বকুলের মালা
ছেলেটির নাম বকুল। ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াশোনা করে। ছেলেটি যখন ইন্টারমিডিয়েট অধ্যায়নরত ছিলো তখন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নানান ধরনের স্বপ্ন দেখতো। ঠিক তার আগের মুহূর্তে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনার এক ভয়াবহ আকার দেখা দেয়। তখন অনলাইনে বাংলাদেশের সকল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছিল। সেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, তাদের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস অনলাইনে হয়। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের শিক্ষক সবাইকে জিজ্ঞাসা করছিল তোমাদের বাড়ি কোথায়, কার জীবনে কি স্বপ্ন আছে এবং বড় হয়ে কে কি হতে চাও। সবাই এক এক করে পরিচয় দিচ্ছিল। একদম শেষ মুহূর্তে মালা নামের একটি মেয়ে তার পরিচয় দিয়েছিল। তার কথার সুরগুলো ছিল কোকিলের গান। তার নিঃশ্বাসে ছিল কালবৈশাখী ঝড়ের আওয়াজ। তার ঠোঁট ছিল সকালের শিমুল ফুলের সূর্যের আবরণ। নাম দুটো বেশ সুন্দর মানিয়েছিল বকুলের মালা।
মেয়েটার বাসা ঢাকাতেই ছিল। বকুলের মেয়েটাকে এতটাই ভাল লাগে, ওই যে কথায় বলে না ‘লাভ অ্যাট টেন সেকেন্ড’ ব্যাপারটা ছিল ঠিক তাই। বকুল মেয়েটাকে ফেসবুকে খোঁজার চেষ্টা করে ইনস্টাগ্রামে খোঁজার চেষ্টা করে অবশেষে সে পায়। বকুল নিয়মিত মেয়েটাকে ফেসবুকে ফলো করে, কিন্তু মালা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করছিল না।
বকুল শুয়ে শুয়ে মালার কথা ভাবে আর বলে ইস যদি আমার জীবনে মালাকে পেতাম। কয়েকদিন পর থেকে তাদের ক্লাস শুরু হয়। বকুল স্যারের লেকচার শুনা বাদ দিয়ে মালার জিমেইলের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতো আর জনম জনমের স্বপ্ন দেখতো। হঠাৎ করে পরের দিন সন্ধ্যায় মালা বকুলের ফেসবুক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে। বকুল সাথে সাথে ফেসবুকে ঢুকে দেখে মালা এক্টিভ নাই। একটু আগে চলে গেছে। মালা আবার অনেকটা কম কথা বলত বেশ চুপচাপ স্বভাবের ছিল। বকুল তো মন খারাপ করে বসে আছে। এত সাধনার পরে তাকে পেলাম, তবু কথা বলতে পালাম না। তবে একদিক থেকে খুশি ছিল মালা ওর ফেন্ড রিকোয়েস্টটা একসেপ্ট করেছে। বকুল ভেবেছিল আজ হোক কাল হোক কথা তো হবেই।
রাত দশটার পরে বকুল মালাকে তাই লিখে একটি এসএমএস করে। কিন্তু মালা রিপ্লাই না করেই ফেসবুক থেকেচলে যায়। এভাবেই কিছুদিন যেতে যেতে শোনা গেল তাদের বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিবে। বকুল তো শুনে মহা খুশি। মালার সাথে তার দেখা হবে। মালার সাথে কথা বলুক আর না বলুক চোখের দেখাটাতো বকুল দেখতে পারবে। তারপর বাসা খোঁজা নিয়ে এর মধ্যে দিন পার হচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন বেশ ভদ্রতার সাথে সুন্দর একটি ড্রেস পড়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল। কিন্তু দেখে মালা নেই। বকুলের তো মনটা ভীষণ খারাপ। যাকে দেখার জন্য এত উৎফুল্ল হয়ে সে ঢাকা আসলো কিন্তু এখনো সে আসেনি। সে নিয়মিত ক্লাস করছিল, কিন্তু কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে পারছিল না। এভাবেই প্রায় ১৫ দিন পার হয়ে গেল। হুট করে একদিন ক্লাসে মালা উপস্থিত। বকুলের যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো মালাকে দেখে। এই প্রথম বকুল মালাকে সরাসরি দেখল। মালা ক্লাসে এসে চুপচাপ ক্লাস করছিল। কারো সাথে তেমন কথা বলছিল না। বকুল অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করে কোনো বার সফল হতে পারছিল না। এভাবেই তিনটা ক্লাস শেষ হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যাল শেষে মালার পিছু নেয় বকুল। মালার বাসাটা চেনার জন্য। অনেক বড় একটি বাড়িতে মালা ঢুকলো। বকুল ভাবছিল মালারা হয়তোবা অনেক ধনী।। বকুল মাঝে মধ্যেই মালার বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো মালাকে একনজর দেখার জন্য। হঠাৎ করে কেউ একজন মালার পিছু নিচ্ছে মালা বুঝতে পারে। পরের দিন দেখে সেই ছেলেটা বকুল, তার ক্লাসমেট। বেশ রাগান্বিত হওয়ার পরেও বকুলকে মালা কিছু বলে না। বকুল কখনো মালার সামনাসামনি এসে কথা বলার সাহস পায়নি। কিন্তু ব্যাপারটা মালার কাছে বেশ বিরক্তিকর ছিল। মালা বকুলের উপর রাগ করে অনেক কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারছিল না। কারণ বকুল মালার ক্লাসমেট। মালা বুঝতে পেরেছিল বকুল ওকে অনেক ভালোবাসে।
হঠাৎ করে মালার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কেমন জানি উধাও হয়ে গেল। বকুল মালার বাসার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মালার জন্য অপেক্ষা করে তবু মালার দেখা পায় না। তার মনটা বেশ খারাপ। কিন্তু মজার ব্যাপারটা হল মালা তখন চুপি চুপি ফলো করছিল। ততদিনে বকুলের প্রতি মালার ও একটা ভালো লাগা তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু মালা চায়না কারও সাথে তার জীবনকে জড়াতে। কিছু দিন পর মালার সাথে হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে দেখা। হুট করে বকুল মালাকে ঐদিন প্রপোজ করে। মালা বললো অসম্ভব, মাফ করবেন।
পরের দিন বিকালে বকুল মালাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওই বাড়িটি থেকে একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে আসে এবং বলে এই ছেলে তোমার কদিন ধরে দেখছি তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। যাও এখান থেকে চলে যাও। আর কখনো যেন তোমাকে এদিকে না দেখি। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বাসায় যায়। এবং মালাকে বলে বাড়ির সামনে যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা কে? তুমি কি তাকে চেনো। মালা বলে, হ্যাঁ। তুমি তাকে নিষেধ করে দিবে সে যেনো কখনো বাড়ির সামনে না আসে। পরের দিন মালা বেশ রাগান্বিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। সে বকুলকে বলে প্লিজ দয়া করে আমার পিছু নিও না। এক সড়ক দুর্ঘটনায় আমি আমার পুরো পরিবার হারিয়েছি। আমার চাচা-চাচি, মামা-মামি কেউ আমাকে ঠাঁই দেয়নি। অবশেষে আমার বাবার আমাকে আশ্রয় দেন। তার স্ত্রী অসুস্থ। তাদের একটা মেয়ে ছিল। আমার মত। সে হঠাৎ বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে সাগরে ডুবে মারা যায়। তারপর থেকেই আমি তাদের বাড়িতে মেয়ের অভিনয় করে থাকছি। আমার যাবতীয় খরচ তারই বহন করছে। আর আন্টিও তার নিজের মেয়ে মনে করে ভালোবাসে এবং সে আমাকে পেয়ে মানসিকভাবে অনেকটা সুস্থ। আমি এক পরিবারকে হারিয়েছি। আর একটি পরিবার আমি হারাতে চাই না।
প্লিজ, দয়া করে আমার পড়াশোনাটা বন্ধ করো না। আমি আমার এই জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে চাই না। তুমি যদি আমার বাসার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকো তাহলে হয়তো বা কদিন পরে আমাকে তারা বাড়ি থেকে বের করে দিবে। তারপর আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাই তোমাকে হাতজোড় করে বলছি। আমর পিছু ছেড়ে দাও।
বকুল বলে ঠিক আছে আর কখেনো তোমাকে বিরক্ত করব না। কখনোই তোমার বাসার সামনে যাব না। তবে শুনে রাখ। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। এই বলে বকুল চলে গেল। মনে মনে মালারও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কারণ মালা জানতো বকুল তাকে অনেক ভালোবাসে। মালা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল আর বলছিলো, আমিও তোমাকে ভালোবাসি বকুল। কিন্তু ইচ্ছে করলেই আমি আমার জীবনে তোমার জড়াতে পারবো না। আমায় মাফ করে দিও বকুল।
আবার করোনার কারনে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। সবাই সবার বাসায় চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বকুলের একদম বাড়িতে যেতে ভালো লাগছিলো না। কিন্তু বাড়ির চাপে বকুল বাড়ি যেতে বাধ্য হয়। বাড়ি যাওয়ার বেশ কদিন পরে বকুলের বন্ধু রুপম বকুলকে বলে কিরে, তোর মালা তো অসুস্থ। ওর কি অবস্থা এখন। বকুল বলে আমার সাথে তো ওর কথা হয় না। আর মালার কি হয়েছে?
রুপম বলে, তেমন কিছু জানি না। শুনলাম অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। এটা শুনে বকুল এর মাথা ঘুরে যায়। বকুল প্ল্যান করতে থাকে ঢাকা যাবে। কিন্তু তার কাছে টাকাও ছিলো না। ঘুম ও নাই বকুলের চোখে। পরের দিন সকালে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা বলে বকুল তার মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ঢাকায় আসে মালাকে দেখার জন্য। বকুল সরাসরি হাসপাতালে চলে যায়। বকুল গিয়ে দেখে সেই ভদ্রলোকটি সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। বকুল বলে স্যার মালার কি হয়েছে?
ভদ্রলোক বলে মালার দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অনেক চেষ্টা করলাম কিডনি জোগাড় করতে পারলাম না। দেখা যাক আজকে সন্ধ্যায় একজনের সাথে কথা হয়েছে। সে নাকি জোগাড় করে দিতে পারবে।
বকুল বলে স্যার তার প্রয়োজন নেই। আমি আমার একটি কিডনি মালাকে দিতে চাই। একটা সুযোগ দিন স্যার। প্লিজ। আমি আর মালা একসাথে বকুল মালা হয়ে থাকতে চাই। দয়া করেন স্যার। ভদ্রলোক শুনে অনেক আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন। ভদ্রলোক বললেন ঠিক আছে। বকুল বলে স্যার, কিন্তু আমি যে মালাকে কিডনি দিচ্ছি মালাকে আপনি কখনো বলবেন না। ভদ্রলোক বললেন, কিন্তু কেন? বকুল বলে মালা আমাকে ভালোবাসে না। ওর জীবনের সাথে কাউকে জড়াতেও চায় না। ভদ্রলোক খানিকটা ভেবে বললেন ঠিক আছে। তারপর বকুলকে বিভিন্ন টেষ্ট করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন বকুলের অপারেশন। কিন্তু তার মনে ভয় থেকে খুশি ছিলো বেশি। সাতদিন পরে বকুল সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যায়। মালার সুস্থ হতে প্রায় তিন সপ্তাহের মত লেগে যায়। কদিন পরে মালাকে তার আংকে বলে, দেখ মালা বকুল ছেলেটা অনেক ভালো। তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তুমি চাইলেই ওর ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পার। তুমি আমাদের মেয়ের মতো। মেয়ের মতই থাকবে। মালা বলে কি ব্যাপার আংকেল । তুমি হঠাৎ ওর হয়ে কথা বলছো কেন?
তুমি যে কিডনি দিয়ে বেঁচে আছ, সেই কিডনি বকুল তোমাকে ডোনেট করেছে। সে আমাকে এটাও বলেছে আমি যেন কথাটা তোমাকে না বলি। এখন তুমি দেখো কি করবে।
মালা কথাগুলো শুনে নিস্তবদ্ধ হয়ে যায়। সে নিজকেই নিজে দোষী মনে করে। ইস, ছেলেটা আমার এত ভালোবাসে। সাথে সাথে মালা বকুলকে ফোন করে কোন কথা নাই, সরাসরি বকুলকে আই লাভ ইউ বলে। বকুল আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। আমায় মাফ করে দাও। বকুল বলে, আরে কি যে বলো তুমি। আমি জানি তুমিও কতটা চাপে ছিলে। বকুল খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। পরের সপ্তাহে বকুল মালার সাথে দেখা করতে ঢাকায় আসে। তারপর তাদের একজনের প্রতি আরেকজনের এক অন্ধ ভালোবাসা তৈরি হয়। এভাবে বকুল আর মালা ভালোবাসর মালা গাঁথার দিনগুলো শুরু হয়।