কবি কামাল চৌধুরীর তিনটি কবিতা
বিজয় দিবস
আত্মসমর্পণের আগে যে কলমে নি:শেষিত কালি
তার নাম চূড়ান্ত পরাজয় ।
এই দৃশ্য সাধারণ নয় । কেননা এই দৃশ্যে
স্বাধীনতাকামী মানুষের সাথে পাখিরাও জয়োল্লাস করে
কেননা যে গুলিতে লক্ষ লক্ষ প্রাণ ঝরে যায়
সেখানে রক্তজবার রঙে লেখা হয় ঘৃণা ও উল্লাস ।
কেননা আমরা আজ নির্বাসন থেকে ফিরে আসা
গগনবিদারী শ্লোগান
আমরাও যুদ্ধের শেষে হয়ে গেছি সার্বভৌম পাখির পালক
আমরাও রক্তগঙ্গায় ভেসে থাকা নিজভূমে
পরবাসী স্বজনের লাশ
আমাদের দারুণ ক্রোধে ফিরে আসছে
গিন্সবার্গের শরণার্থী কবিতা ।
আমরা বদ্বীপের লোক
আমরা ভাত ও মাছের স্বপ্নে বেঁচে থাকি
আমরা মুজিবের লোক
আমাদের বারুদগন্ধ মিশে আছে পতাকার রঙে
ত্যাগ ও মহিমাভাষায়-
যে যুদ্ধ ভালোবাসার
সেখানে পরাজয় নেই
সেখানে বিজয়ী জাতির রক্তে প্রতিদিন ভোর আসে
প্রতিদিন সূর্যোদয়ে
আত্মসমর্পণ করে হানাদার।
নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণ লিখছে
গণহত্যার হাতে নিয়জি যখন আত্মসমর্পণ লিখছে
তখন অনুভব করা যাচ্ছিল তার কম্পন
নিয়াজি তখন নিঃসঙ্গ ও বিধ্বস্ত
না কলম, না আগ্নেয়াস্ত্র, না মাতাল ইয়াহিয়া, না ভুট্টো
কেউ তার সঙ্গী নয়
অদূরে দাঁড়ানো হানাদার পাকিস্তানি সেনারা স্তব্ধবাক
তাদের চোখ নতমূখী, তাদের হন্তারক আঙুলও অসাড়
চতুর্দিকে টানটান উত্তেজনা
ঐতিহাসিক মুহূর্তের অপেক্ষায় মুক্তিকামী জনতা
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও যৌথ কমান্ডের সৈনিকেরা
শেষ দৃশ্যে নিয়াজি কলম তুলে নিল
কাঁপা হাতে লিখল চূড়ান্ত পরাজয় ।
এই দৃশ্যে রেসকোর্স মাঠে বদলে গেল বাংলার আকাশের রঙ
আমরা ফিরে আসলাম মৃতদের দেশ থেকে
দীর্ঘ পরবাস, রাতজাগা নির্বাসন শেষে,
কাঁধে সহযোদ্ধার লাশ, হাতে রাইফেল
মৃত্যুঞ্জয়ী উল্লাসে 'জয় বাংলা', 'জয় বাংলা' বলে
আমরা ফিরে আসলাম-
তখন রেসকোর্স মানে স্বাধীনতা
তখন রেসকোর্স মানে সার্বভৌম জাতির পতাকা
তখন রেসকোর্স মানে বিজয় উৎসব।
এই দৃশ্য আজ নদীস্রোতে, বহমান জলে লেখা
এই দৃশ্য লেখা আছে বর্ণমালার রঙে, লাল ফুলে
এই দৃশ্য শহীদ মিনার, এই দৃশ্য স্মৃতিসৌধ
এই দৃশ্য বধ্যভূমিতে স্বজনের স্মৃতিমুখ
এই দৃশ্য আমার সোনার বাংলা
এই দৃশ্য বজ্রকণ্ঠ, মুজিবের সাহসী তর্জনী
এই দৃশ্য চির উন্নত মম শির-
আমরা হারিনি। এই দৃশ্য বিজয়ী জাতির।
পতাকা
তোমাকে আমার পাঠশালা মনে হয়
যেখানে আমরা ধূলি, কাদামাটি শিখি
আলপথ থেকে শহীদ মিনারে এসে
বাংলা বানানে প্রিয় নীলাকাশ লিখি।
অ-আ-ক-খ স্মৃতি, বৃষ্টি ও ভাঁটফুলে
রাতে চাঁদ আসে; ডাক নাম ধরে ডাকে
ভাইবোন মিলে শীত তাড়াবার গানে
আগুন জ্বালিয়ে বুকের ভেতরে রাখে।
আমরা সবাই মাঠে জড়ো হই, মাঠে
হাতে চকখড়ি; মাটি ভেজা ইতিহাসে
বারুদের ঘ্রাণ, গণকবরের ছবি
ফুলের যুদ্ধ, লেখা থাকে সিলেবাসে।
তোমাকে আমার পাঠাশালা মনে হয়
দিবা পাঠক্রমে, নিশিকালে পাই মা-কে
প্রেম লিখি, ধান, রবি-গান, শ্যামা পাখি
বাংলা বানানে লিখে রাখি পতাকাকে।