মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চার মাস পর ‘বন্দুকযুদ্ধ’

কুমিল্লায় একটি হত্যা মামলার আসামী শনিবার (১৬ এপ্রিল) গভীর রাতে র্যাবের সঙ্গে এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। গত ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটির কয়েকজন কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এর মাঝে এ ধরনের বন্দুকযুদ্ধ বা কেউ নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
র্যাব জানায়, একটি বন্দুকযুদ্ধে শনিবার রাতে মোহাম্মদ রাজু নামের এক ব্যক্তি নিহত হন, যিনি কুমিল্লায় একজন সাংবাদিককে হত্যার মামলার প্রধান আসামী। ভারত সীমান্তবর্তী কুমিল্লার আদর্শ উপজেলার গোলাবাড়ি এলাকায় এই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। গত বুধবার ওই সাংবাদিক নিহত হওয়ার পর কয়েকদিন ধরে কুমিল্লার সাংবাদিকরা নানা প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে আসছিলেন।
প্রসঙ্গত, গত ডিসেম্বরে ‘গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে র্যাব ও এর ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার চার মাসেরও বেশি সময় পর র্যাবের সাথে আবারো কথিত বন্দুকযুদ্ধে কারও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটল।
মার্কিন নিষোধাজ্ঞাপ্রাপ্ত কর্মকর্তারের মধ্যে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজির আহমেদও আছেন। বেনজির আহমেদ এখন বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর প্রধান।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য র্যাবের সমালোচনা করে এগুলো বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছিল। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে স্বাগত জানিয়েছিল এবং এরপর থেকে প্রায় চার মাস ‘বন্দুকযুদ্ধে’র আর কোনো খবর সংবাদমাধ্যমে আসেনি। কুমিল্লার ‘বন্দুকযুদ্ধে’র পর তা আবারও ফিরে এলো।
মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলেন, জনমনে ক্ষোভ বা চাপ তৈরি হলে আগেও এগুলো কিছুদিন বন্ধ থাকত। মেজর সিনহা রাশেদের ঘটনার পরেও কিছুদিন বন্ধ ছিল। তিনি আরও বলেন, ‘আসলে চাপ বা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা কঠিন। বন্ধ করতে হলে গুম বা ক্রসফায়ারের প্রতিটি ঘটনা নিরপেক্ষ তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
গত ১৩ এপ্রিল রাতে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ভারত সীমান্তের হায়দারাবাদ এলাকায় সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকারকে গুলি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে তিনি মারা যান।
মহিউদ্দিন সরকারের মা নাজমা আক্তার ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মোহাম্মদ রাজু নিহত হওয়ার ঘটনাকে স্বাগত জানিয়ে তার পুত্র হত্যার বিচার পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘খবরটা শুনে আমার মন ভরে গেছে।’ নাজমা আক্তার এ ঘটনায় যে মামলা করেছিলেন সেখানে মোহাম্মদ রাজুর সাথে মনির ও পলাশসহ আরও কয়েকজনের নাম ছিল। পুলিশ ইতিমধ্যে মনির ও পলাশকে আটক করেছে।
বন্দুকযুদ্ধ কখন কীভাবে, র্যাব যা বলছে
কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার পর কুমিল্লায় র্যাবের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, এ ঘটনায় র্যাবের একজন সদস্য আহত হয়েছে।
শনিবার রাতে আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকা গোলাবাড়িতে এ ঘটনা ঘটে বলে র্যাব -১১ জানিয়েছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমে র্যাবের যে ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে র্যাব-১১ এর কোম্পানি অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিবের বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিরা’ অবস্থান নিয়েছে খবর পেয়ে র্যাবের টহল দল গোলাবাড়ি এলাকায় অভিযানে যায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা র্যাব সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি করে। জবাবে আত্মরক্ষার্থে র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। গোলাগুলি শেষে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়।পরে জানা যায় ওই ব্যক্তি সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈম হত্যা মামলার প্রধান আসামি সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি রাজু।’
কে এই মোহাম্মদ রাজু
পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসী মোহাম্মদ রাজু কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার বিষ্ণপুর গ্রামের সাদেক মিয়ার ছেলে। তার বিরুদ্ধে থানায় আগে থেকেই একাধিক অস্ত্র ও মাদক মামলা আছে।
স্থানীয়রা জানান, রাজুর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় একটি দোকান ছিল এবং সেই দোকানের শেয়ার দেওয়া নিয়ে নিহত সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকারের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল।
এই দ্বন্দ্বে সেখানকার আরও কয়েকজন জড়িত হয়ে পড়েছিলেন যাদের সবার বিরুদ্ধেই মাদকসহ নানা অভিযোগ ছিল। এরই জের ধরে ১৩ এপ্রিল রাতে মহিউদ্দিন সরকারকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় দুই ব্যক্তি। পরে সেখানে সীমান্তে বিজিবি ফাঁড়ির কাছেই তাকে গুলি করে খুনীরা।
মহিউদ্দিন সরকার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া ইউনিয়নের অলুয়া গ্রামের মোশারফ হোসেন সরকারের ছেলে।
আনন্দ টেলিভিশনের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া দৈনিক কুমিল্লার ডাক নামে স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে স্টাফ রিপোর্টার পদে কর্মরত ছিলেন।
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নিয়ে যা বলেছিল যুক্তরাষ্ট্র
‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার’ অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর ছয় জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দফতর সেখানে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় র্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগ–আইনের শাসন, মানবাধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে হেয় করার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলছে।
বিজ্ঞপ্তিটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে, র্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ছয় শতাধিক মানুষের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী।
বিজ্ঞপ্তিতে যে ছয় জন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছিলো তারা হলেন–চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন (র্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক), বেনজির আহমেদ (সাবেক র্যাব মহাপরিচালক, জানুয়ারি ২০১৫-এপ্রিল ২০২০), খান মোহাম্মদ আজাদ (বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স), তোফায়েল মুস্তাফা সরওয়ার (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, জুন ২০১৯-মার্চ ২০২১), মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, সেপ্টেম্বর ২০১৮-জুন২০১৯), এবং মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, এপ্রিল-২০১৬-সেপ্টেম্বর ২০১৮)।
এতে জানানো হয়েছিল যে, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার জন্য বেনজির আহমেদের উপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা ঘোষণা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, যার ফলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য হবেন। তবে এ নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার।
যদিও বাস্তবতা হলো–এই নিষেধাজ্ঞার পর কয়েক মাস আর ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেনি।
আরও পড়ুন: সাংবাদিক মহিউদ্দিন হত্যা: প্রধান আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত
বিবিসি/এসএ/
