কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার তিনটি কবিতা
মানুষবাঙ্গালী
মানুষ আমরা বাঙালি আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে,
মানুষবাঙালি মুক্তস্বাধীন শতশতাব্দী শেষে;
অমিতসাহসী প্রমিতবাঙালি শেখ মুজিবের বেশে।
নিকষিত যার মানবস্বরূপ মা-সায়েরার ঘরে,
বিকশিত তার রূপ অপরূপ শতশতাব্দী ধরে;
মুক্তিযুদ্ধে শহিদেরা প্রাণ দিয়ে গেলো অকাতরে।
এই বাংলার মাটি পরিপাটি সোনার চেয়েও খাঁটি,
ঘুমায় বাঙালি এ মাটির বুকে বিছিয়ে শীতলপাটি;
নাই নাই ভয়, আছে শুধু জয়, জয় দুর্জয় ঘাঁটি।
গোলাভরা ধান মাঠভরা গান শস্যের সমাহার,
শান্তিসুখের এই বাংলায় সম্প্রীতি বেশুমার;
উদয়শপথে কাটে পথে পথে মনের অন্ধকার।
শুরুর আগেও শুরু থেকে যায়, যায় না সহজে চেনা,
বর্তমান ও অতীতের মাঝে কত সেতু-লেনাদেনা;
অনাদিকালের পারানির কড়ি সম্বল বেচাকেনা।
ইতিহাস শুরু লিখিত যখন, তারো আগে ইতিহাস,
গুহা ছেড়ে ঘরে পললভিটায় বঙ্গজাতির বাস;
ঋতুতে ঋতুতে রীতিতে রীতিতে সব ফসলের চাষ।
রাঢ় হরিকেল বন উপবন সমতট আসমান,
মিলেছে এখানে নদীদিগন্ত মোহনায় ধাবমান;
ওড়ে প্রজাপতি, পরিযায়ী ডানা, আলপথ বহমান।
কত পথ শেষে কত দিক থেকে পথিক মিলায় বুক,
বাংলামায়ের স্নেহশীলা বুকে ব্যাকুল আপন মুখ;
জগৎমানুষ মিলেছে এ বুকে, মিলনেই মূল সুখ।
মিলিতবাঙালি প্রমিতবাঙালি ঘর তার চরাচর,
কাঁটাতারহীন বিশ্বরাষ্ট্রে সব ঘর তার ঘর;
পরস্পরের পরমাত্মীয়, কেউ নয় কারো পর।
মিলিতবাঙালি বিজয়ী বাঙালি বিশ্বমানুষ আজ;
সব দেশ তার আপন স্বদেশ, মাথায় মুক্তি-তাজ।
জন্মস্মর
ইতিহাসে ইতিহাসে পরিশ্রুত এই দেশ, বাংলাদেশ,
আদি আর অনন্তের দেশ;
তুমি হেঁটে যাচ্ছো তার পথে পথে,
আলপথে, বনপথে, মনোপথে,
মৌনমগ্ন পথিকের বেশে...
তোমার গমনপথে রঙধনু, কাশফুল, পদ্মাগঙ্গা, তরঙ্গ অশেষ;
তুমি গণবাঙালির মনোকন্যা, চিরকাল বাঙালিকে ভালোবেসে।
পিতার আলোক আর মাতার আশীষ, জাতিমানুষের বহতা মমতা;
অভেদ-সাম্যের দেশে চাষ করো পলিবীজ, সর্বশস্য, মানব-সমতা;
বাঙালি প্রমু্ক্ত জাতি,
ধর্মবর্ণ-সম্প্রদায়-নির্বিশেষে
সুন্দরের নিরপেক্ষ ধ্যান;
জাতিতে জাতিতে সখ্য, তুমি সেই ঐক্য-সূত্র, মানবিক সুন্দরের ঘ্রাণ।
তোমাকে চিনেছে এই বিলঝিল,
নভোনীল, শঙ্খচিল,
বহমান নদীর স্বীকৃতি,
মুহূর্ত অনন্ত হয়ে কাল থেকে কালান্তরে সর্বপ্রজন্মের স্মৃতি;
তেপান্তর পার হয়ে জনপদে রাজপথে পরিব্যাপ্ত তোমার ঠিকানা;
দেশ আর মহাদেশ পার হয়ে ভাষা আর বিশ্ববাংলা বাঙালির ডানা।
তুমি সেই ডানার বিস্তার,
তুমি সেই জাতক অপার:
তোমাকে পাহারা দেয় জলেস্থলে নভোতলে জয়-বাংলা,
বিজয়ীর কলস্বর, স্মৃতিস্মর নদী মধুমতি;
তুমি সেই জন্মস্মর, চিরজন্মে চিরবঙ্গে তোমার বসতি।
বঙ্গজাতিমাতা
তুমি মাতা, আদিমাতা হাওয়ার সুরত,
মা মরিয়ম আমিনার প্রদর্শিত পথ;
সন্তানকে বুকে ধরে যাও দশ দিকে,
বংশগোত্রজাতিসত্য নিজে নাও শিখে;
আদিবঙ্গ জনপদ, ব্রত, সদাচার,
লালন করেছো তুমি সমাজ-সংসার;
প্রবিশ্ব পড়েছে বাঁধা চাবির গোছায়,
মাঝির নোঙর তুমি বঙ্গের নৌকায়।
বঙ্গ যদি দেশ তবে জনগোষ্ঠী জাতি,
জগৎ জুড়িয়া আছে স্বজাতির জ্ঞাতি;
তুমি বুকে ধরে আছো সকলের বুক,
জাতিসন্তানের সুখে খোঁজো নিজ সুখ।
সংকটে সংশয়ে তুমি জাতিজ্ঞাতি ত্রাতা;
হে জননী হে ধরণি বঙ্গজাতিমাতা।