প্রয়াণ
একবার যদি তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকতে শিখে যাই, তাহলে তোমার সংসর্গও আমার কাছে বিরক্তিকর ঠেকবে। তখন তুমি বাঁচবে কার স্পর্শ নিয়ে? কাকে বিলিয়ে দিবে তোমার প্রণয়? কার জন্য চোখে জমিয়ে রাখবে কান্না, কার জন্য ভালবাসার বাঁধ ভেঙ্গে সৃষ্টি করবে খুশির বন্যা? শিবলীর কথার বৃষ্টিতে চমকিতা বনে যায় অপূর্বা। কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। চুপ করে থাকবে, নাকি জড়িয়ে ধরবে ওর হাতটা, বুঝে উঠতে পারছে না।
এক বছরের অন্তরঙ্গতায় শিবলী এতটুকু বুঝতে পেরেছে অপূর্বা ইন্ট্রোভার্ট বা অন্তর্মুখী স্বভাবের মেয়ে। অন্য সব মেয়েদের চেয়ে একটু অন্যরকম। ওর হাসিতে লুকিয়ে থাকে অদ্ভুত রকমের কান্নার সিলমোহর। কান্নাতে লুকিয়ে থাকে ভীষণ রকমের মায়ার আলপনা। কিন্তু শিবলীর মনে একটা প্রশ্ন বারবারই জট পাকিয়ে উঠে, 'ও আমাকে বুঝতে পেরেছে কতটুকু? বুঝবার চেষ্টা করছে কি কখনো!" উত্তরের খোঁজে মরিয়া হয়ে উঠে ওর মন।
অপূর্বা চুপ করে থাকে। স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ওর পাশে। বিদিশার চুলের কালো রঙে ছেয়ে উঠে চারপাশ। হঠাৎই কিছু না বলেই রিকশা ডেকে উঠে পড়ে অপূর্বা।
বুকফাটা কষ্ট নিয়ে ঘোলা চোখে তাকিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখে শিবলী। চাইলে সবার সামনে খুব জোরে ওর হাতটা চেপে ধরে উত্তরটা জানতে পারতো। কারণ সেই অধিকারটা আছে ওর। তবুও চশমাটা খুলে আবার তাকায় ওর দিকে। কিন্তু এবার সত্যি সত্যি-ই সবকিছু ঘোলাটে লাগছে ওর কাছে।
তাহলে ওদের প্রেমটাও কি ঘোলাটে কিছু স্মৃতি মাত্র! মেয়েটা কি তাহলে প্রেমের অভিনয় করেছে ওর সাথে। মনে মনে ভাবে, মেয়েরা কি এভাবেই অভিনয় করে প্রেমের! কত টাই না আপন করে নিয়েছিল ওকে। ও ভাবতে লাগে সেদিনের ঘটনা কিভাবে ভুলে গেল অপূর্বা। স্মৃতিরা এসে আঘাত হানে ওর বুকে আর নিউরন স্মরণ করে সেই ঘটনা-
-এই শুন না!
-কি?
-থাক বলবো না।
-কি হয়েছে বলো।
-ইচ্ছে করছে...
-কি ইচ্ছে করছে?
-ইচ্ছে করছে তোমার বুকে মাথা দিয়ে হাঁটি।
-বুকে মাথা রেখে কি হাঁটা যায়?
-আমি জানি না। আমি হাঁটবো। তোমার বুকে মাথা রেখেই হাঁটবো।
-আচ্ছা। ঠিক আছে। এই বুকটা তো তোমারই।
-সত্যি!
-হ্যা, সত্যি।
-কতটুকু সত্যি?
-সত্যি তো সত্যিই। এক সত্যি, দুই সত্যি, তিন সত্যি- একশো বার সত্যি। এবার খুশি!
-অনেকটা, খুশি।
-দেখ অপূর্বা, চন্দ্রিমা কি অপরূপা! কি মায়াবতী! কি সুন্দরী! সোনালী রঙের মসলিন শাড়িতে কি সুন্দর লাগছে ওকে।
-এই চন্দ্রিমা কে? কোথায় চন্দ্রিমা। আমি কাউকেই তো দেখছিনা।
-চন্দ্রিমা আমার বুকে।
-একটু আগে না বললে, এই বুকটা আমার। এখন মিথ্যে বলছো কেনো?
-মিথ্যে বলবো কেন!
-এই দেখো আমার বুকে চন্দ্রিমা।
-কোথায়! দেখি। ওকে আজকে নাস্তানাবুদ করেই ছাড়ব। কেউই তো নেই তোমার বুকে।
-চন্দ্রিমা তো চাঁদের আলো। মিষ্টি চাঁদের আলো নববধূবেশে লাজুক বদনে এসে মিশেছে আমার বুকে। তবে তুমি কিন্তু আছো সবসময় আমার অনুভবে। চাঁদের কিরণের চেয়েও বেশি অপরূপা তুমি। তুমিই তো আছো আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে, হৃদয়ের কোয়াড্রেট, কডেটে।
-তাহলে এতো ঢং করার কি দরকার ছিলো। আমার চোখের জল ঝরানো ছাড়া কি তোমার শান্তি হয় না।
-পাগলী টা কাঁদছে কোনো! এত ছোট একটা বিষয়ের জন্য কি কাঁদতে হয়!
-হ্যা, আমি কাঁদব এখন। হাউমাউ করে কাঁদব।
-এই কাদতে হবে না প্লিজ। একটা জিনিস দেখবে।
-কি!
-দেখো দুটো পাখির ছায়া।
-উপরে চেয়ে দেখো ছাদের উপরে দুটো পাখি।
-কি ভালবাসা পাখিদের মধ্যে, তাই না?
-হ্যা, পাখি দুটো কত কাছাকাছি বসে আছে। মনে হচ্ছে সাত জনমের বাঁধনে বেঁধে আছে ওরা এক সুতোয়।
-ওদের সময়গুলো কতটা আবেগঘন, তাই না?
-আস্তে কথা বলো না হয় পাখি দুটো উড়ে যাবে।
-আচ্ছা, আচ্ছা। ঠিক আছে। সারাটি জীবন এভাবে পাশে থাকবে তো আমার?
-কেনো থাকব না, বলো! তুমি-ই আমার সবকিছু। আমি তোমাতেই রবো চিরকাল।
পুরনো সেই স্মৃতি মনে উঠতেই চোখের কোণে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করে। মন খারাপ হলে নিভৃতে মৌনী হয়ে তাকিয়ে থাকে শিবলী। রাস্তার মাঝে থ হয়ে বিজন চাওনি তে দেখে ওর চলে যাওয়া। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ব্যস্ত পথের জীবন্ত যানবাহনের দিকে। সবকিছুই ছুটে চলছে আপন গতিতে। জীবনটা কি এরকমই! চলে যায় যে যার মতো।
হঠাৎই ট্রাক এসে আঘাত করে পেছন থেকে। এরকম আঘাতে কেউ বেঁচে ফিরতে পারে না। কিন্তু রক্তাক্ত দেহে প্রাণটা এখনও আছে। নিয়ে যাওয়া হয় কমিউনিটি বেসড মেডিকেল হসপিটালে। কিছুক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতে চলে আসে হলের সব বন্ধু বান্ধব। এই প্রথম একসাথে এতগুলো যুবক ছেলে কাঁদছে। বন্ধুগুলো আসলে এই রকমই হয়। জগতে মৃত্যুটা মাঝে মাঝে খুব কঠিন, আবার মাঝে মাঝে খুব সহজ। শিবলীও মরে যেতে পারতো। কিন্তু মরবে কিভাবে, ভালবাসার উত্তরটা যে এখনও বাকি রয়ে গেছে। তাই হয়তো সৃষ্টিকর্তা ওকে প্রাণে মারে নি, বাচিয়ে রেখেছে সেই উত্তরের আশায়।
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ছিল তিনদিন। দুনিয়াতে ওর আপন বলতে আছে মমতাময়ী এক মা। ছেলের খবর শুনে নীলফামারী থেকে ছুটে এসেছে মা আর মামা। বাবা নেই। দশ বছর আগে মারা গেছে রোড এক্সিডেন্টে। তাই মায়ের চিন্তার অন্ত নেই। মায়ের মনে বারবারই জাগে শমনের ভয়। মা ছেলের শিয়রে বসে কাঁদে আর হাত তুলে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে প্রার্থনা করে সৃষ্টিকর্তার কাছে। সৃষ্টিকর্তা হয়তো ওর মায়ের প্রার্থনা সেদিন কবুল করে নিয়েছিল।
চারদিন পরেই ও মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠে। কিন্তু ডাক্তার বলে দেয় পনেরো দিনের আগে বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। আশেপাশে ও প্রতিদিনই খুঁজে বেড়ায় অপূর্বার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু খুঁজে পায় না একটি বারের জন্যেও। কতটা নির্মম হৃদয়ের মেয়ে অপূর্বা!
একটি বারের জন্যও দেখতে আসতে মন চাইল না ওর। অতীতের রঙিন আলপনা মাখা স্মৃতিগুলো বারবার আঘাত দিয়ে যায় ওর পীড়িত দেহের ভীত মনটাতে।
এদিকে অপূর্বার মনটাও খারাপ। কেন খারাপ তা ও জানে না। মেয়ে মানুষের কান্নাটা খুব রহস্যের। ওর কান্নাটা আরও বেশি রহস্যের। ওর মন কেন জানি আতঙ্কের স্পন্দনে কম্পিত হয়ে উঠে। মনে হচ্ছে ও হারাতে চলেছে আপন কাউকে। কিন্তু হারাবেই বা কাকে! সেদিনের ঘটনার পর রাগ করে ভেঙ্গে ফেলেছে নতুন কেনা মুঠোফোনটি। অকারণে মায়ের সাথে রাগ করে চলে এসেছে নানু বাসায়। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে ১৬ নং হাউসিং সোসাইটির বিপরীতে ওর নানু বাসা। কিন্তু মনটা কেন খারাপ তার কারণ ও খুঁজে পায় না।
শিবলী ওর বন্ধু মেহেদিকে বলেছিল অপূর্বাকে ফোন করে জানাতে। মেহেদি ওকে ফোনে না পেয়ে, ওর কয়েকজন বান্ধবীকে বলে দেয় শিবলীর এক্সিডেন্টের কথা। ওরাও চেষ্টা করেছে অপূর্বার সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু পারেনি।
বিবাগী মনে অপূর্বা তাকিয়ে থাকে আকাশে। রাতের আকাশে দুটো তারাকে পাশাপাশি দেখে খুব হিংসে হয় ওর। ভাবে, সেদিন ওর সাথে এমন করাটা ঠিক হয়নি। ছেলেটা মনে হয় খুব কষ্ট পেয়েছে। এখন ও আবার নিজেই আফসোস করে তখন মনটা অনুগ্র হলো না কেনো! তাহলেই তো ঝামেলা হতো না।
ওর চঞ্চল মন আবার এটাও ভাবে, প্রেমে যদি একটু বিরহের ছোয়া না লাগে, তাহলে তাকে প্রেম বলে না। তখন সেটা হয়ে যায় নিতান্তই ভালো লাগা। ও বুঝে ভালোলাগা এবং ভালোবাসা এক জিনিস নয়। সে হিসেবে ও ভাবে, যা করেছি, ঠিকই করেছি ওর সাথে।
তবে ওর অদ্ভুত আচরণে কষ্ট পেয়ে শিবলী এখন মৃত্যু পথযাত্রী। কোনমতে বেঁচে আছে। ওর কাছে এই সত্যটা এখনো অজানা। কিন্তু অনুভব করছে অশুভ কিছু একটা ঘটেছে। কোন কারন খুঁজে না পেয়ে একান্তে বসে বসে কেঁদে কেঁদে সময় কাটায়।
পাঁচদিন পার হলেই বাসায় ফিরবে। কারণ, ভার্সিটিও অফ আছে। সমস্যা হবে না কোনো।
ওর বাসা ময়মনসিংহের আকুয়ায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনা করছে ফিসারিজ অনুষদে। শিবলী পশুপালন অনুষদের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পরিচয় হয়েছিল গতবছর। ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ দিবসের দিন।আজ মার্চ মাসের দশ তারিখ। এক বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেছে ওদের অপরিচিত থেকে খুব কাছের মানুষ হবার।
অপূর্বার বাসা ময়মনসিংহ হলেও থাকে বেগম রোকেয়া হলে। এদিকে আজকে শিবলীর মাথায় অপারেশন হবার কথা। কিন্তু খুব ভয় পাচ্ছে ও। মামা এসে সাহস দিয়ে যায়, বন্ধুরা এসে সাহস দিয়ে বলে, "কিছু হবে না দোস্ত। তুই আবার সুস্থ হয়ে উঠবি।" ও সাহস পায় বুকে। মা হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। নিজ হাতে খাইয়ে দেয় ছেলেকে। ছেলে বলে, " আর কত কাঁদবে গো মা! এই তো আর কয়েকটি দিন।তারপরেই আমি সুস্থ হয়ে উঠছি।" মা ছেলের কথা শুনে হাসে, তারপর আবার কাঁদে লুকিয়ে লুকিয়ে। সেই কান্না চোখে পরে না শিবলীর।
সন্ধ্যায় অপারেশন হবে। অপারেশন করার সময় হঠাৎই রক্তের প্রয়োজন পড়ে। ও নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত। মেহেদি বিশ্ববিদ্যালয়ের "বাঁধন " সংগঠন কে ফোন দেয় কিন্তু এই গ্রুপের রক্ত নেই। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে গিয়েও পাওয়া যায়নি রক্ত। ডাক্তার বলছে, "রোগীর অবস্থা খুব সিরিয়াস। খুব তাড়াতাড়ি রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে।"
এদিকে কিছুক্ষণ আগেই হলে ফিরে এসেছে অপূর্বা।এসে শিবলীর দূর্ঘটনার কথা শুনে বিবশ হয়ে পড়ে ও। বিশ্ববিদ্যালয়ের এম্বুলেন্স নিয়ে চলে আসে হাসপাতালে। এসে দেখে সবাই কাঁদছে। কোথাও নেই ও নেগেটিভ রক্ত। ও বলে, " আমার ও নেগেটিভ রক্ত। আপনারা প্লিজ রোগীকে বাঁচান। " ডাক্তার ওর রক্তের চেক আপ করে এক ব্যাগ রক্ত নিয়ে যায় অপারেশন থিয়েটারে । নার্স আবার চলে আসে ভীত হয়ে। এসে বলে, " আর ও এক ব্যাগ রক্ত লাগবে।" ডাক্তার বলে দেয়," রক্তদাতার শরীর থেকে এরচেয়ে বেশি রক্ত নেয়া সম্ভব হবে না।"
কিন্তু অপূর্বা পাগল হয়ে গেছে। বারবার বলে উঠছে, "যত রক্ত লাগে নিন। কিন্তু আমার শিবলীকে আপনারা বাঁচান। ওকে খুব ভালোবাসি আমি। ওকে ছাড়া বাঁচব না আমি।"
হঠাৎই শুরু হয় ঝোড়ো বৃষ্টি।
ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও ও রক্ত দিতে মরিয়া হয়ে উঠে। একদিকে বিত্তীর্ণ জার্নি, অর্ধভুক্ত দেহে দুই ব্যাগ রক্ত দেয়া! রক্ত নেবার পর অপূর্বা চোখ মেলে না। একদিকে শিবলীর অবস্থা মুমূর্ষু। অন্যদিকে অপূর্বা এখন সিরিয়াস ওয়ার্ডে। এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। এখনও চোখ মেলছে না অপূর্বা। ঝড়ের বেগ আর-ও বেড়েই চলছে। ডাক্তাররা খুব চেষ্টা করছে দুজনকে বাঁচাতে। দুইটা সিরিয়াস ওয়ার্ড থেকে দুইজন ডাক্তার বের হয়ে আসে বেদনাকান্ত মন নিয়ে।
কিভাবে বলবে সেই কথা বুঝে উঠতে পারছে না। সব দোষ-ই যে নিয়তির। নিয়তি কেন নিয়ে আসলো অপূর্বাকে। অপূর্বা যে কতটা ভালবাসে শিবলীকে, শিবলীর আর জানা হলো না। মনে অতৃপ্তি নিয়েই মারা গেলো দু'জনে। খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎই বৃষ্টি কারণ কী? মনে হয় ওদের দুজনের জন্ম দিনেই খুব বৃষ্টি হয়েছিল। তাই হচ্ছে আজও।