ধোবাউড়া রক্ষায় সাদামাটি আহরণ বন্ধের দাবি নাগরিক প্রতিনিধিদের
রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিবিধান ও প্রটোকল অগ্রাহ্য করে ধোবাউড়ায় টিলা কেটে চলছে সাদামাটি আহরণ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বহু গুণ বেশি মাটি উত্তোলন করে সময়মতো তা অপসারণ না করতে পেরে উত্তোলনস্থলে মাসের পর মাস স্তূপ করে ফেলে রাখা হচ্ছে। আবার উত্তোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে তোলা মাটি ফেলে রাখা হয়েছে কৃষিজমিতে। এসব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মূল্যবান সাদামাটি উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, উত্তোলনের যে নানামুখী প্রভাব রয়েছে সেসব একেবারেই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। অথচ আহরণস্থলে সরকারি কোনো তদারকি নেই।
ধোবাউড়ার সাদামাটি এলাকা পরিদর্শন করে এসে শনিবার (২৩ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি নসরুল হামিদ মিলনায়তনে নাগরিক প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এসব তথ্য তুলে ধরেন। পরিদর্শন দলের বক্তব্য উপস্থাপন করেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীনের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন সংস্কৃতি কর্মী ও আদিবাসী নেতা মতিলাল হাজং, আইনজীবি ও সাংবাদিক প্রকাশ বিশ্বাস, লেখক ও সাংবাদিক নজরুল কবির, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথিন প্রমীলা প্রমুখ।
সভায় আদিবাসী নেতা মতিলাল হাজং বলেন, দূর্গাপুরে সাদামাটির উত্তোলনের ফলে অনেক আদিবাসী গারো,হাজং ও হাদি জনগোষ্ঠীর লোকজন উচ্ছেদের শিকার হয়েছে। আদিবাসীদের জমির কাগজ পত্র নাই এই হইল দোষ, টিলায় থাকে কিন্তু কাগজপত্র নাই।
আদিবাসি নেতা নু মং বলেন, ন্যায্য দাবি সরকারের আমলে নেয়া উচিত। নীতি নির্ধারকদের কাজ করা উচিত অবৈধভাবে সাদামাটির পাহাড় খননের বিরুদ্ধে।
প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, আগে সোমেশ্বরীর পানি পরিষ্কার ছিলো। কিন্তু এবার গিয়ে দেখলাম তা ঘোলা হয়ে গেছে। এমন ভাবে সেখানে বালু উত্তোলন হয় ,মনে হয় নদীর বুক-পিঠ মাংস খুবলে খুবলে খেয়ে নিচ্ছে যেনো। এরকম চলতে থাকলে আগামীতে নদীর তীরে যাদের বিশেষত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজনের বাড়িঘর নাই হয়ে যাবে।
জাকির হোসেন বলেন, আমরা দেখছি যে দূর্গাপুরের যে সৌন্দর্য ছিলো তা আজ আর নেই। সাদামাটির পাহাড় আমাদের জাতীয় সম্পদ। জাতীয় সম্পদ হলেও স্থানীয়দের জীবন জীবিকা বসবাস ইত্যাদি গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি বলেন একটা কমিটি করতে হবে যারা বালু উত্তোলন কিংবা সাদামাটির পাহাড় খননের কাজের মনিটরিং করবেন। সে কমিটিতে স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের রাখতে হবে যাতে ভারসাম্য থাকবে। যাতে করে কেউ আলাদা করে দূর্নীতি করতে না পারে।
উল্লেখ্য, গত ৮-১০ এপ্রিল ১০ সদস্যের এক নাগরিক প্রতিনিধিদল নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুরে ও ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়ায় কয়েকটি সাদামাটি আহরণস্থল পরিদর্শন এবং স্থানীয় জনজীবন ও প্রতিবেশে এর প্রভাব অবলোকন করেন। উক্ত দুটি উপজেলার কয়েকটি গ্রামে গিয়ে স্থানীয় হাজং, মান্দি ও বাঙালি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। পাশাপাশি দূর্গাপুর প্রেসক্লাবে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের সাথে মতবনিমিয় এবং নেত্রকোণা জেলা প্রশাসকের সাথেও সাক্ষাৎ করেন ।
নাগরিক প্রতিনিধি দলে ছিলেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, আইনজীবী ও সাংবাদিক প্রকাশ বিশ্বাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, সাংবাদিক নজরুল কবীর, সাংবাদিক ও গল্পকার রাজীব নূর, অনুবাদক ও সাংবাদিক মুহাম্মদ হাবীব, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী অনামিকা আহমেদ ও নাগরিক উদ্যোগের প্রতিনিধি ফারহান হোসেন জয়।
সভায় পরিদর্শনকারি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা জানান, দূর্গাপুরের তিনটি মৌজায় যেভাবে সাদামাটি আহরণ কাজ পরিচালিত হতো তার থেকে ধোবাউড়ায় খননকাজে বস্তত কোনো পার্থক্য নেই।
সাদা মাটি উত্তোলনের জন্য ধোবাউড়া উপজেলায় আরো কয়েকটি টিলা কিনে ফেলা হয়েছে, যদিও এখনও খনন শুরু হয়নি। ইতিমধ্যে সেখানকার প্রতিবেশ ও জনজীবনও একই রকম বিপন্নতার মুখোমুখি। ধোবাউড়ার ভেদীকুড়া মৌজায় সাদামাটি আহরণের ফলে, স্থানীয় আদিবাসীদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে এবং পাহাড় ও পাহাড়ী বনের উপর নির্ভরশীল হাজং, মান্দি ও অন্যান্য আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বন ও গাছপালা ধ্বংসপ্রাপ্ত, বহু বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত, জীববৈচিত্র্য বিপন্ন, পানি দূষণ, খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। কিছুদিন আগেও যেখানে খরগোশ পাওয়া যেত সেখানে আর খরগোশ নেই; খননের ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় কৃষিকাজ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে; ভারি যানবাহনের কারণে শব্দ দূষণ ও রাস্তাঘাট ভেঙ্গে পড়ার মতো ঘটনা ঘটছে। যে পাহাড় ও বন এই অঞ্চলের জানা ইতিহাসের পুরোটা সময় হাজং, গারো ও অন্যান্য আদিবাসীদের জন্য ছিল বাসযোগ্য নিজস্ব আবাসভূমি সেটাই এখন অপরিকল্পিত ও নির্বিচার সাদামাটি আহরণের ফলে ক্রমশ অবাসযোগ্য হয়ে উঠছে।
প্রতিনিধিদল সরকারের কাছে ধোবাউড়াকে রক্ষায় বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেছেন। এরমধ্যে পরিবেশগত সুরক্ষার প্রশ্ন বিবেচনায় না নিয়ে অপরিকল্পিত ও ধ্বংসাত্মক উপায়ে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ বন্ধ করতে হবে। দূর্গাপুরের তিনটি মৌজায় বন্ধ হলেও পার্শ্ববর্তী ধোবাউড়ায় তা অবাধে চলছে।
আমরা মনে করি, পুরো অঞ্চলেই এই প্রক্রিয়াটি বন্ধ করতে হবে। সাদামাটি উত্তোলনের ফলে যেসব আদিবাসী ও বাঙালি পরিবার বাস্তচ্যুত হয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ব্যক্তিবর্গের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ-প্রতিবেশগত ভারসাম্য ধ্বংসের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করতে হবে এবং দায়িদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশ ও জৈববৈচিত্র্যের সঙ্গে ভারসাম্যহীন উপায়ে যেভাবে খননকাজ করা হয়েছে এবং খননের পর বিদ্যমান কোনো প্রটোকল না মেনে সংশ্লিষ্ট জায়গা যেভাবে ফেলে রাখা হয়েছে, সেটা পুনরায় জীববৈচিত্র্যের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে এবং এর আর্থিক দায়ভার খননকারী প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে।
খননের ফলে সৃষ্ট খাদ বা খাদের পানিতে পরে বিভিন্ন সময় শিশুসহ বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আমরা মনে করি, অবিলম্বে সেখানে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে এই ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করা যায় এবং এই পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছেন সেই সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি সোমেশ্বরী নদী হতে যেভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে সেটাও পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান আইন, বিধিবিধান ও প্রটোকল মেনে চলা উচিত। বালুর ট্রাক চলাচলের ফলে দূর্গাপুরবাসী প্রতিদিন যে দুর্ভোগ ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হন তা লাঘব করার জন্য একটা বাইপাস সড়ক নির্মাণ খুব জরুরি। প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনজীবন ও প্রতিবেশের উপর যেন প্রতিকূল প্রভাব না পড়ে তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিদিন দলের সদস্যরা জানান, খনন কাজের সময় স্থানীয় পর্যায়ে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনো মনিটরিং থাকে না। মনিটরিং থাকা অত্যন্ত জরুরি। পর্যটন ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকাও খুব দরকার। মাটি উত্তোলনে নিয়োজিত শ্রমিকদের উপযুক্ত মজুরি প্রাপ্তি এবং স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য বিদ্যমান আইএলও কনভেনশন মানারও দাবি জানান তারা।
এনএইচবি/এএস