ভালোবাসার কথা বলা হলো না
নীরস শীতকালটা কিছুতেই যাচ্ছে না, অথচ বসন্ত প্রহর গুনছে চারপাশটা রাঙিয়ে দিবে বলে। পাখিদের কোলাহলমুক্ত নিস্তব্ধতায় গাছের পাতাগুলোও যেন অলসতা ভেঙ্গে দোল খেতে প্রস্তুত নয়। সূর্যের আলো তেজহীন। ক্লান্ত এই বিকেলে মোটা হুডির দুই পকেটে হাত বুজে অ্যাডওয়ার্ড পার্কের মূল ফটকের সম্মুখ বেঞ্জে পায়ের ওপর পা রেখে বসে আছে আবির। মাঝে মাঝে সাদা হুডির পকেট থেকে বাম হাতটি বের করে সে তার ঘড়ির কাঁটায় নজর দিচ্ছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে চারপাশটা অন্ধকার হলেও সানগ্লাসে ঢাকা পড়ে আছে চোখ দুটো। বেঞ্চের এক কোনে নব যৌবনা পাপড়ি পুলকিত গোলাপ-রজনীগন্ধার স্তবক অপেক্ষা করে আছে নারী হাতের স্পর্শ পাওয়ার জন্য। ৩টা বাজতে এখনো ১ ঘণ্টা বাকি। নিজের মনের মধ্যে শব্দের পর শব্দ রঙ তুলির মতো সাজিয়ে রেখেছে আবির। মাঝে মাঝে বাতাসের তালে সেগুলো ঠোঁটের শীর্ষে এনে বিরবির করে চর্চাও করছে। আজ বসন্তকে যে ভাবেই হোক ভালোবাসার কথা বলতে হবে। বদ্ধ দরজায় দীর্ঘদিনের লালিত অনুভূতিকে অবমুক্ত করতে হবে। এ কথা ভাবতেই আবিরের শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে। ঠান্ডা শৈত্যের ভিতরেও তা গুমোট করে তুলছে দেহ। হৃদস্পন্দন বেড়ে হাত-পা গুলো তার কাঁপছে।
আবির এবং বসন্ত দুজন একই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে, রোজ দেখাও হয় দুজনার। কিন্তু আজকে যে অনুভূতি আবিরের সমস্ত শরীরকে আন্দোলিত করে তুলেছে, সে অনুভব তার আগে কখনো হয়নি। বন্ধুত্বের জায়গাটিকেই আবির সবসময় গুরুত্ব দিয়েছে। এখন তা ভালোবাসার আম্রকাননে রূপ নিয়েছে। মনের ভিতর ভালোবাসার কথা চেপে রাখার সর্বাপেক্ষা কঠিন কাজটিই পাথর মনে বেয়ে বেড়াচ্ছে আবির। অপেক্ষা এই ভালোবাসাকে অনন্ত গভীর করে তুলছে। বসন্ত এখন তার কাছে কোন সাধারণ মেয়ে নয়, সেতো আবিরের মন সওগাতের রাণী।
দুই
দূর রাস্তায় রিকসায় সাদা শাড়ি পড়ে একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। ফর্সা গোলগাল মুখখানা মেঘযুক্ত আকাশের নির্বিশ আলোতেও চক্কর দিচ্ছে। রিকসায় যত কাছে আসছে সেই চেহারাও যেন চাঁদের ন্যায় পূর্ণতা পেয়ে পূর্নিমার রূপ ধারণ করছে। অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন দিনে তার দ্যুতি চারিদিকে শোভা ছড়িয়ে আলোকিত করছে আবিরের মনকে।
রিকসা থেমে বসন্ত নামতেই আবির টাকা দিয়ে রিকসাওয়ালাকে বিদায় দিলো। বসন্ত তার নরম ঢেউ আঁকা ঠোঁট দু'টিতে মুচকি হেসে দুুুষ্টুমির সুরে বলে উঠলো, আজ সকাল থেকে বুঝতে পাচ্ছি না সূর্য কোন দিকে উঠেছে!
ডাগর আঁখি দুইটির মাঝখানে ছোট্ট টিপটি যেন বসন্তের মুচকি হাসিকে কাশবনের নির্মল শুভ্রতাকেও হার মানায়, তাতে নিবিষ্ট আবিরের চোখ দুটি কিছুতেই ফেরানো দায়। সুন্দর এই নারী অবয়বে এক দৃষ্টে বেলা পার নিরর্থক নয়। আবিরের মুখে কোন ভাষা নেই। বুলি না ফোটা নবজাতক শিশুর মতোই প্রতিদিনের চঞ্চল ছেলেটির চোখে আজ যেন মায়া ঝরে পড়ছে। তার ঠোঁটগুলো এক পবিত্র বাক্য বলার জন্য নিরব প্রহর গুনছে।
আবিরের মায়া মলিন চেহেরা দেখে বিস্মিত সুরে বসন্ত বলে উঠলো, আবির, কিছু হয়েছে তোর?
—কই নাতো
—তাহলে এভাবে ডিগডিগ করে তাকিয়ে আছিস যে!
আবির ইতস্তত হয়ে উত্তর দিল, দেখছিলাম।
—কি?
—তোকে
—রোজই তো দেখিস। আচ্ছা, তুই কি কোন বিষয়ে চিন্তিত?
প্রশ্ন করতেই বসন্তের দৃষ্টি বেঞ্জের এক কোনায় গিয়ে পড়লো। সেখানে তাজা সতেজ ফুলগুলোর ওপর তার দৃষ্টি নিবিষ্ট হলো।
'এইগুলো তোর?'
'না'
'তাহলে এখানে কেন?'
'কেউ হয়তো ফেলে গেছে'
বসন্ত ফুলগুলো হাতে নিল। গোলাপগুলো মুখের কাছে এনে দীর্ঘ নিশ্বাস তুলে ঘ্রাণযুক্ত স্বরে বললো, আহারে বেচারা, ভালোবাসার দিনে ফুলগুলো এভাবে অযত্নে ফেলে যায় কেউ?
—হয়তো গার্লফ্রেন্ডের সাথে কেউ ঝগড়া করে ফেলে গেছে
—কিন্তু ঝগড়া করলে তো ফুলগুলো এমন অক্ষত থাকতো না। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী একটা অবস্থা বোঝা যেত।
বলেই বসন্ত হেসে উঠলো।
'সে যাই হোক বসন্তর এতো ভাবার সময় নেই, বসন্ত যখন এসে গেছেই, তখন সে ফুলের শোভায় শোভিত হবেই'
বসন্তের কথাগুলো শুনে আবিরের পা গুলো যথারীতি কাঁপতে শুরু করেছে। সমুদ্রের জলচ্ছ্বাসের মতো বড় বড় তরঙ্গ এসে আছড়ে পড়ছে তার মনে। এতো প্লাবনেও সে নিজেকে অনড় রাখলো। মৃদু স্বরে বলে উঠলো, বসন্ত, সামনে যাবি? চল না এগোয়?
বসন্ত মৃদু বাতাসে ছড়িয়ে যাওয়া শাড়ির আঁচল এক হাতে বুজে নিল, অন্যহাতে ফুলগুলো শক্ত করে ধরে পা বাড়িয়েই বললো, চল।
তিন
শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে বসন্ত প্রকৃতিকে নবরূপে সাজাতে এসেছে। আবিরের পাশে সমকদমে হেঁটে চলা মেয়েটিও মৃদু শীতল হাওয়ায় তার রূপটাকে উজার করে দিয়েছে। হিমেল হাওয়ায় তার সামনের বাধাহীন দু চারটি চুল মুখ বেয়ে ঠোঁটের ওপর, আশেপাশে এলোমেলো উড়ছে, বসন্ত আঙুল দিয়ে ব্যস্ত হাতে তা বারবার মাথায় গুজে দিচ্ছে। আবিরকে দেখে তার খুব চিন্তা হচ্ছে একইসঙ্গে সন্দেহও। হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে বসন্ত আবিরের দিকে তাকিয়ে এক নতুন মানুষকে আবিষ্কার করছে। এই আবির বসন্তের চেনা কেউ না। কোনো অপরাধ করে অনুশোচনাকারী অনুতপ্ত এক ছেলে। যে কিনা প্রতিটা কদমে নির্দোষ হবার অংক কষছে।
—কিরে কিছু বলছিস না যে!
—বলছি তো
—কই, তুই তো চুপ করে আছিস
আবির রাস্তা থেকে দৃষ্টি উঠিয়ে বসন্তের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে আবার সামনের দিকে দৃষ্টি ফেরালো।
—তোর হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে?
—আমি যে হাঁটতে পটু সেইটা তুই ভালোভাবেই জানিস।
—না, আজ শাড়ি পড়েছিস তাই বললাম। শাড়ি পড়ে হাঁটতে তো মেয়েদের সমস্যা হয়।
—বাহ, মেয়েদের সমস্যার বিষয়ে দেখছি ভালোই খোঁজ রাখিস।
আবির কিছুটা লজ্জায় পড়ে গেল। এসব কথায় তার কখনোই সংকোচ হতো না। কিন্তু আজ সবকিছুতেই সে যেন এক অন্য মানুষ। চলতে চলতে তাদের অনেক পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হয়। কেউ তাদের নিয়ে সন্দেহ করেনি। কারণ সবাই জানে আবির প্রেম করার মতো ছেলে না। বসন্তও আবিরকে কেবল বন্ধুর চোখেই দেখে।
চার
সন্ধ্যা নেমে আধার হলো। বসন্তের বাতাস যেন আরও সুঘ্রাণ নিয়ে আবিরের নাসিকা রন্ধ্রে প্রবেশ করছে। মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা কথাগুলো তার এখনো বলা হয়নি। মাগরিবের আজানের ধ্বনিতে মখোরিত হলো দিকবিদিক। কানে বেজে ওঠার সাথে সাথে বসন্ত তার শাড়ির আঁচল বাঙালি মুসলমান নারীর মতো মাথায় তুলে নিল।
'আবির আমাকে একটু গাড়িতে উঠিয়ে দিতে পারবি, বাসায় ফিরতে হবে।'
আরেকটু সময় থাকার কথা আবির বলতে পারে না। কারণ আবিরের মন না পাওয়ার ভয়ে ভীত। বসন্তকে সে সর্বাঙ্গে চায়। বসন্ত যদি তার ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে তার জীবন নির্জীবতায় ফিকে হয়ে যাবে। সে কখনোই তা চায় না। প্রকৃতির মতো আবিরও তার জীবনে বসন্তের ছোঁয়া চায়। বসন্তের সাথে কথা না বলে, বসন্তকে না দেখে আবিরের দিনে রাতের আধার নামবে না। তার চেয়ে বরং বসন্ত থাকুক, নিজের হয়েই না হয় থাকুক, আবিরের বন্ধু হয়ে থাকুক। বসন্তের রঙে রঙিন হওয়ার অপেক্ষা আরেকটু বাড়ুক। পাথর চাপা দিয়ে প্রত্যহ না পাওয়ার মাঝেই একটু করে পাওয়ার দু:খ তাকে বেয়ে বেড়াতে হবে এটা সে জানে।
বসন্তকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে সে হুডির পকেটে দুই হাত বুজে। পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মেলতেই চোখের কোণে জমে একবিন্দু অভিমান। দুচোখ মুছে নিজেই নিজেকে আড়াল করে বাসার পথে রওনা হয় আবির।
বাড়িতে পৌঁছে বসন্ত নিজেকে যেন কিছুতেই সামলাতে পারছে না। প্রকৃতিকে রাঙানোর বদলে বসন্ত আজ ঘরবন্দী। বর্ষার আকাশ নিপাতিত জল কণার মতোই বসন্তের চোখে মেঘ জন্মেছে। বসন্ত জানে যে ফুল সে হাতে করে এনেছে তা আবির তার জন্যই এনেছিল। কিন্তু ফুলগুলো যেভাবে তার পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল, সেভাবে সে পায়নি। বসন্ত আজ আবিরের রঙে রঙিন হতে চেয়েছিল। কিন্তু সে একজন মেয়ে, একজন নারী। তার মনের কথা সে মুখ খুলে বলতে পারে না, বলতে পারেনি। অশ্রুসিক্ত চোখে ডাইরিটা খুলে তাই বসন্ত লিখে রাখলো, আজ তোমার পছন্দের রঙের সাদা শাড়িটা পড়েছিলাম। আমি তোমার হতেই গিয়েছিলাম, বসন্ত এসেছিল, তোমার ভালবাসার দিনে, কিন্তু আজও তুমি আমার হলে না।