দুই ফোঁটা জল
ওর নাম জলফড়িং দেওয়ার পেছনে কোনো শক্ত যুক্তি নেই। মুখ থেকে হঠাৎ করেই বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার পর জলফড়িং নাম আর ফেরত নেইনি। জলফড়িংই নামটা সঙ্গে নিয়ে গেছে। জলফড়িংয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময়। আমার পরীক্ষা না, জলফড়িংয়ের পরীক্ষা ছিল। আমি আর্টস ফ্যাকাল্টিতে পড়ি। আমার সাবজেক্ট ছিল সমাজবিজ্ঞান। অবশ্য এসএসসি ও এইচএসসিতে আমি কমার্সের ছাত্র ছিলাম। কি মনে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে কমার্স পড়তে ইচ্ছা হলো না। অংক নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগছিল না। মা-বাবাকে না জানিয়েই ফরম তুললাম কেবল আটর্সের সাবজেক্টে। বাবার শখে কমার্স নিয়েছিলাম। বাবা কষ্ট পাবেন বলেই বাড়িতে কিছুই বললাম না। বাবা ভাবলেন আমি কমার্সে ভর্তি হচ্ছি। শেষে যখন দেখলেন আটর্সের সাবজেক্টে চান্স পেয়েছি বাবা শুধু শুকনো মুখে বললেন, কমার্সটা তোর আর পড়া হলো না। একটু ভালো করে প্রিপারেশন নিতি? আমি আর সত্যি কথাটা জানালাম না। সেখান থেকেই আমার কমার্স জীবনের ইতি ঘটল। তাতে সুবিধা হলো আমার। পড়াশোনার বাইরে ঘুরে বেড়ানোর সময় পাই। টেনেটুনে সেকেন্ড ক্লাস পেলেই চলবে। বেশি পড়তাম না। লতায় পাতায় সম্পর্কের এক ভাইয়ের হাত ধরে ঢুকে গেলাম রাজনীতিতে। চোখে তখন অনেক স্বপ্ন। নেতা হতে ইচ্ছে করত। চাকরি না হলেও ক্ষতি নেই। রাজনীতি করব- এ রকম একটা ইচ্ছা মনের ভেতর ততদিনে ঢুকে গেছে। অনেকে বড় ভাই বলে সালাম দেয়। ভালোই লাগে। সকালে পেছন পকেটে একটা বই খাতা নিয়ে বের হই। আড্ডাতেই সময় যায় বেশি। আমার ততদিনে একটা সার্কেল গড়ে উঠেছে। কোনো মেয়ে নতুন এলো-গেল তীক্ষ্ণ নজর রাখি। এটাই যেন কাজ! এই নজর রাখতে গিয়েই একদিন জলফড়িং আমার ফুড়ৎ করে ঢুকে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ছিল। গেটের সামনে দাড়িয়ে আছি। আমি ও আরও কয়েকজন আছি। কেউ কেউ আমাদের কাছে আসছে, জানতে চাইছে নিজের আসনের খবর। আমরা বুঝিয়ে দিচ্ছি। এর মধ্যে লক্ষ্য করলাম একটি ফর্সা, হালকা গড়নের মেয়ে ভিড় ঠেলে গেটের দিকে যাচ্ছে। বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কারো হাতের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ওর প্রবেশপত্রটি পরে গেল। মেয়েটি এটা লক্ষ না করেই গেট দিয়ে ঢুকে গেল। আমি পেছন থেকে ডেকে উঠলাম এই জলফড়িং, অ্যাই?
জলফড়িং নামটির সূচনা এখান থেকেই।
আমি চ্যাঁচিয়ে বললাম, ’আপনার অ্যাডমিট কার্ড'?
অত ভিড়ে কেউ কারও কথা শোনার কথা না। জলফড়িংও শুনল না। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে আমিও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। এতক্ষণে যুতসই একটা কাজ পেলাম। আমি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলাম প্রবেশপত্র উদ্ধার করার জন্য। যতটা সহজ ভেবেছিলাম কাজটি তত সহজ ছিল না। মিছিলের ভেতর দাঁড়িয়ে মাটি থেকে তোলার চেষ্টা করছি। সবাই পরীক্ষার হলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি সাগরের মধ্যে থেকে মুক্তা তুলে আনলাম। প্রবেশপত্র হাতে নিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে একটু এগুতেই দেখি জলফড়িং দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় কান্নাকাটি করেছে। চোখ দুটো ফোলা। আমি প্রবেশপত্র এগিয়ে দিলাম। জলফড়িং প্রবেশপত্রটি হাতে নিয়ে পেছনে ঘুরে হাঁটতে লাগল। একবার ধন্যবাদও দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। আশ্চর্য! আমি পেছন থেকে আবার ডাকলাম, অ্যাই জলফড়িং? মেয়েটা আমার কথায় থমকে দাড়াল।
আমাকে কিছু বললেন? এগিয়ে এসে জানতে চাইল।
’ভালোভাবে পরীক্ষা দেবেন।’
’ঠিক আছে। আর হ্যাঁ আমার নাম জলফড়িং না মৌমিতা। মৌমিতা সেন। বলার সময় ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠল।’
’ও আচ্ছা।’ আমার নাম বলার সময়ই পেলাম না।
জলফড়িং পরীক্ষার্থীদের ভিড়ে হারিয়ে গেল। ভর্তি না হলে জলফড়িংয়ের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কোনো চান্স ছিল না। আমি চাইছিলাম জলফড়িং এখানে ভর্তি হোক। উপকারের পরিবর্তে প্রাপ্য ধন্যবাদটা নিতে হবে জলফড়িংয়ের কাছ থেকে। জলফড়িং ভর্তি হলো কমার্স ডিপার্টমেন্টে। তখন আমার মনে হলো কমার্সে ভর্তি হলেই বেশ হতো। জলফড়িংকে দেখলাম নবীন বরণ অনুষ্ঠানে। নতুনদের ফুল দিয়ে বরণ করার সময়। জলফড়িংয়ের হাতে আমি ফুল দিতে পারলাম না। এরপর আমি বাড়িতে একটু সমস্যা হলে সেখানে মাসখানেক ক্যাম্পাস থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। জলফড়িংয়ের সঙ্গে দেখা হলো না। ক্যাম্পাসে ফিরে এসে একদিন সকালে দেখা হলো জলফড়িংয়ের সঙ্গে। মহুয়া তলায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। জলফড়িং ক্লাস থেকে ফিরছিল। আমি লাফ দিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
’কেমন আছেন?’
আমাকে হঠাৎ ওভাবে দেখে হকচকিয়ে গেল জলফড়িং।
আমাকে বলছেন?
আমাকে চিনতে পারছেন?
’না।’ জলফড়িংয়ের সোজা উত্তর। আমাকে একটু নির্লজ্জ হতে হলো। আমাকেই গায়ে পরে পরিচয় দিতে হলো। সেদিনের প্রবেশপত্রের ঘটনাটা তাকে বললাম। শুনে মনে পরে যাওয়ায় মনে হয় একটু লজ্জিত হলো। লজ্জা পাওয়ার সময় জলফড়িংয়ের চোখ মুখ লাল হয়ে গেল।
’আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে পারিনি। দুঃখিত। টেনশনে ছিলাম তো তাই। এখানে ভর্তি হতে না পারলে গ্রামের কলেজে ভর্তি হতে হতো। আর কোথাও তো চান্স পাইনি।’
’ভাগ্যিস ভর্তি হয়েছেন!’
’মানে?’
’মানে কিছু না। আপনি বুঝবেন না।’
আমি বুঝতে চাচ্ছি না।
আমি ফিরোজ। সমাজবিজ্ঞান থার্ড ইয়ারে পড়ি।
’ও আচ্ছা। আপনি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন?’
জলফড়িংয়ের মুখ থেকে সাহায্যের কথা শুনে আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। এ যেন রাজকন্যার মুখ থেকে আদেশের অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকা।
’কি সাহায্য?’
’মানে এখানে হোস্টেলে একটা সিট নেওয়া আর একটু নোট-টোট জোগাড় করে দেওয়া। আমার তো এখানে কেউ পরিচিত নেই। ও হ্যাঁ আমি লক্ষ্য করেছি আপনি আজও আমাকে জলফড়িং ডাকছেন। আমার ও ডাকে আপত্তি নেই। তবে সবার সামনে আমাকে মৌমিতা বলেই ডাকবেন।’
জলফড়িংয়ের সঙ্গে কথা হলো বেশ অনেকক্ষণ। জানলাম বাবা-মার একমাত্র সন্তান সে। ওর আর একটা বড় বোন ছিল। মারা গেছে। আমার সম্পর্কেও বললাম। ইনিয়ে বিনিয়ে ক্যাম্পাসে আমার প্রভাবের কথা বললাম। জলফড়িংয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা একটু স্বাভাবিক হলো এদিন।
এরপর থেকে প্রতিদিনই জলফড়িংয়ের সঙ্গে দেখা হতো। কথা হতো। প্রতিদিনই সমীর দা’র দোকানের চা খাওয়া হতো। ক্লাস শেষেই আমাকে ফোন দিত। আমি ছুটে যেতাম। আমি তো খুব বেশি ক্লাস-টাস করতাম না। জলফড়িংয়ের সাথে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার তিন বছর পর ক্যাম্পাসকে আমার অন্যরকম লাগতে লাগল। লেখাপড়া আর রাজনীতির জীবনের বাইরেও একটা জীবন আছে সেটা এই প্রথম টের পেলাম। সেটা হলো জলফড়িং। জলফড়িংয়ের জীবন। কীভাবে যেন মেয়েটা আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। লক্ষ করলাম জলফড়িংও ক্যাম্পাসে আমি নির্ভর। ফটোকপি থেকে শুরু করে ফুচকা খাওয়া আমাকে ছাড়া চলছে না। আরও বেশ কিছু বন্ধু আছে ওর, তবে আমার গুরুত্বটা বুঝতাম একটু আলাদা। ভাবলাম এবার জলফড়িংকে আমার অনুভূতির কথাটা সরাসরি বলতে হবে। সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে হবে। সকালে বই খাতা পকেটে গুঁজে ক্যাম্পাসে এলাম। জলফড়িং এর মধ্যেই দুইবার ফোন দিয়েছে। সমীর দা’র চায়ের দোকানে। কি না কি দরকার আছে। সারপ্রাইজ আছে। আজ তো সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা আমার। পৌঁছে দেখি জলফড়িং আগেই এসেছে। আমাকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে এলো।
’ফিরোজ ভাই, ওর নাম স্বপ্নীল।’ ওর সাথেই বসেছিল ছেলেটি। পরিচয় দিতেই উঠে হাত এগিয়ে দিল।
এই সারপ্রাইজের কথাই বলেছিলাম।
’ও চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ইংরেজি, থার্ড ইয়ার। আমাদের একই গ্রামে বাড়ি। পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আপনার কথা বলাতে খুব দেখা করতে চাইছিল।’
জানো, আমার নাম ফিরোজ ভাই কি রেখেছে?
’কি?’
’জলফড়িং। সুন্দর না নামটা?’
’হু।’
স্বপ্নীলের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হলো। যাওয়ার সময় বলে গেল, ভাই মৌমিতাকে একটু দেখবেন। আপনাকে খুব বিশ্বাস করে।
ওদের বিদায় দিয়ে চলে আসি। স্বপ্নীলের সাথে মৌমিতাকে বেশ মানিয়েছে। আমার সারপ্রাইজটা তোলা থাক। মৌমিতার কথা ভাবতে ভাবতে দেখি দু’চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে। আমি তাড়াতাড়ি মুছে ফেলি।
টিটি/