পৌরসভায় প্রশাসক নিয়োগ আইন
এমপিরা বললেন রক্তক্ষরণের আইন, মন্ত্রী বললেন বাস্তবসম্মত
পৌর পরিষদের মেয়াদ শেষ হলে পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারের প্রশাসক নিয়োগের বিধান রেখে আইন পাস করেছে সংসদ। এ আইনের চরম বিরোধিতা করেছেন বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা (এমপি)। তারা বলেছেন, এ আইন সংবিধানের মূল স্প্রিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি এটি জনপ্রতিনিধিদের রক্তক্ষরণের আইন। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, এ আইন যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত। প্রশাসক নিয়োগ অতিব যুক্তিসঙ্গত।
বৃহস্পতিবার (৩১ মার্চ) স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। সেই অধিবেশনে স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) সংশোধন বিল-২০২২ পাসের প্রস্তাব তোলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী। বিলে জনমত যাচাই ও সংশোধনী প্রস্তাব তুলে ধরে এ আইনের চরম বিরোধিতা করেন বিরোধী দলীয় এমপিরা।
বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে নির্বাচিতদের বড় অংশের কাছ জনগণ সঠিক সেবা পাচ্ছে না। বর্তমানে টিসিবির মাধ্যমে যে খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে, আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যারা দায়িত্বে আছে তারা বলছে আমাকে যারা ভোট দিয়েছেন তারা কার্ড পাবেন, যারা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তারাও বলছেন যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন তারা কার্ড পাবে, সাধারণ মানুষ সাংঘাতিক বিপর্যস্ত। এরকম একটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ৫০ বছর পর প্রত্যাশা করিনি।’
আইনের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ‘এ আইনের কী প্রয়োজনীয়তা ছিল? এ আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে আছে প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। স্থানীয় সরকার সমূহের নির্বাচনের মেয়াদ যদি শেষ হয়ে যায় নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করার দায়িত্ব সরকারের। সুতরাং সরকার যদি নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে না পারে এর জন্য দায়ী সরকার। সরকার যদি নির্দিষ্ট সময় নির্বাচন না করতে পেরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরিয়ে দিয়ে সেখানে প্রশাসক বা সরকারদলীয় লোকদের বসালে অশুভ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এটি একটি বাকশালী সিস্টেম তৈরি করার জন্য নতুন উদ্যোগ।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে জেলাপ্রশাসক ও ইউএনওরা আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি পালন করছে। জনসাধারণকে সেসব কর্মসূচীতে অংশ নিতে বাধ্য করছে। সুতরাং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে যারা ভিন্নমতের লোক রয়েছে কমিশনার ও চেয়ারম্যান তারা যদি সেসব কর্মসূচীতে না যান তাহলে তাদের আপনি বহিষ্কার করবেন। এ পরিষদ থেকে সরিয়ে দেবে সেই বিধান রাখা হয়েছে আইনে।’
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনবরত প্রশাসকদের বসার ব্যবস্থা করছে। সংবিধানের মূলনীতি অনুযায়ী, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধি বসার কথা সেখানে কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তি সেই জায়গায় বসতে পারবেন না। এটি সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক। পৌরসভাগুলো নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা নির্বাচিত হবে। এখানে অনির্বাচিত ব্যক্তিকে আমরা কেন বসাব? মামলার জুজু দেখিয়ে, মামলার ভয় দেখিয়ে প্রশাসক বসান। প্রশাসক হিসেবে ব্যক্তিরও বসার সুযোগ রাখা হচ্ছে আইনে। যে ব্যক্তি বসবেন তিনিও তো ইচ্ছা করলেই তার স্থান ধরে রাখার জন্য মামলা করে আরও দীর্ঘায়িত করবেন।’
রওশন আরা মান্নান বলেন, ‘একবার প্রশাসক বসলে পরে আর তাকে সেখান থেকে সরান যায় না, সেজন্য প্রশাসক বসাতে একটু চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।’
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে কতগুলো পৌরসভা নির্বাচন হচ্ছে না। নির্বাচন করা খুব জটিল বিষয় না, মন্ত্রী চাইলে এটা করা সম্ভব। এ জন্য আইন করার দরকার ছিল না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দিয়েই স্থানীয় সরকার চালাতে হবে এর কোনো বিকল্প করার সুযোগ সংবিধান দেয়নি। নির্বাচন না হলে কী হবে, নির্বাচন হবে না কেন? দেশে কী জরুরি অবস্থা চলছে? সারা জীবন এ সরকার যেখানে অনির্বাচিত ব্যবস্থাকে সমালোচনা করে আসছে, আর এ আইনের মধ্যে তা আমন্ত্রণ করা হচ্ছে, সুযোগ রেখে দেওয়া হচ্ছে। ব্যুরোক্র্যাট মার্শাল ল' অথবা আমলাতন্ত্রের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা জনপ্রতিনিধিদের রক্তক্ষরণের আইন হবে। সব নষ্টদের দখলে চলে যাচ্ছে। সব আমলাদের দখলে চলে যাচ্ছে, সেই ধারাবাহিকতায় আইনটি হচ্ছে। এ আইন পাস করলে গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। ’
তাদের এ বক্তব্যের জবাবে বিরোধিতা করে প্রশাসক নিয়োগের যৌক্তিকতা তুলে ধরে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক সময় অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয় তখন আইনানুগ অথবা আইন বহির্ভুত বিভিন্ন সমস্যার কারণে তখন সেখানে নির্বাচন করাটা আইনগত জটিলতা থাকে। এ সুযোগটা আমাদের কেউ কেউ হয়তো নিয়ে থাকেন। সেকারণে প্রশাসক নিয়োগ করাটা অতিব জরুরি। প্রশাসক নিয়োগ করার পর স্বয়ংক্রিয় নির্বাচন হবে, নির্বাচন তার অধীনে হবে না। নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। বাস্তবতাটা আমার মনে হয় ঠিক আছে।’
এসএম/এসএন