বঙ্গবন্ধু
বাইগার নদীর কোলঘেঁষে সবুজ শ্যামল গাঁ টুঙ্গিপাড়া
কোকিল দোয়েল ঘুঘু ডাহুকের ধ্বনিতে মুখরিত;
প্রকৃতিতে সাজসাজ রব; দক্ষিণা সমীরণে আগমনী বারতা
মহানায়কের আবির্ভাব ঘটবে বলে চারদিকে পড়ল সাড়া।
উনিশশো বিশ খ্রিষ্টাব্দের সতেরই মার্চের রাতে;
ঝলমলে আলো ছড়িয়ে মা সায়েরা খাতুনের কোলজুড়ে
এলো এক দেবশিশু পৃথিবীর বুকে।
আকাশে বাতাসে হর্ষধ্বনি, নদীর স্রোতের মতো
বহে আনন্দের ফলগুধারা।
খুশিতে আটখানা নানা শেখ আবদুল মজিদ
বললেন, শোন শেখ লুৎফর রহমান-
তোমার ছেলের নাম হবে শেখ মুজিবুর রহমান।
দাদা বোরহানউদ্দিন বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে!
আমি ডাকব কিন্তু খোকা বলে।
বিস্ময়কর বালক সেই খোকা হাঁটি হাঁটি-
পা পা করে এগিয়ে চলল পৃথিবীর পথে।
প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ নিতে ছুটতে হলো
এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে। গিমাডাঙ্গা স্কুল;
গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল, মাদারিপুরে ইসলামিয়া
স্কুলের গন্ডি পেরুতে না পেরুতেই ‘বেরিবেরি’ রোগ
তার পথচলাকে থমকে দিল। কিন্তু তাকে রোখার সাধ্য কার?
বুকে আছে কঠিন মনোবল যার!
আরোগ্যলাভের পর এবার ভর্তি করা হলো গোপালগঞ্জ
মিশনারি স্কুলে। এখানেই রাজনীতির হাতে খড়ি;
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় এক কর্মী।
বিয়াল্লিশে ম্যাট্রিকুলেশন, চুয়াল্লিশে কলকাতা
ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএ;
সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতির অঙ্গনে পদচারণা,
দেশভাগের আন্দোলন আর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা-বিরোধী
সভা-সমাবেশ মিছিলে সক্রিয় অংশগ্রহণ-
নির্ধারণ করে তার রাজনীতির আসন।
সাতচল্লিশে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী
নিতে নিতেই বেজে ওঠে দেশভাগের ঘণ্টা!
মুজিব মনে মনে বললেন, আর নয় কলকাতা;
এবার ফিরতে হবে ঢাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েই-
ছাত্রলীগ গঠনে মনোযোগ দিলেন;
সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনরা সঙ্গী হলেন।
হঠাৎ একদিন খবর এলো, দেশে ফিরেছেন
মওলানা ভাসানী, আছেন সন্তোষে।
ছুটে গেলেন মুজিব মহাউচ্ছ্বাসে।
বললেন মনের কথা, মুসলিম লীগ সেকেলে, চাই প্রগতিশীলধারা;
তরুণ নেতার কথা শুনে স্থির মওলানা। কী করা যায়!
ভাবতে ভাবতেই বললেন, উত্তম প্রস্তাব; আছি আমি
থাকবে অনেকেই- মুসলিম লীগে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার যারা।
উদ্বেলিত মুজিব এবার ছুটলেন জেলায় জেলায়
নতুন দল গঠনের উদ্দেশ্য বোঝালেন।
মওলানা ভাসানী, শামসুল হকের নেতৃত্বে
আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়ে তুললেন।
এবার পাকিস্তানি শাসকদের রাষ্ট্রভাষাকে উর্দু
করার চক্রান্ত রুখে দিতে মাঠে নামলেন;
বললেন, বাংলাকে করতে হবে রাষ্ট্রভাষা!
সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল
দেশের আনাচে কানাচে। দাবি উঠল সর্বত্র।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, মানতে হবে-মেনে নাও।
পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে-
রাজপথে মিছিল বের করা হলো।
মিছিলের পুরোভাগে শামসুল হক ও মুজিব
অতঃপর গ্রেপ্তার হয়ে জেলে।
আর তাতেই বাঙালি গেলো ক্ষেপে!
গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ ছুটে এলেন ঢাকায়-
সভা ডেকে বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
উত্তেজিত জনতা তীব্র কণ্ঠে বলল, নো নো নো!
বাহান্নতে তুমুল আন্দোলনের এক পর্যায়ে রক্ত ঝরলো রাজপথে,
সালাম বরকত রফিক শফিক জব্বারের রক্তের আখরে
লেখা হলো ‘‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ নাম।
উর্দুপ্রেমী পাকিস্তানী শাসকদের আঁতে ঘা লাগল তাতে;
বাঙালির ওপর শোষণ নিপিড়নের মাত্রা
দিনকে দিন বাড়তেই থাকল।
কারণে অকারণে শেখ মুজিব ও তার দলের
নেতাদের করলো জেলে আবদ্ধ;
রাজনীতি রাখলো সীমাবদ্ধ।
এরমধ্যে ঘটলো আরেক অস্বাভাবিক ঘটনা!
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আকস্মিক মৃত্যুর পর-
মসনদে বসলেন লিয়াকত আলী খান।
দৃশ্যপটে এলেন জেনারেল আইয়ুব খান।
বিধির কী লীলা!
এবার শুরু হলো পাক-সেনাদের খেলা।
পূর্ববাংলা বলল, মানি না; মানবো না-
তোমাদের ওই সেনাশাসন!
আমরা হলাম বীরের জাতি; উপড়ে ফেলব দুঃশাসন।
আইয়ুব বললেন, দাঁড়াও; তোমাদের দেখাচ্ছি মজা!
ডান্ডা মেরে করবো ঠান্ডা।
শুধু কী তাই! শিল্প কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেবো না কিছুই-
পূর্ববাংলায়; পাট বেঁচার টাকায় ইসলামবাদ গড়বো,
পশ্চিম পাকিস্তানিদের চাকরি দেবো।
ভেতো বাঙালি ভাতে মরবে; বুঝতে তখন কে আমি?
আমি হলাম ফিল্ড মার্শাল মানুষটা বড় দামি!
পাশে আছেন অনেক গুণীজন, আছেন মওলানা ভাসানী;
আমি কি আর কাউকে মানি?
জেলে বসে মুজিব আঁকলেন ছয় দফার পরিকল্পনা-
ছিষট্টিতে মানুষ পেল স্বাধীকারের ঘোষণা।
সমর্থনে বাঙালিরা গর্জে উঠল রাজপথে-
জ্বালো জ্বালো! আগুন জ্বলো!
আইয়ুব খানের মসনদে।
বেসামাল ওই শাসকেরা এবার; মামলা দিল ষড়যন্ত্রের-
বলল, মুজিব আগরতলায় বসে প্ল্যান করেছে সরকার উৎখাতের।
হয়েছে সে রাষ্ট্রদ্রোহী! মৃত্যুদণ্ড ঠেকায় কে?
মুজিব বললেন, বাঙালি আছে আমার সঙ্গে-
রাখে আল্লাহ মারে কে?
উনসত্তুরে পতন হলো আইয়ুব খানের, মসনদে এবার ইয়াহিয়া-
একই পথের পথিক তিনি; দিলেন সামরিক ঘোষণা!
রাজনীতি হলো স্থগিত, নেতারা হলেন বন্দী-
এটাই নাকি ইয়াহিয়ার নতুন কোনো ফন্দি।
শিগগিরই তিনি নির্বাচন দেবেন, ফিরবেন গণতন্ত্রে
মানুষ তাকে সেল্যুট দেবে মজবে তারই মন্ত্রে।
সত্যিই একদিন নয়া প্রেসিডেন্ট জাতির সামনে
হাজির হলেন; ঘোষণা দিলেন নির্বাচনের-
বাজলো দামামা পূর্ববাংলায়, ভুট্টো মিয়ার দুশ্চিন্তা!
বললেন হেঁকে; হারলে আমি জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে-
এই কথাতেই ক্ষেপছে মানুষ! বলল, ভোট দেবে মুজিবররে।
তাই হলো ভাই তাই হলো!
সত্তুরের নির্বাচনে-
আওয়ামী লীগের জয় হলো!
খবর পেয়ে বসলেন মদের বোতল নিয়ে ইয়াহিয়া-
বললেন গোয়েন্দাদের ডেকে, এ কী হলো মিয়া!
আমও গেলো ছালাও গেলো! এখন কী যে করি আমি!
বাহানা ছাড়া উপায় নাই!
ভুট্টো বললেন, একদম তাই।
মুজিব দিলেন হুঙ্কার! সাতই মার্চের ঘোষণা-
প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, চাই দেশের স্বাধীনতা।
ইয়াহিয়া বললেন, কয় কী ব্যাটা!
সাহস তো তার কম না!
প্রহসনের আলোচনায় ঢাকায় এলেন ইয়াহিয়া-ভুট্টো-
শেখ সাহেব জানতেন, এটা সময়ক্ষেপনের সূতো।
পঁচিশ মার্চের কাল-রাতে হানাদারবাহিনীর বর্বরোচিত
হামলা চালাল নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের ওপর;
বিধ্বস্ত হলো ঢাকা শহর; রক্তে ভাসল রাজপথ;
গ্রেপ্তার হলেন শেখ মুজিব; বাঙালি নিল যুদ্ধের শপথ।
একাত্তরে টানা নয় মাসের যুদ্ধের পর-
বাঙালি পেল স্বাধীন ভূখণ্ড; আর
বিশ্ব মানচিত্রে স্থান হল বাংলাদেশের।
বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু
বললেন, এবার দেশকে সোনার বাংলায়
পরিণত করবো ভাই;
সবার আমি সহযোগিতা চাই।
হায়েনাদের আড়ালে বসে মুচকি হাসে-
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কুচক্রীমহল একসঙ্গে বসে-
বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করে-
তারা কৌশলে সরকারের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে।
জাসদের গণবাহিনী ও পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি
দেশের সাধারণ মানুষের ঘুম হারাম করে।
তারপর সেই ষড়যন্ত্রের জাল ধীরে ধীরে-
ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের বাড়িটিকে ঘিরে ফেলে।
পনের আগস্টের কালরাতে হায়েনাদের নির্মমতার
শিকার হন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার।
জাতির জনকের রক্তের ধারা সিঁড়ি বেয়ে-
নেমে আসে রাজপথে;
রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকা-
যেন আরেক কারবালা!
শোকে স্তব্ধ হয় নগরীর গাছপালা তরুলতা-
হতবিহ্বল মানুষের মাতম ওঠে চারদিকে;
সেই মাতম ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে
দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে।
পিতাকে হত্যার দায়ে কলঙ্কিত হলো বাঙালি-
বিশ্ববাসী বলল, তোমার বিশ্বাসঘাতক জাতি!
ক্ষমা করো পিতা; ক্ষমা করো!
বাঙালি তোমায় ভুলবে না কোনোদিন;
একদিন শোধ দেবো তোমার রক্তের ঋণ।
এই দেশ যতদিন থাকবে,
ততদিনই তোমার রক্ত বহমান থাকবে-
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
রচনাকাল : ১৩ আগস্ট ২০২১।