অব্যক্ত ভালোবাসা
ঘড়িতে সময় ভোর সাড়ে ৬টা। মোবাইলের রিংটোনে ঘুম ভাঙলো রবিনের। সচরাচর ৯টার আগে উঠে না সে। চোখ কচলাতে কচলাতে আধো ঘুমে ফোন রিসিভ করল। হ্যালো বলতেই ভেসে উঠলো অতি পরিচিত এক আওয়াজ। চেনা সেই সুর। নাম্বার দেখে রীতিমতো চমকে গেছে রবিন।
বহুদিন পর রিয়ার ফোন। ওপাশ থেকে আওয়াজ এল, ‘কেমন আছ? রবিন।’ হঠাৎই রবিনের চোখের কোনায় দু’ফোটা জ্বল এসে জমা হলো। চোখ মুছে বলল, ‘ভালো আছি। তুমি ভালো?’ তারপর বেশ কিছুক্ষণ কথা চলল।
ঘুম পুরোই ভেঙে গেল রবিনের। ঘুম আসছেনা আর। মনে পড়ছে রিয়ার কথা। সেই পুরোনো দিনের কথা। রবিন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল সোনালি অতীতে। রিয়াকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো রবিন তবে কখনো ভালোবাসি বলে উঠা হয়নি।
রবিন আর রিয়া। পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রায় বছর খানেক পর। কথাবার্তা শুরু ফেসবুক মেসেঞ্জারের সুবাদে। ক্লাস নোট দেওয়া নেওয়ার মাধ্যমে শুরু। এই স্বল্প পরিচয় যে এতদুর নিয়ে যাবে কেউ কখনো ভাবতেই পারেনি। একজনের আরেকজন ছাড়া যেন চলতই না। কেয়ারিং-শেয়ারিংয়ের কোনো কমতি ছিল না তাদের মধ্যে। অনেকে বলে থাকে প্রতিটা ছেলেই না কি তার মেয়ে বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রেমে পরে। রবিন কথাটা বিশ্বাস না করলেও পরে মেনে নিয়েছে।
রিয়াকে প্রচণ্ড রকম ভালোবেসে ফেলেছিল রবিন। তবে ভালোবাসাটুকু শুধু মনেই ছিল। প্রকাশ করেনি হারানোর ভয়ে। রবিন শুধু অপলক দৃষ্টিতে চেয়েই থাকতো রিয়ার দিকে।
ডিপার্টমেন্টে রবিন আর রিয়াকে চেনেনা এমন কেউ নেই। তাদের সম্পর্ক টম এন্ড জেরির মত। সারাক্ষণ খোঁচাখুঁচি, ঝগড়া। তাদের দু’জনেরই ক্লাসে ভালো পার্ফর্মেন্স। বরাবরই সিজিপিএ ভালো। তাই আর শিক্ষকদেরও নজরের বাইরে পরত না।
ক্লাসে এক বেঞ্চে বসে মারামারি, খোঁচাখুঁচি। মাঝে মাঝে স্যারের নজরে পড়লে দাঁড় করিয়ে রাখতো পুরো ক্লাস। তবুও ক্লাসে খোঁচাখুঁচি বন্ধ হয় না তাদের। ক্লাস শেষেই আড্ডা ডায়না চত্বরে। বিকেল হলেই মফিজ লেকে ঘুরতে যাওয়া। সন্ধায় রিয়াকে হলে পৌঁছে দিয়ে জিয়া মোড়ে বন্ধুদের সাথে চায়ের আড্ডায় মিলিত হওয়া। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল রবিন আর রিয়ার সময়গুলো।
ভালোই চলছিল। হঠাৎ সম্পর্কে নেমে এল কালো ছায়া। রাকিব সন্দেহ করতো রবিন আর রিয়া প্রেম করে। রাকিব রিয়ার বয় ফ্রেন্ড। সে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। রবিন আর রিয়ার এরকম সম্পর্ক রাকিব মেনে নিতে পারেনি। সন্দেহ করতো সবসময় ওরা প্রেম করে কি না।
রিয়ার আশপাশের বন্ধু-বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করত ওদের মধ্যে সম্পর্ক কী, প্রেম করে না কি ইত্যাদি ইত্যাদি। রিয়া কোনো ছেলের সাথে মিশলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠত রাকিব। ধীরে ধীরে বেড়েই চলল রাকিবের সন্দেহের পাহাড়।
রিয়া শুরুর দিকে তার বয়ফ্রেন্ডের সন্দেহের কথা লুকালেও হঠাৎ একদিন রবিনকে বলেই ফেলল। রিয়া বলল, ‘রবিন শোন, তোর সাথে মনে হয় আর তেমন যোগাযোগ হবে না।’ রবিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি বলিস তুই! বুঝে বলছিস?’ রিয়া তখন আস্তে আস্তে খুলে বলল সব।
রবিন সেদিন হাসিমুখে রিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলেও ধাক্কা সামলাতে পারেনি। রিয়ার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হওয়ায় ভেঙে পড়ে। এদিকে সেমিস্টার ফাইনাল দরজায় কড়া নাড়ছে।
ধীরে ধীরে তাদের দুরত্ব বাড়ল। কিছুদিন পড়েই রবিন অসুস্থ হয়ে পড়ল। খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম, অবহেলা। শরীরের প্রতিও যত্ন নেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হলো সেমিস্টার ফাইনাল।
পরীক্ষার তেমন কোনো প্রস্তুতিই নেই রবিনের। বাসায় কী জবাব দেবে রেজাল্ট খারাপ হলে। এ চিন্তায় আর পড়াশোনা হচ্ছেনা। পরীক্ষা চলছে। চাপ বাড়ছে। মোটামুটি প্রিপারেশন নিয়ে প্রথম পরীক্ষায় অংশ নিল। পরিক্ষা শেষ। পরীক্ষা শেষে সাধারণত সবাই টেনশন ফ্রি হয়। রবিনের ঘটল উল্টো। পরীক্ষা চরম খারাপ হয়েছে তার। বাড়িতে কী জবাব দেবে?
কথায় আছে সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। রবিনের জন্যও সময় থমকে দাঁড়ায়নি। ধীরে ধীরে রবিন সুস্থ হয়ে উঠল। তবে রিয়াকে কোনভাবেই ভুলতে পারছেনা। কেটে গেল বাকি আরো দু’টি বছর। গ্রাজুয়েশন শেষ তাদের। এখন দৌড়ানোর পালা চাকরির বাজারে। কয়েকজন বন্ধু মিলে ঢাকা শহরে একটা বাসা ভাড়া নিল রবিন। সেখান থেকেই চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা রবিন। পরিবারের বড় সন্তান। টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়। দেশে চাকরি সোনার হরিণ। সরকারি চাকরি তো আরও বিশাল ব্যাপার। ভাইভার পর ভাইভা দিয়েই যাচ্ছে। চাকরি হচ্ছেনা। টেনশন বাড়ছে। আর কতদিন বাবার টাকায় চলবে।
রবিনের আইটি সেক্টরে হাত পাঁকা। চাকরি না পেয়ে আর সাত পাঁচ না ভেবে আউটসোর্সিং শেখা শুরু করল। অল্প সময়েই রপ্ত করে ফেলল। শুরুতে বেশি টাকা আয় না হলেও ধীরে ধীরে আয় বাড়ল। আউটসোর্সিংয়ে রবিন এখন মাসপ্রতি প্রায় লাখখানেক টাকা আয় করে। বাড়িতেও টাকা পাঠায়।
ভাড়া বাসা ছেড়ে ফ্ল্যাটে উঠল রবিন। এখনো মাঝেমধ্যেই রিয়ার কথা ভাবে। ভাবে সোনালী অতীতের কথা। কোথায় আছে, কেমন আছে। রিয়া শুধু কল্পনায়ই থেকে গেল। প্রণয় ছিল, পরিনয় আর হয়ে উঠল না। রবিনের অব্যক্ত ভালোবাসা এভাবেই বেচে রইল তার মনে। রিয়াকে কখনো বলেনি ‘ভালোবাসি’।
এসএ/