গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না: মাহফুজ আনাম
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেছেন, ‘গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। গণতন্ত্রকে হত্যা করা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী বলে মনে করি।’
‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস: ডিজিটাল নজরদারিতে সাংবাদিকতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। শনিবার ১৪ মে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনের চামেলী হাউজে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে সম্পাদক পরিষদ।
মাহফুজ আনাম বলেন, ‘সাংবাদিক ও গণমাধ্যম দমনে এত আইন কেন? আমরা এমন কি করি যার জন্য এত আইন দিয়ে আমাদের বেঁধে দিতে হবে ? চলমান পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতা পেশাকে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সাংবাদিক দমন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণে তৈরি আইন যদি সংশোধন না হয় তাহলে আমাদেরকে তা বাতিলের পথে যেতে হবে।’
‘আইন তৈরিতে যেমন স্বচ্ছতা নেই, সরকারেরও স্বচ্ছতা নেই’ দাবি করে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমরা এ দেশকে ভালোবাসি, বাংলাদেশের উন্নতি অগ্রগতি চাই। এত প্রতিবন্ধকতার পরও আমরা সাংবাদিকতা করে যাচ্ছি। অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা, সাংবাদিকদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি ও সুরক্ষায় যথাযথ চেষ্টা অব্যাহত রাখবে সম্পাদক পরিষদ। অচিরেই আমরা এ বিষয়ে একটি কাঠামোর প্রস্তাব তৈরিতে উদ্যোগ নেব।’
সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি একে আজাদ বলেন, ‘সংবাদপত্র জগত এখন সংকুচিত। নজরদারি বৃদ্ধি পাচ্ছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন একাংশের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘আমি আইনি, বেআইনি- নতুন আইন তৈরিতে কোনো প্রকারভাবে সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করছে কিনা এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট একটি কাঠামো দাঁড় করার জন্য সম্পাদক পরিষদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। এই বিষয়ে আমাদের সম্মিলিতভাবে একটি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ সাংবাদিকরা এককভাবে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারবে না, সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমরা যদি নীতি-নৈতিকতা বজায় রেখে ভালো সাংবাদিকতা করি তাহলে নাগরিক সমাজও সম্পৃক্ত হবে বলে আশাবাদী।’
তিনি বলেন, ‘দেশে ৫০ বছরে একজন সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় নাই। আইনের প্রয়োজন আছে তবে বিচারিক প্রয়োগের ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা দরকার আছে।’
‘টেলিভিশন সাংবাদিকতার জন্য কোন আইন নেই ফলে আইনগত ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। যে আইন রয়েছে তার যখন প্রয়োজন পড়ে তখন ব্যবহার করা হচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।
নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবির বলেন, ‘দেশে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা সমস্যা শতভাগ রাজনৈতিক সমস্যা, এটা সবার বোঝা দরকার যদি আমরা এর সমাধান করতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘কোনো সরকারের আমলেই গণতন্ত্র নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। অবরুদ্ধ থেকে মুক্তির জন্য রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লড়াই সংঘবদ্ধভাবে করা দরকার।’
ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘লিখতে পারি কিন্তু যা লিখতে চাই তা পারছি কি না সেটাও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্ত সাংবাদিকতা করতে চাই, সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভক্ত হলেও সবাইকেই সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সরকার যতদিন খুশি থাকুক তাতে সমস্যা নাই। আমরা মুক্ত গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার সুষ্ঠু পরিবেশ চাই।’
নবম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নে সম্পাদক পরিষদের নেতাদের কাছে দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (একাংশ) সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, ‘সরকার নজরদারি করে আর আমরা যদি নীতি নৈতিকতায় টিক না থাকি তাহলে সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে না। সাংবাদিকতা ও রাজনীতি পাশাপাশি জড়িত হওয়ার ফলে সমস্যার সম্মুখীন, যারা সংগঠনের কর্মীদের রুটি রোজগারে সোচ্চার সেই আমরাই বিভক্ত।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন আরেক অংশের সভাপতি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা উপজেলা পর্যায়েও মাঠের সাংবাদিকদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না বলেই এই দেশে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি কাদের গণি চৌধুরী বলেন ‘কণ্ঠরোধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮। এটি সাংবাদিকসহ দেশের মানুষকে ভয় দেখানোর ফাঁদ। সবচেয়ে বড় সংকটে বাক স্বাধীনতায়। এটাকে আমি আইন বলতে চাই না। সভ্য সমাজে এই কালো আইন ও অসভ্য আইন বাতিলের দাবি জানাই।’
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়ার পরও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮ আইন পাস করেছে। ফলে অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা।’
তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রয়োজন আছে তবে সেই আইন যুগ উপযোগী করতে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের জন্য করা হয়রানিমূলক ধারাগুলো পরিবর্তন করতে হবে।’
এমএইচ/এপি