স্মৃতিই হয়ে গেলেন পীর ভাই...
পীর হাবিবুর রহমান
ল্যাবএইড হাসপাতালের সিসিইউ। দরজা বন্ধ। ভেতরে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা পীর হাবিবুর রহমানের শরীর থেকে সমস্ত যন্ত্রপাতি সরাচ্ছেন। যা দিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা পীর হাবিবুর রহমান এতক্ষণ বেঁচে ছিলেন।
শনিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৫টার দিকের ঘটনা এটি।
এর কিছুক্ষণ পর রুমের ভেতর থেকে সাদা কাফনে মোড়ানো পীর ভাইয়ের নিথর দেহ ট্রলিতে করে নিয়ে যাওয়া হল লিফটের দিকে। আমরা ছুটলাম পিছু পিছু। সোজা ল্যাবএইড হাসপাতালের পুরনো ভবনের বেজমেন্টে। সেখানে লাশবাহী গাড়িতে ট্রলিটি উঠানো হল।
পীর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে তার বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী,দীর্ঘদিনের সহকর্মী, নিজ এলাকার মানুষ, কাছের দূরের সব স্বজনরা জড়ো হয়েছিলেন ধানমন্ডির সাইন্সল্যাব মোড়ের হাসপাতালটিতে। সংবাদকর্মী আর টেলিভিশন ক্যামেরার উপস্থিতি ছিল চির বিদায় নেওয়া পীর ভাইয়ের শেষ শব যাত্রার চিত্র ধারণ করার জন্য।
লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ীর ছোট দরজাটি খোলা রাখা হয়েছিল, সবাই যেন এক নজর দেখতে পারেন প্রিয় মানুষটিকে। কিন্তু সাদা কাপড়ে মোড়ানো পীর ভাইয়ের মরদেহ দেখা গেলেও মুখ দেখা যাচ্ছিল না। তারপরও স্বজন আর শুভাকাঙ্খীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল সেই স্বচ্ছ গ্লাসের উপরে।
সন্ধ্যার আকাশে সূর্য ডুবো ডুবো। এর মধ্যেই লাশবাহী গাড়িটি পীর ভাইকে নিয়ে বের হয়ে গেল হাসপাতালে বেসমেন্ট থেকে। গন্তব্য উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের বাসা। সেখানে শনিবার বাদ এশা প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হলো। রাতভর সেখানেই ছিল মরদেহটি।
রবিবার শীতের সকাল। ঢাকার আকাশে ঝকঝকে রোদ। উত্তরা থেকে রওয়ানা হয়ে শব যাত্রাটি সকাল ১১টার কিছু পর পৌঁছালো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। উদ্দেশ্য এই বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকের শেষ যাত্রায় যেন তার ভক্ত, অনুসারী, দীর্ঘদিনের সহকর্মী আর পরিচিতজনরা শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।
একঘণ্টারও বেশি সময় সেখানে রাখা হয়েছিল কফিন বন্দি মরদেহটি। ফুলে ফুলে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত পীর হাবিবুর রহমানের শব বাহী বাহনটি এবার চলে এলো তার দীর্ঘদিনের আড্ডাস্থল জাতীয় প্রেসক্লাবে।
এখানে দ্বিতীয় নামাজের জানাজা শেষে নিয়ে যাওয়া হল রিপোর্টারদের প্রাণের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি প্রাঙ্গণে। সেখানে জানাজা ও শ্রদ্ধা জানানো শেষে তৃতীয় জানাজার জন্য নিয়ে যাওয়া হল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার সর্বশেষ কর্মস্থলে।
সেখান থেকে বিকেলেই শববাহী অ্যাম্বুলেন্সটি রওয়ানা হল সেই মাটির উদ্দেশে, যেখানে তার নাড়ি পোঁতা, তার (পীর হাবিব) ভাষায় জল-জোছনার শহর, কবিতার শহর, শান্তির শহর, হাওর কন্যা সুনামগঞ্জে।
সোমবার দু’দফা জানাজা শেষে এবং প্রিয় মানুষটির প্রতি সুনামগঞ্জবাসীর শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাকে সমাহিত করা হবে পারিবারিক কবরস্থানে মা বাবার কবরের পাশে।
সুনামগঞ্জ যাওয়ার আগে পথে সিলেট শহরের চৌহাট্টায় শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সিলেটের সবস্তরের প্রতিনিধিরা।
২
আর কখনো পীর হাবিব ফিরবেন না ইট পাথরের এই শহরে। আর কখনোই মানুষের কথা লিখবেন না। মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শুনবেন না। তার কলম দিয়ে আর কখনোই রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বের হবে না। তার ভক্ত পাঠককুল আর কখনোই তার লেখার কোনো আলোচনা কিংবা সমালোচনা করবেন না, করতে পারবেন না। তার পুরোনো লেখা আর স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরেই ভক্ত পাঠককুলকে পার করতে হবে বাকিটা সময়, খুঁজতে হবে শান্তনা। প্রিয় বন্ধু-বান্ধব স্বজন প্রতিবেশী কিংবা সহকর্মীর ডাকে সাড়া দেবেন না। দেখাও দেবেন না। এই শহরে তার শূন্যতা দীর্ঘদিন অনুভব হবে।
৩
পীর ভাইয়ের সঙ্গে আমার অনেক অনেক মধুর মধুর স্মৃতি আছে। তার আগে বলে রাখি, পীর ভাইয়ের নামের সঙ্গে মফস্বল থেকেই পরিচিত। কিন্তু সামনাসামনি কখনোই দেখা হয়নি। ঢাকায় মূলধারার সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরও দেখা বা পরিচয় কোনটাই হয়নি।
২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে যোগ দিলাম দৈনিক যুগান্তরে। তখনই পীর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। প্রথম পরিচয়েই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। যেন অনেক দিনের চেনা। সেই থেকেই পীর ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক। কিন্তু যুগান্তরে তাকে বেশিদিন পাইনি।
২০১১ সালে তিনি উপসম্পাদক হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ প্রতিদিনে। তার কিছুদিন পর এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে হঠাৎ একদিন দুপুরে ফোন করলেন। বললেন, বিপুল তুই কই? বললাম, ঢাকার বাইরে আছি ভাই। বিকেলে ফিরব। বললেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আমার অফিসে আমার সঙ্গে আজই দেখা করবি।
বিকেলে ফিরেই পীর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। বললেন, তুই আমার সঙ্গে কাজ করবি। সিভি দিয়ে যাস। ঠিক আছে বলে বিদায় নিলাম।
পরদিন মেইলে সিভি পাঠিয়ে দিলাম। তারপর আরেকদিন পীর ভাইয়ের ফোন, দ্রুত আমার অফিসে আয়। যেতেই তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন শাহজাহান সরদার ভাইয়ের কক্ষে। শাহজাহান ভাই তখন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক।
আমাকে দেখে শাহজাহান ভাই নানান কথা জিজ্ঞেস করলেন। এক পর্যায়ে পীর ভাই বললেন, শাহজাহান ভাই বিপুলকে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে সচিবালয় বিটে নেওয়া যায়। ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী তাকে ... বেতন দিয়েন।
এরপর আমি চলে আসলাম। তার কয়েকদিন পর ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে ফোন। আপনার একটা চিঠি আছে। ওই দিনই গেলাম পত্রিকা অফিসটিতে। নিয়োগপত্র নিয়ে আসলাম। পরদিন ১৮ এপ্রিল যুক্ত হলাম পীর ভাইয়ের সঙ্গে। তারপর টানা নয় বছর নয় মাস ১২ দিন ছিলাম। পীর ভাইয়ের ছায়ায়। যদিও মধ্যে এক বছর পীর ভাই ছিলেন না পত্রিকাটিতে।
এই দীর্ঘ সময়ে পীর ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অনেক নিউজের আইডিয়া পেয়েছি। আবার আমি অনেক নিউজ নিয়ে যখন তার সামনে হাজির হয়েছি। ঘটনা শুনে লাফিয়ে উঠেছেন। বলেন, দারুণ রিপোর্ট। এটা হিট হবে, কিংবা এটা লিড করা যাবে।
৪
একবার একটি রিপোর্ট লিখেছিলাম একজন মন্ত্রী, একজন সচিব ও একটি সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিয়ে। তাদের বিদেশ ভ্রমণ আর নারী প্রীতি নিয়ে। রিপোর্টের কাহিনী বলতেই পীর ভাই বললেন, ভালো করে লেখ। এটা বক্স আইটেম করব। দেখবে এই রিপোর্ট হিট হবে। সত্যিই পরদিন রিপোর্টটি বক্স আইটেম হিসেবে প্রথম পাতায় তিন কলামে ছাপা হয়েছিল।
রিপোর্ট প্রকাশের পর কত কত ফোন। এক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বললেন, ভাই আগামী ৬ মাস আপনি আমার মন্ত্রণালয়ের ধারের কাছেও আসবেন না। কেন, কেন? জিজ্ঞেস করতেই বললেন, রিপোর্ট লিখলেন আপনি। আর মন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই আমাকে দায়ী করছেন। বলছেন, আমি নাকি তথ্য দিয়েছি। আপনার সঙ্গে তো গত একমাসেও আমার দেখা হয়নি। শুনে বললাম, ভয় পাইয়েন না। আমি আপনার আশপাশেও আসব না।
আরেক কর্মকর্তার পক্ষে একজন অফিসে ফোন করলেন। আর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমার ওই সময়ের সহকর্মী মতিন আব্দুল্লাহকে বললেন, আপনাদের রিপোর্টার তো আমাকে শেষ করে দিয়েছে। এসব ঘটনা দারুণ এনজয় করেছিলাম।
৫
এমন আরও অনেক অনেক স্মৃতি আছে। অন্য কোনো সময় লেখার চেষ্টা করব। লেখাটি শেষ করতে চাই পীর ভাইয়ের অন্তিম যাত্রায় তার জন্য শুধু প্রার্থনার মধ্য দিয়ে।
অসময়ে চলে যাওয়া পীর ভাই ওপারে ভালো থাকবেন।
আরএ