জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের মত
দায়মুক্তি সংস্কৃতির কারণেই সাগর-রুনী হত্যার বিচার হয়নি
দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণেই সাংবাদিক সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনী হত্যার বিচার হয়নি বলে মনে করেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের স্পেশাল প্রসিডিউরস থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একথা বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দু’জন সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ডের পর এক দশক পার হলেও এখনও কোনো বিচার হয়নি। বাংলাদেশে এক ভয়ানক ও ব্যাপক দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিরাজ করছে।
সাংবাদিক সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনীর হত্যাকাণ্ডের দশম বর্ষপূর্তিতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুসন্ধান শেষ না হওয়ার ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন করতে না পারার ব্যর্থতার কারণে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন।
সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনীকে তাদের বাড়িতে পাঁচ বছরের ছেলের সামনে ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে দুর্নীতির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে কার্যক্রম ও তা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণের কারণেই এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
২০১২ সালে উচ্চ আদালত র্যাবকে এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেন। ২৪ নভেম্বর ২০২১ তারিখে উচ্চ আদালত ৮৪তম বারের মত র্যাবকে তাদের তদন্তের ফলাফল জমা দিতে বলেন। যা এখনও সম্পন্ন হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের বিচার না হলে তা মিডিয়াকে ভয় দেখিয়ে চুপ করানোর উদ্দেশ্যে দোষীদের উৎসাহ দেয় এবং আরও আঘাত, ভীতি ও হত্যাকে ত্বরান্বিত করে, আমরা বাংলাদেশে সেই গভীর উদ্বেগের নিদর্শন দেখতে পাই।
কমপক্ষে ১৫ জন সাংবাদিক গত ১০ বছরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে বিনা বিচারে আটক, আক্রমণ, অপহরণ, অনলাইন ও অফলাইনে ভীতিপ্রদর্শন এবং আইনি হয়রানির শিকার হওয়ার অসংখ্য প্রতিবেদন পেয়েছে।
ঘটনাগুলোর তদন্ত বা বিচার হয়নি বললেই চলে। কিছু আক্রমণের ঘটনায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরাসরি জড়িত বলে ধারণা করা হয়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের গোচরে আনা অভিযোগগুলোরও প্রায়ই কোন জবাব মেলে না।
২০১২ সালে সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনীর হত্যাকাণ্ডের পর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের পাঠানো চিঠির কোনো জবাব সরকারের কাছ থেকে কখনই পাওয়া যায়নি।
২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে অভিযুক্ত শাহজাদপুরের তৎকালীন মেয়রের গুলিতে নিহত সাংবাদিক ও মানবাধিকারর্মী আব্দুল হাকিম শিমুলের মামলার বিচারকার্য বার বার বিলম্বিত হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের আওতায় মামলাটির সব আসামি বর্তমানে জামিনে আছেন।
করোনা অতিমারি মোকাবিলায় সরকারের সমালোচনা করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত হয়ে নয় মাসের প্রাক-বিচারিক আটকাবস্থায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেলখানায় মৃত্যুবরণকারী লেখক মুশতাক আহমেদের কথাও বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন।
পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হওয়া এবং অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে নিতে তিন ঘণ্টা দেরি হওয়ার পারিবারিক উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যুর ব্যাপারে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার পরিবর্তে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় গঠিত অভ্যন্তরীণ একটি তদন্ত কমিটি পরিবারের দাবির বিষয়ে তদন্ত না করেই তার মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে সাব্যস্ত করে। উদ্বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সরকারের কাছ থেকে কোনো জবাব পায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রমণ, ভীতি ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার সহজাত ঝুঁকি থেকে সাংবাদিকতা মুক্ত থাকা উচিৎ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দোষীদের বিচারের সম্মুখীন করতে না পারার সরকারি ব্যর্থতার কারণে সেটাই বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীর বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনী এবং বাংলাদেশের অন্যান্য সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সম্পূর্ণ, দ্রুত, বিশদ, স্বাধীন ও কার্যকর তদন্ত পরিচালনা ও তা সম্পন্ন করা এবং দোষীদের বিচারের সম্মুখীন করার জন্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা।
আরইউ/আরএ