কংসাবতীর তীরে
তেমন কোনো বিত্ত ছিল না আমাদের। ছিল না দৌলতও। টিউশনি করে লেখাপড়া করেছি। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয় নি। পরিবারের প্রয়োজনে একটি এনজিওতে চাকরি নিই। আমার পোস্টিং হয় শেরপুরের নালিতাবাড়ীর ভারতের মেঘালয় সীমান্তবর্তী এক অজপাড়াগাঁয়ে। আমার পদবি ছিল মাঠকর্মী। যারা এনজিও থেকে ঋণ নেয়, তাদের কাছ থেকে ঋণের কিস্তির টাকা আদায় করাই আমার কাজ
ছিল।
আমি এর আগে কখনো এই নালিতাবাড়ী আসিনি। বাড়ি থেকে আসার পথে খুব দুর্ভাবনা করেছি, ওই অপরিচিত জায়গায় গিয়ে কোথায় উঠব, কোথায় থাকব। কিন্তু এখানে আসার পর সেই ভাবনা অনেকটা দূর হয়েছে। আমাদের কেন্দ্রের ম্যানেজার সাহেব অফিস সংলগ্ন একটি ছোট্ট রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
এখানে নিজেই রান্না করে খাই। বেশিরভাগ সময় সকালবেলা রান্না করে তিন বেলা খেয়ে নিতাম। ভাত রান্না করার সময় ভাতের মধ্যে ডিম সেদ্ধ দিতাম। সেই ডিম কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে ভর্তা করতাম। আবার ডিম মামলেটও করতাম মাঝে মাঝে। কোনো কোনো সময় মসুর ডাল ভর্তা দিয়েও ভাত খেয়েছি। মাছ মাংস তেমন কেনা হতো না, কারণ এগুলো কাটাকুটি করে রান্না করে খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এলাকাটি দারুণ প্রকৃতি শোভাময়। অদূরেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। সীমান্ত শুরু হয়েছে সুউচ্চ গারো পাহাড় দিয়ে। সেই পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে এসেছে কংসা নদী। জেনেছি ভারতের শিলং মালভূমির পূর্বভাগে তুরার কাছে এ নদীর উৎপত্তি। কী অদ্ভুত ! যে নদীর জন্ম দিল শৃঙ্গে জমে থাকা মেঘ আর চেরাপুঞ্জির অজস্র বৃষ্টির জলধারা। আর সেই ধারা কী-না বয়ে এলো আমাদের দেশে নদী হয়ে। কী স্বচ্ছ এর জল। পাথর, পাথরকুচি আর সিলিকন বালু এই নদীর অতল দিয়ে ভেসে আসে এ দেশে ।
এই নদীর এখানে অন্য নাম -- ভোগাই। নাহ্ আমি তাকে সে নামে ডাকতাম না। ভালো লাগতো না এই নামটি। আমি ওকে কংসাবতী বলে ডাকতাম। আমিই ওকে ডাকি, আমি তা শুনি। আমিই তার অপরূপ রূপ দেখি।
আমার তেমন কোনো বন্ধু ছিল না এখানে। তাই এই নদীটাকে আমি আমার বন্ধু করে নিয়েছিলাম। এর কূল ধরে হাঁটতাম, কত সন্ধ্যা নেমেছে কংসাবতীর তীরে, কত সূর্য ডুবে গেছে গারো পাহাড়ের শৃঙ্গের আড়ালে। অস্তাচলের কত সোনালি আভার দিগন্ত আঁধারে কালো হয়ে গেছে। মনে হতো জীবনের সব গান হারিয়ে ফেলেছি ওই দূর আকাশে, ওই পাহাড় শৃঙ্গের ঘন লতাগুল্মের নিভৃতে ।
এই কংসাবতীর তীরের একটি গ্রাম নয়াগাঁও। আমাদের এনজিওর একটি কেন্দ্র ছিল এখানে। কেন্দ্রটির অফিসিয়াল নাম দেওয়া হয়েছিল 'সন্ধ্যাতারা'। এই কেন্দ্র থেকে গরীব, দুস্থ ভূমিহীন মেয়েরা ঋণ গ্রহণ করত। আছিয়া, নুরজাহান, নুরী, বুলবুলি, নসিরণ, জরিনাসহ আরো এমন অনেক মেয়ে এই সন্ধ্যাতারা কেন্দ্র থেকে ঋণ নিয়ে তারা নিজেদের স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে। শাখার ম্যানেজার সাহেব প্রথম দিনই ঋণ গ্রহিতাদের তালিকা আমাকে দিয়ে বললেন -- এই সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে আপনাকে কাজ করতে হবে। তিনি এই ব্যাপারে আমাকে আরও কিছু প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দিলেন।
প্রথম দিনের কথা….
শাখা অফিস থেকে কংসাবতীর তীর ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম নয়াগাঁও সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে। তখন ছিল আশ্বিন মাস। কংসাবতীর বুক ভরা অথৈ জল। কংসার স্বচ্ছ পানির উপরে পড়েছে শরতের সাদা মেঘের ছায়া। জলের উপর রোদ্দুর ঝিলমিল করছে। নদীর কূল ধরে যখন হাঁটছিলাম তখন দেখছিলাম জল আর মেঘ-রোদ্দুরের খেলা। আরেক দিকে দেখছিলাম হলুদ ফুলের সরিষার ক্ষেত। ফড়িং আর প্রজাপতি এসে পড়ছিল গাদা গাদা ফুলের উপর। অদূরে দেখতে পাই একটি প্রাচীন বটবৃক্ষ। কোথাও একটি মানুষও নেই। একদম বিজন। বটবৃক্ষটি পার হয়ে সামনের দিকে হাটঁতে থাকি।
তখন বেলা বারোটা হবে। নয়াগাঁও গ্রামের নিকটবর্তী হতেই দেখতে পাই -- একটি স্ত্রীলোক নির্জন কংসাবতীর জলে নেমে স্নান করছে। বক্ষের বসন ঈষৎ উন্মোচন করা, সাদা ঝকঝকে গায়ের রং, হাতে বালা, পরনে লালপাড় শাড়ি, বয়স চব্বিশ বা পঁচিশ হবে। স্ত্রীলোকটি প্রথমে আমাকে দেখতে পাননি, যখন আমাকে দেখতে পান, তিনি লজ্জাশীলা হয়ে উঠেন। বুকের বসন ঠিক করে নদীর কূলে অবস্থিত তার বাড়ির দিকে হেঁটে চলে যান।
তখন আমার বয়সই কত ! বিশ হবে। একজন উচ্ছল তরুণ, বিয়ে করি নি। আমি অত বড় বিদ্বান ব্যক্তিও ছিলাম না। তেমন কিছু পড়া হয় নাই উপন্যাস, গল্প, নাটিকা। পড়লে বুঝতে পারতাম -- মঞ্জুলিকা, বাসন্তী, শকুন্তলা, বিনোদিনী, অভিসারিকা এইসব কী! কিন্তু সেদিন সেই আশ্বিনের মিষ্টি রোদের নিচে কংসাবতীর জলে যে রমণীকে স্নানরত দেখলাম-- তা আমার তরুণ হৃদয় মনে একধরনের মদিরার মতো চির আসক্তির অনুভব হয়ে থাকল।
নয়াগাঁও গ্রামে ঢুকে কেন্দ্র প্রধান নুরজাহান খাতুনের বাড়িটি খুঁজে বের করি। আমি নুরজাহানের বাড়িতে ঢুকে আমার পরিচয় দেই। নুরজাহান আমাকে সালাম দিয়ে বলে –
'স্যার আপনি বসেন। আমি সব সদস্যদের ডেকে নিয়ে আসি।'
আমি উঠোনে একটি কাঠের চেয়ারে বসে থাকি। আমার ভালোই লাগছিল এই জন্য যে, সামান্য একটা চাকরি করি। আর এই মেয়েটি কিনা আমাকে স্যার ডাকল। আমাকে তাহলে এখানকার সবাই স্যার ডাকবে।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে প্রায় বিশ-বাইশ জনের মতো মেয়ে জড়ো হলো। তাদের সবার বয়স কুড়ি থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। আমি ওদের কাছে আমার পরিচয় দিলাম -- বললাম, 'আমার নাম আনিসুর রহমান। এই কেন্দ্রে নতুন জয়েন করেছি। আমার বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ি থানায়। শাখা অফিসেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আমি নবীন, অল্প বয়স। আপনারা আমাকে স্যারও ডাকতে পারেন, আবার আনিস ভাইও ডাকতে পারেন।' নুরজাহান বলে উঠল-- স্যার, আমরা সবাই আপনাকে স্যারই ডাকব। '
সবাই তাদের ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তিগুলো আমাকে দিয়ে তাদের জমা বইয়ে এন্ট্রি করে নিচ্ছিল। একটি মেয়ে ঘোমটা টেনে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। সে আসছিল না আমার কাছে। নুরজাহান ওই মেয়েটিকে ডেকে বলে -- ও জরী, তুই দাঁড়িয়ে রইছোস ক্যান, কিস্তি জমা দে।'
মেয়েটি ঘোমটা টেনে মৃদু পায়ে আমার কাছে এসে টাকা ও জমা বইটি আমার হাতে দেয়। আমি ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দেখলাম তার মুখ। এ যে সেই মেয়ে যাকে আমি কংসাবতীর জলে স্নানরত দেখেছিলাম। জমা বইতে নাম দেখলাম—মোছা. জরিনা খাতুন, স্বামী -- সোলাইমান মিয়া, সাকিন -- নয়াগাঁও। মেয়েটি আমার দিকে একবারও তাকাল না। খুব সলজ্জ ভঙ্গিতে টাকা জমা দিয়ে চলে গেল।
সেদিনের মতো কাজ শেষ করে চলে আসি। ফিরে আসছিলাম কংসাবতীর তীর ধরে। নদীর জলগুলো কেমন স্থির হয়ে আছে। বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতের প্রান্তরের দিকে তাকালাম-- ফুলগুলো দুপুরের রোদে ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। বটবৃক্ষের তলে যেয়ে দেখি -- একটি মধ্যবয়সী গারো গায়েন বসে গান গাইছে বাঁশের দোতারা বাজিয়ে। আমি তার গান শুনি। কী অপূর্ব গাইছিল। ওর গানের ভাষা আমি বুঝিনি, কিন্তু গানের সুরটি ছিল দুঃখের।
রুমে এসে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিই। বিকালবেলা কংসাবতীর তীরে গিয়ে চুপ করে বসে থাকি। নদীর নীরব তরঙ্গধ্বনি শুনি। গারো পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে সূর্য অস্তমিত হতে থাকে। সোনালী আভা সরিয়ে ক্রমে আকাশ ধূসর হয়ে উঠে। তারপর অন্ধকার নামে আদিম গুহার আঁধারের মতো। সেই আঁধার জগতে একটি সিক্ত বসনার রমণী মূর্তি ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল। যাকে আমি দেখে এসেছিলাম আজ কংসাবতীর তীরে।
রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম অনেক কথা। ঘুম আসছিল না চোখে। মধ্য প্রহরে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়কে দৈত্যের মতো লাগছিল। একবার মনে হলো -- কংসাবতীর তীরে যেয়ে ঘুরি। কিন্তু এত অন্ধকার যে, ওই জনমানবহীন নদীর তীরে যেতে শঙ্কা লাগছিল। বারান্দা থেকে রুমে এসে আবার শুয়ে পড়ি। তারপর কখন ঘুমিয়ে যাই জানতে পারিনি।
সপ্তাহে একদিন আমাকে নয়াগাঁওয়ে সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে যেতে হতো। বাকি কর্ম দিনগুলোতে অফিসে কাজ করতাম। নয়াগাঁও কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সারা সপ্তাহ উন্মুখ হয়ে থাকতাম।
একদিন নয়াগাঁও যাওয়ার জন্য বের হয়েছি। যখন বের হয়েছি তখন ঝকঝকে রোদ ছিল। সেই একই রাস্তা, একই নদীর কূল ধরে চলেছি সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রের দিকে। অর্ধ রাস্তা যাওয়ার পর হঠাৎ আকাশে মেঘ হয়। প্রাচীন বটবৃক্ষের কাছে যাওয়া মাত্র ঝমঝম করে বৃষ্টি নামতে থাকে। আমি বটগাছের নিচে দাঁড়াই। কিছুটা বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেলেও ভিজে যায় জামা ও মাথার চুল। বৃষ্টি ছাড়লে আমি আবার রওনা হই। ভেজা শরীর নিয়েই নয়াগাঁও পৌঁছি।
জরিনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে আমি যাচ্ছিলাম। বাড়ির আঙিনা থেকে জরিনা আমাকে ভেজা অবস্থায় দেখে ফেলে। একটি ছয় সাত বছরের বালক কাছে এসে বলে -- 'আপনাকে মায়ে ডাকছে।' আমি দেখলাম--জরিনা ঘোমটা মাথায় দিয়ে বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে যেতেই সে মুখ আড়াল করে বলে--'আপনি ভিজে গেছেন। বারান্দায় টুলের উপর বসেন।'
আমি টুলের উপর বসি। জরিনা একটি গামছা এনে দিয়ে সেই একই রকম মাথায় ঘোমটা টেনে বলে -- 'এইটা দিয়ে মাথা মুছে নিন। আপনার ঠাণ্ডা লেগে যাবে।'
মাথা মুছে এবং জামা একটু শুকিয়ে নিয়ে নুরজাহানের বাড়ি যাই। সেদিনও জরিনা মাথায় ঘোমটা দিয়ে কিস্তির টাকা আমার কাছে এসে জমা দিয়ে যায়। জরিনার এমন ঘোমটা দেওয়া দেখে নুরজাহান ওকে বলে -- 'কী লো জরী, তুই মাথায় এমন ঘোমটা দ্যাস ক্যান? স্যারেরে দেইখা তুই কি লজ্জা পাস? '
কাজ শেষে কাঠের চেয়ারের উপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। দেখলাম, জরী মুখ ঘুরিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সলজ্জিত মুখখানি দেখতে বড়ই সাধ হয়। জরী মনে হয় -- ওর সেদিনের সেই নির্জন নদীর কূলে ঈষৎ উদোম হওয়া দেহখানি দেখেছি যে, সেই লজ্জা ঘোমটা দিয়ে আড়াল করে ফেলতে চাইছে। কিন্তু জরী জানে না--তার সেই অপরূপ রূপ আমার অন্তরের কোণে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে রেখেছে।
সেদিনও পথে আসতে আসতে চেয়ে দেখছিলাম কংসাবতীর জল। কেমন অতৃপ্ত বিষাদ বাতাস ঝাপটার বেগে আমার দেহ মনে এসে লাগল। কেমন শীতল অনুভব হলো -- জরি আমার সব না। কেউ না। কিন্তু আমি এই কদিনে অনেক কিছু ভেবে বসলাম। জরির মতো এমন একটি মেয়েকে নিয়ে এমন ভাবনা করা ঠিক নয়। জীবনের মধুকাল তো ধরতে গেলে শুরুই হয়নি। সামনে আরও কত সময় আসবে। দেখা পাব কত কুমারী মেয়ের। কত উদ্যোত প্রস্ফুটিত সন্ধ্যামালতী ফুল ফুটে থাকবে পুষ্প কাননে। যা কিছু পাব তার গন্ধ বিলাস উপভোগ করব। তখন মনে হবে আমিই জগতের সুখী মানুষ।
বিকাল বেলা রুম থেকে বাইরে আর বের হলাম না। শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। ঘরে আলো জ্বালাতে ইচ্ছা করল না। অন্ধকারেই শুয়ে থাকলাম আরও কিছু সময়। তারপর উঠে আলো জ্বালাই। সকালের রান্না করা ভাত খেয়ে নিই। খেয়ে বিছানায় এসে আবার শুয়ে পড়ি। আজও চোখে কোনো ঘুম নেই। আজও দরজা খুলে বাইরে আসি।
নিস্তব্ধ তারাভরা রাত্রি। কংসাবতীর পাড় থেকে হু-হু হাওয়া বইয়ে আসছিল। এই রকম তারাভরা অন্ধকার আকাশের তলে দাঁড়ালে কত কথা মনে আসে। জীবনের গ্লানিগুলো মনে জাগে। আবার কত পাওয়া আঁধারে হারিয়ে যেতে থাকে। আসলে জীবন বড়োই পলাতকা। পাওয়া হয় না কোনো কিছু, যা আমি চাই।
আর একদিন যখন নয়াগাঁও যাই, পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, আহা! আজ যদি জরী ওর ঘোমটাখানি সরিয়ে ফেলত। তাহলে প্রাণভরে দেখে নিতাম ওর মুখ, স্থির শান্তদৃষ্টিতে আমার দিকে যদি একবার চাইতো। ওই সুশ্রী মুখ যে আমি এখনো মন ভরে দেখিনি। ওই চোখ নিশ্চয়ই ডাগর কালো হবে। ঠোঁটের নিচে আলগা ভাঁজ আছে, হাসলে নিশ্চয়ই গালে টোল পড়ে। এর আগে ওকে যতটুকু দেখেছিলাম তা দূর থেকে। দেখতে না দেখতে সেই শুভ দৃষ্টি মিলিয়ে গিয়েছিল বিন্দুর মতো। জরীর বাড়ির কাছে যেয়ে ওকে খুঁজলাম, কিন্তু আজ সে বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে নেই।
সন্ধ্যাতারায় যেয়ে দেখলাম -- জরী দূরে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। কারোর সাথে কথা বলছে না। আজও নীরবে এসে সবার আগে কিস্তির টাকা দিয়ে চলে গেল। জরীর সাথে কথা বলার তেমন সুযোগ নেই। আর বললেও মাথা থেকে ঘোমটা তো সে সরাবে না।
জরী তাড়াতাড়ি করে চলে যাওয়াতে মন ভালো লাগছিল না। সকালে আমি কোনো রান্না করে খেয়ে আসিনি। অভুক্ত ছিলাম। পেটে খুব ক্ষুধা ছিল। দ্রুত কাজ সেরে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে পড়ি। জরীর বাড়ির পাশ দিয়ে যখন আসছিলাম, তখন দেখি-- জরী পথের উপরে একটি ছোট্ট টোপলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টোপলাটি আমার হাতে দিয়ে বলে-- আপনার মুখটি খুব শুকনো দেখেছিলাম। এর ভিতর কিছু খাবার আছে। ঘরে গিয়ে খেয়ে নেবেন।'
আমি বললাম -- তুমি একটু ঘোমটা সরাও না জরী। তোমাকে একটু দেখি।
-- না।
-- কেন না।
-- এই মুখ আপনাকে দেখাতে লজ্জা করে।
জরি আরও বলছিল-- আমি যাই। আপনার সাথে একাকী দাঁড়িয়ে কথা বলছি, কেউ দেখে ফেললে আমার বদনামি হবে। আমার স্বামী আমাকে মারধর করবে। আপনি জানেন না, সে একটা কসাই।
ঘরে এসে টোপলাটা খুললাম। টোপলার ভেতর তেলের পিঠা, নারিকেলের কুশলি পিঠা, আর মুড়ির কয়েকটি মোয়া দেখলাম। আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা ছিল। আমি বেশ পরিমাণ খেয়ে নিলাম।
এরই মধ্যে সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে আমার কাজ করা দুই মাস পূর্ণ হয়। প্রতি সপ্তাহেই জরীর সাথে কেন্দ্রে আমার দেখা হতো। ঘোমটা টেনে কোনো কথা না বলে কিস্তি দিয়ে নিঃশব্দে সে চলে যেত। আমার দিকে একটুও তাকাত না। ওর বাড়ির কাছে দিয়ে আসা যাওয়ার পথে ওকে খুঁজতাম ওর আঙিনায়। ঘোমটা টেনে মাঝে মাঝে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত অদূরে। দেখতাম ওকে দূর থেকেই।
দুই মাস পূর্ণ হওয়ার প্রেক্ষিতে আমাকে অন্য একটি কেন্দ্রে বদলি করে। এরপর থেকে নয়াগাঁও সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে আমার আর যাওয়া হতো না। মনটা প্রায়ই বিষণ্ণ হয়ে থাকত। যেখানেই যাই, কেমন যেন অবসন্ন লাগত। সন্ধ্যায় ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম কংসাবতীর তীরে। নদীর জলের দিকে তাকিয়ে বলতাম -- 'আমার সাথে তুমি একটু কথা বলো। তোমার জলে আমাকে টেনে নাও।' সেই ধূসর সন্ধ্যায় বক ও বালিহাঁসগুলো নদীর চরাচর ছেড়ে উড়ে চলে যেত গারো পাহাড়ের দিকে। হয়ত ওখানেই ওদের বাসা। ওখানেই ওদের কুলো।
নদীর কূলেই রাত্রি নেমে আসত। নদীর কোনো কথাই শোনা হতো না। আকাশ ভরা নক্ষত্রবীথি তখন জ্বলে উঠত। ফিরে আসি ঘরে। আমি কী বুঝি কোনো গান, কোনো সুর। জীবন মর্মরে তখন অন্য কথা বাজে --
'যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস—আকাশ তোমার। জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে পারো তুমি...'।
আরও চার মাস পর ---
আমার বদলি অর্ডার আসে জেলা সদর অফিস থেকে। ইতোমধ্যে বাড়িতে আমার দাদাজানের পীড়াপীড়িতে আমার বিবাহ ঠিক হয়ে যায়। আমার দাদা খুব অসুস্থ। মৃত্যুর আগে সে তার নাত বউকে দেখে যেতে চায়।
আমি শাখা অফিসে সমস্ত খাতাপত্র ও হিসাব নিকাশ বুঝিয়ে দেই। ব্যবস্থাপক সাহেবকে বলি, আমার চাকরি জীবনে প্রথম যাদের নিয়ে কাজ করেছিলাম, নয়াগাঁও এর সন্ধ্যাতারার সেই মেয়েগুলোর কাছ থেকে একটু বিদায় নিয়ে আসতে চাই। উনি আমাকে অনুমতি দিলেন এবং বললেন -- 'যান, দেখা করে আসেন নুরজাহান, নুরী, নসিরন ও জরিনাদের সাথে।'
আমি আজও গেলাম নয়াগাঁওয়ে সেই প্রথম দিনের মতো কংসাবতীর তীর ধরে একাকী হেঁটে হেঁটে। যেদিন প্রথম যাই -- সেদিন ছিল শরতের রোদ্দুর। আজ চৈত্রের দুপুর। সেদিন মাঠ ভরা ছিল সরিষা ফুলের হলুদ প্রান্তর। আজ ধু-ধু বিস্তীর্ণ খালি মাঠ। সেদিন ছিল কংসাবতীতে ভরা জল, আজ সেখানে স্বল্প পাথুরে পানি, বালি আর নুড়ি।
পথের পাশে বৃক্ষগুলির পাতা চৌচির হয়ে ঝরে পড়ছে। ধুলো উড়ছে। পাখিদের সুমধুর গান নেই। কংসাবতীর জলে ঠোঁট চুবিয়ে জল খাচ্ছে তৃষিত কয়েকটি বক ও পানকৌড়ি। রুক্ষ বাতাস এসে লাগছিল আমার গায়ে। একসময় প্রাচীন সেই বটবৃক্ষ তলে এসে দাঁড়াই। আজ আর কোনো গায়েন নেই এখানে। একটু জিরিয়ে আবার নয়াগাঁও এর দিকে হাঁটতে থাকি।
একসময় নয়াগাঁও-এ জরীদের বাড়ির কাছে চলে আসি। কংসাবতীর তীরে যে ঘাটে জরী সেদিন স্নান করেছিল, সেখানে এসে দাঁড়াই। আজ আর সেখানে জরী স্নানরত নেই। কিন্তু আমার মানসপটে দেখতে পাচ্ছিলাম, সেদিনকার সেই স্বর্গীয় দৃশ্য ! একটি পল্লীবালা, যার দেহবল্লরী ছিল এই কংসাবতী নদীর মতো উচ্ছলা, স্বচ্ছ জলের ঢেউ আছড়ে পড়ছিল যেন শরীরের বাঁকে। আজও কম্পিত হলাম কিছু মুহূর্তের জন্য। চোখ ফিরিয়ে আনলাম কংসাবতীর জল থেকে।
আমি জরীর বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। ওর বাড়ির আঙিনায় যেয়ে দেখতে পাই ওর ছেলেটাকে। ওকে বলি -- 'তোমার মাকে একটু ডেকে নিয়ে আসো। ও যেয়ে বলো -- তোমার স্যার এসেছে।'
জরী ঘর থেকে বের হয়ে আসে। আজকেও সে ঘোমটা টেনে আমার কাছে এসে দাঁড়ায়। আমি জরীকে ডাকি -- জরী।
-- জ্বী।
-- কেমন আছো তুমি?
-- ভালো।
-- জরী...
-- বলেন।
-- আমার বদলি হয়েছে, আগামীকালই চলে যাচ্ছি এখান থেকে।
-- আর আসবেন না?
-- না।
জরী কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। কেমন যেন স্থির এবং নির্বাক। কথা বের হচ্ছিল না মুখ থেকে। আমি আবার ওকে ডাকি -- জরী...
জরী কথা বলছে না।
আমি জরীকে বললাম -- 'আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তোমাদের সবাইকে আমি নিমন্ত্রণ করব। তুমি যাবে না আমার বিয়েতে? '
জরী এবার মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি খুব কাছে থেকে দেখলাম তার বিষাদস্নাত ম্লান মুখ ও চোখ। দেখলাম, ওর চোখ দুটো জলে ভরে আছে ! কংসাবতীর জলের মতো সেই জল স্বচ্ছ ও নির্মল।
পরিশিষ্ট --
আমার সেই অল্প বয়সের জীবনঅধ্যায় শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সেই জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা ভেবে এখনকার জীবনেও অবসাদ নামে। হঠাৎ মন কেমন করে ওঠে। হারানো মধুময় কোনো দৃশ্য কখনোই আর দেখতে পাব না। সেইসবের জন্যে আক্ষেপও নেই। মহাকালের বীথিপথের দিকে চোখ মেলে দেখব -- কংসাবতীর তীরে এক পল্লী রমণী হাঁটছে ফিরছে, জলের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছে। দক্ষিণা শীতল হাওয়া এসে তার শরীরে লাগছে, তার মাথার চুল উড়ছে।
আমি যা পেয়েছিলাম, তা সত্য। আবার হয়ত কখনো পাব তা, এটি আশা। পেলেও তা আবার ফুরিয়ে যাবে, এটা অমোঘ।
আরএ/