৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৮৪২ জনকে আটক করা হয়। প্রতি মাসে গড়ে ৩৪টি মামলায় ৮৬ জনের বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ জামিন পেলেও অনেকেই এখনো জামিন পাননি। তথ্য না পাওয়ায় কতজন আটক আছে, তাও জানা সম্ভব হচ্ছে না।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, অভিযুক্ত এবং আটক ব্যক্তিদের মধ্যে স্থানীয় সাংবাদিকদের সংখ্যা বেশি। এই আইনে রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকেরা সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হচ্ছেন। ৮২০ জনের পেশার তথ্য পেয়েছি। এর মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ রাজনীতিবিদ ও ২৫ শতাংশ সাংবাদিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে এই আইনের শিকার হচ্ছেন ছাত্র ও ব্যবসায়ীরা। এই আইনে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত ১৯ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এই আইনে ১০৮টি মামলায় ২০৮ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই ১০৮টি মামলা করেছেন ৯৬ জন অর্থাৎ একই ব্যক্তি একাধিক মামলা করেছেন।
গবেষণায় দেখা যায়, পেশাগত বিবেচনায় দেখা গেছে, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মামলা ও আটকের সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া এনজিও, ছাত্র, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও ধর্মীয় নেতারা এ আইনের আওতায় ভুক্তভোগী। এমনকি পুলিশও অভিযুক্ত হচ্ছে।
বয়স বিবেচনায় দেখা গেছে–অভিযোগ, আটক ও মামলার ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে ১৮ থেকে ২৫ বছরের ৩০৩ জন, ২৬ থেকে ৪০ বছরের সবচেয়ে বেশি ৩৮৮ জন কোনো না কোনোভাবে এই আইনের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া ১৮ বছরের নিচে রয়েছে ১৯ জন এবং ৪১ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে রয়েছেন ১০৭ জন।
গবেষণায় বলা হয়েছে, অভিযোগকারীদের মধ্যে র্যাব ১৯ ও পুলিশের পক্ষ থেকে ৮৭টি অভিযোগ করা হয়েছে।
মামলা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সরকারের সমর্থনে মামলা হয়েছে ৩৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ১১১টি মামলা করেছে। আর সরকারি কর্মচারী মামলা করেছে ৪৩টি৷
ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা এই আইনের বেশি ব্যবহার করেছে উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দল-সংশ্লিষ্ট অভিযোগকারীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের ৮১ শতাংশ।
মামলা প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, যারা এই মামলাগুলো করছেন তাদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারদলীয় রাজনীতিবিদের সংখ্যাই বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তারা মোট ১৫৪টি মামলা করেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় সবচেয়ে বেশি ১২৪টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ২৯ ধারায় মামলা হয়েছে ১১৮টি।
প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননার অভিযোগে মামলা হয়েছে ৯৮টি। আর রাজনৈতিক নেতাদের অবমাননার মামলা হয়েছে ৭৫টি।
ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট বা সংশ্লিষ্ট অন্য কারণে অনেকে এই আইনের আওতায় এসেছে। মামলার সংখ্যা ৫৬৮টি। এর মধ্যে হয়রানির অভিযোগে ৫১টি, আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগে ২৯টি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে ৮৫টি এবং মতামত প্রকাশের জন্য ৩৯৯টি মামলা হয়েছে।
আলোচনা সভায় আর্টিক্যাল-১৯ এর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘আইন দরকার জনগণকে রক্ষা করার জন্য; বিশেষ কোনো দলকে সুবিধা দেয়ার জন্য নয়। সরকার সোশ্যাল মিডিয়া কন্ট্রোল করা দরকার বলে মনে করে। কিন্তু এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার। সাইবার ট্রাইব্যুনালে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের অধিকাংশের এ সম্পর্কে ধারণা নেই।’
ব্যারিস্টার তানিয়া আমির বলেন, ‘প্রথমে আইসিটি অ্যাক্ট পরে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হলো৷ আরো একটা আইন করা হবে। একের পর এক আইন করা হচ্ছে। কিন্তু আইনের মূল বিষয় পরিবর্তন হচ্ছে না। আইনে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিতে আঘাত করলে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ভাবমূ্র্তি বলতে কী বোঝানো হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। এখানে রাষ্ট্রীয় ভাবমূ্র্তি ও সরকারকে এক করে ফেলা হয়েছে। এ দুটির মধ্যে যে পার্থক্য আছে সেটা গভীরভাবে দেখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতির আঘাত এখানে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। কার ধর্ম, কার অনুভূতি, কেমন আঘাত- এ বিষয়গুলো দেখতে হবে। ইসলাম ধর্ম কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর মনোপলি না। এখানে দেখতে হবে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করলে কত জনগোষ্ঠীর ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। শুধু আইন করলেই হবে না, এসব বিষয় আগে পরিষ্কার হতে হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি জনগণের স্বার্থে নয়, শাসকদের স্বার্থে করা হয়েছে। আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আইনে ফাঁকফোকর রাখা হয়েছে অপব্যবহার করার জন্য। এই আইনের মতো আরও কিছু আইন স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করছে।’
ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার জনগণের জন্য এক অন্তহীন দুঃস্বপ্ন তৈরি করেছে। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে এই আইনে মামলা দায়েরের বিষয়ে স্বচ্ছতা নেই। গণমাধ্যমে সব মামলার খবর প্রকাশিত হয় না। এমনকি পুলিশও সহায়তা করে না। তথ্য অধিকার আইনের সাহায্য নিয়েও এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় না।’
এসএ/