নিশ্চিত বিপদ জেনেও ছাত্রদের ফেলে যাননি জ্যোতির্ময়
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চালানো নির্মম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যে কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল তার মধ্যে একটি ছিল বাংলাদেশ কে পঙ্গু করে দেওয়া। যাতে এ জাতি স্বাধীনতা লাভ করলেও কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। সেই উদ্দেশে তারা গণহত্যার শুরু থেকেই বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি জান্তাদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধে যে কয়েকজন বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তাদের মধ্যে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা অন্যতম।
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার জন্ম ১৯২০ সালের ১০ জুলাই, তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের (বর্তমান বাংলাদেশ) ময়মনসিংহ জেলায়। তার পৈতৃক নিবাস বরিশাল জেলার বানারী পাড়ায়। তার বাবার নাম কুমুদচন্দ্র গুহঠাকুরতা এবং তিনি পেশায় ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। অধ্যাপক জ্যোতির্ময়কে পাকিস্তান সরকার বরাবরই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতো। একে হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছেন, তার ওপর ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পত্রিকায় কলাম লেখা বা রেডিওর অনুষ্ঠানে যাওয়া তার জন্য এক প্রকার নিষিদ্ধই ছিল।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরের যেসব জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নৃশংস হামলা চালানোর মূল নকশা করেছিল, তার একটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ছিলেন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ। তিনি নিজের পরিচিতজন, বিশেষ করে ছাত্রদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলেছিলেন।
আক্রমণের আশঙ্কার মধ্যে তাকেও নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার কথা বলা হলে স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে জ্যোতির্ময় বলেন, ‘সবাই আমাকে সাত দিন দূরে থাকতে বলছে। আমি হলের প্রভোস্ট। আমি কী করে ছাত্রদের ফেলে যাব? ওদের জন্যই তো এ কোয়ার্টার আমাকে দেওয়া হয়েছে, ফোন দেওয়া হয়েছে। আমি জানি, কিছু হলে আমাকেই আগে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।’ নিশ্চিত প্রতিকূলতা জেনেও জ্যোতির্ময় ছাত্রদের ছেড়ে যাননি।
শহীদ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা তার স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা এবং কন্যা মেঘনাগুহঠাকুরতার সঙ্গে।
স্ত্রী ও কণ্যাসহ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার আবাসিক এলাকায় ৩৪ নম্বর ভবনের নিচতলায়। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত আনুমানিক নয়টার দিকে সবাই রেডিও খুলে বুঝতে চাইছিল দেশের পরিস্থিতি। তেমন কিছুই জানতে না পেরে অধ্যাপক সাহেব পরীক্ষার খাতা দেখতে বসে যান। হঠাৎ ধুপধাপ শব্দ শুনে অধ্যাপক গুহঠাকুরতা ও তার স্ত্রী বাইরে গিয়ে দেখেন, মানুষজন গাছ, পানির ট্যাঙ্ক আর ইটপাটকেল দিয়ে যেভাবে পারছে সেভাবেই প্রতিরোধ সৃষ্টির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে অধ্যাপক গুহঠাকুরতা ফ্ল্যাটের প্রবেশপথ আটকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আবারও খাতা দেখতে বসে যান।
রাত দুইটার দিকে রান্নাঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে এক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা। শোবার ঘরে গিয়ে জ্যোতির্ময়কে অফিসার বলে, ‘আপ প্রফেসর সাহাব হ্যায়?’ জ্যোতির্ময় দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘ইয়েস’। অফিসার বলে, ‘আপকো লে যায়েগা।’ একইভাবে জ্যোতির্ময় জিজ্ঞেস করেন, ‘হোয়াই?’ উত্তর না দিয়ে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হিড়হিড় করে টেনে বাইরে নিয়ে যায় সেই ঘাতক সেনা। একই ভবনের তিনতলা থেকে বের করে আনা হয় পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক এ এন এম মুনীরউজ্জামানকেও।
একটু পরপর আটটা গুলির শব্দ হয়। অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের স্ত্রী সৈয়দা মাহমুদা জামান নিচে নেমে দেখেন, জ্যোতির্ময় তখনও বেঁচে আছেন। তার ডান ঘাড়ে ও কোমরে গুলি লেগেছে। শরীর অবশ।
মাহমুদা জামান বাসন্তীকে ডেকে আনেন। কাছেই ঢাকা মেডিকেল। কিন্তু কারফিউর কারণে তখন নেওয়া গেল না। অনেক কৌশল করে ২৭ মার্চ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় অধ্যাপক জ্যোতির্ময়কে। কিন্তু ঘাড় থেকে বুলেট বের করা যায়নি। চারদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ মৃত্যুর কাছে পরাজয় বরণ করেন ছাত্র অন্তঃপ্রাণ এ শিক্ষক।
পরিবারের মানুষেরা মৃতদেহ সৎকার করার সুযোগও পায়নি। কারণ, অধ্যাপক গুহঠাকুরতার মৃত্যুর পরপরই পাকিস্তানি সেনারা হাসপাতাল ঘিরে ফেলে। ফলে লাশ রেখেই চলে আসতে হয় তাদের। চারদিন পর পর্যন্ত লাশটি হাসপাতালেই পড়ে ছিলো। এপ্রিলের ৩ তারিখেও তাদের গাড়ি চালক ওয়ার্ডের বারান্দায় অধ্যাপক জ্যোতির্ময়ের নিথর দেহকে পড়ে থাকতে দেখেছে। এরপর অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃতদেহের কী হয়েছিলো তা আর কেউই বলতে পারেনি। তবে এক সূত্রে জানা গেছে তার মরদেহ নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মিরা।
সম্প্রতি কথাসাহিত্যিক ও জনস্বাস্থ্যবিদ শাহাদুজ্জামান এবং ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে শহীদ অধ্যাপক জ্যোতির্ময়ের স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নানাবিধ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ভুক্তভোগী হন।
তার মেয়ে মেঘনা গুহঠাকুরতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তবে শিক্ষকতা ছেড়ে এখন পুরোপুরি গবেষণায় মনোনিবেশ করেছেন। তার আগ্রহের বিষয় নারীবাদ ও সংখ্যালঘুদের অধিকার। বর্তমানে তিনি 'রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ' নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তথ্যসূত্র: ইউপিএল থেকে প্রকাশিত বাসন্তী গুহঠাকুরতা রচিত 'একাত্তরের স্মৃতি'