মারুফুল ইসলাম
একগুচ্ছ কবিতা
মা
তিনরাত ধরে ঘুমোয়নি মা একবারও
তিনদিন মুখে দেয়নি একনলা ভাত
আহারে তার নাড়িছেঁড়া কলিজার টুকরা
মাটির নিচে একা একা কী জানি কী করে
তার কি আর নাওয়া-খাওয়া-ঘুম আছে
নয়নমণি ছেলেকে অন্ধকারে অভুক্ত রেখে
দুঃখিনি মার গলা দিয়ে কী করে নামবে ভাতের দলা
শহরে যেতে চাইত না ছেলেটা
ছোটবেলায় বাপ হারিয়ে কেমন যেন সারাক্ষণ মার বুকে লেপ্টে থাকত
যত কথা, যত গল্প, যত গান সব তার মার সাথে
যত সাধ আহ্লাদ রাগ অভিমান মার সাথে
গোসল করতে গেলেও মাকে বসে থাকতে হয় পুকুরপাড়ে
তিনবেলা ভাত খায় মার হাতেই
অন্যেরা যত হাসাহাসি করে
সে তার মার পেটের ভেতরে আরও ঢুকে পড়ে
ঘুমের মধ্যেও মা
স্বপ্নেও
মা তার পৃথিবী
মা ছাড়া তার আর কেইবা আছে ত্রিভুবনে
কোনো মারামারি ঝগড়াঝাঁটি নেই
কোনো নালিশ নেই
ইশকুলের শিক্ষকেরা বরং দেখা হলে বলত
সোনার টুকরো ছেলে
একদিন গাঁয়ের নাম উজ্জ্বল করবে
মায়ের দুঃখ দূর করবে
হায়রে বাপধন
জন্মদুঃখিনি মায়েরে এ তুই কোন চিরদু:খের সায়রে ভাসিয়ে দিয়ে গেলি রে জাদু
ইশকুলের পরীক্ষায় যখন ভালো ফল করল
সবাই যখন মিষ্টি খেতে চাইল
ছেলের মাথায় হাত রেখে অগোচরে থুতু দিয়ে
আল্লাহর দরবারে আদায় করল হাজার শুকরিয়া
বলল
যা শহরে যা
সবগুলো পাস দিয়ে তুই বড় হ
ওই বটগাছটার চাইতেও বড়
প্রথমবার শহর থেকে ফিরে এসে ছেলের
কত গল্প কত গল্প রাতভর
বলে
মাকে শহরে নিয়ে যাবে
এই দেখাবে
ওই দেখাবে
এটা খাওয়াবে
ওটা খাওয়াবে
বড় বড় গাড়ি চড়াবে
হায় খোদা
সে আর কী গাড়ি চড়বে
এই বড় গাড়িই তো তার বুকের পাঁজরের ওপর দিয়ে ছুটে গেল
কেড়ে নিয়ে গেল বুকের ধন
একাকিনী মায়ের একমাত্র সোনামানিক
মার দুচোখে এখন কোনো জীবন নেই
জগত নেই
সংসার নেই
দিনদুনিয়া নেই
বেহেশত-দোজখ নেই
স্বদেশ নেই
ধর্ম নেই
মানুষ নেই
এ-সমাজ
এ-সময়
এ-প্রতিবেশ
এ-বিধিব্যবস্থা
গাড়িচাপা দিয়েছে মার সবেধন নীলমণি সন্তান
কবরচাপা দিয়েছে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ
আর জীবন্ত কবর দিয়েছে মাকে
আকাশে ধ্রুবতারা ঠায় জেগে থাকে
জেগে থাকে অতন্দ্র কালপুরুষ
নির্নিমেষ জেগে থাকে নীহারিকা
সেই সাথে জেগে থাকে মা
মার চোখে ঘুম নেই
থাকতে পারে না
হে মানুষ
হে আদিমাতার সন্ততি
হে মায়ের গর্ভজাত সন্তান
তোমাদের মায়ের কসম
সাবধান
তোমরা আর কোনো মার বুক খালি করো না
শামিল
আমার মেয়েটাকে আমি মাঝেমধ্যে স্কুলে দিয়ে আসি
কখনো কখনো নিয়ে আসি
গাড়িটা যেখানে রাখি সেখানে কিছু ফেরিওয়ালা ঠেলাওয়ালা সওদাপাতি নিয়ে আসে
ক্রেতা আর বিক্রেতার হুড়োহুড়ি
ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকদের ত্রস্ততা
স্কুলের নিরাপত্তাকর্মী আর কমিউনিটি পুলিশের ব্যস্ততা
যানজট আর ড্রাইভারদের ঝামেলা
এসবের বাইরে কয়েকটা ফুটফুটে বাচ্ছা ছুটে ছুটে আসে
চকচকে চোখে হাত পাতে
ওরা স্কুলের বাইরের ছেলেমেয়ে
স্বদেশ ওদের দায়িত্ব নেয় না
স্বজাতি ওদের দায়িত্ব নেয় না
স্বধর্ম ওদের দায়িত্ব নেয় না
স্বকাল ওদের দায়িত্ব নেয় না
ওদের মৌলিক চাহিদা আছে
কিন্ত মৌলিক অধিকার নেই
ওদের বর্ণ আছে
কিন্তু বর্ণমালা নেই
ওদের শরীর আছে
কিন্তু নিরাপত্তা নেই
ওদের ধর্ম আছে
কিন্তু পূণ্য নেই
ওদের সমাজ আছে
কিন্তু স্বীকৃতি নেই
ওদের প্রশ্ন আছে
কিন্তু কোনো উত্তর নেই
ওরা যৌবনের ধর্ম বোঝার আগেই ধর্ষিতা হয়
বিয়ের ফুল ফোটার আগেই ওদের গর্ভে ফোটে মাতৃত্বের ফুল
ভুলশুদ্ধ বোঝার আগেই ওদের অবরুদ্ধ জীবন মিশে যায় চিহ্নহীন মৃত্তিকায়
তবু ওরা আছে
তবু ওরা আসে
তবু ওরা থাকে
তবু ওরা ডাকে
আমরা কি শুনতে পাই ওদের আহ্বান
যে-আহ্বানে পাখপাখালি আর মেঘের সঙ্গে
উড়ে যায় আদিগন্ত সবুজ ধানখেত আর
দিগন্তহীন সুনীল আকাশ
যে-আহ্বানে পুবের আলো ধেয়ে যায় পশ্চিমের অন্ধকারের অভিমুখে
যে-আহ্বানে একটি মানুষ হয়ে যায় ষোলো কোটি মানুষ
আর ষোলো কোটি মানুষ হয়ে যায় ছয়শো কোটি মানুষ
যে-আহ্বানে দুমড়েমুচড়ে যায় উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু
উত্তরাধিকারের সত্য নিয়ে ওরা যখন আমার দিকে অবিনাশী চোখ মেলে তাকায়
তখন আমি আমার মেয়ের দুচোখে তাকিয়ে দেখতে পাই
আদিহীন অন্তহীন অস্তিত্বের একটি মিছিল
আর সেই মিছিলে আমিও আমার সর্বসত্তা নিয়ে শামিল
চিরদিন বিকল্পবিহীন
জেলখানার নয়া চিঠি
ভোরের বাতাসে ভেজা গন্ধ
কারাগারের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজান
কিন্তু কোন আহ্বানে সাড়া দেবে
ছাব্বিশ বসন্তের পারস্য গোলাপ রেহানে জাবারি
ওদিকে যে ওকে ডাকছে মৃত্যু
ফাঁসির রজ্জু
তুমি তো জানতে, মা
আমি মরতে যাচ্ছি
তবু ফাঁসির রায় শোনানোর পর কেন
তোমার আর বাবার হাতে আমাকে চুমু খেতে দাওনি, মা
মৃত্যুর চৌকাঠে বসে মাকে লিখছে রেহানে
জেলখানা থেকে শেষ চিঠি
মাগো, তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি
কিন্তু এই পুরুষ-পৃথিবী তোমাকে আমাকে ভালোবাসেনি
চায়নি আমরা সুখী হই
নারীদের সুখ চাইতে নেই
অথচ তুমিই তো শিখিয়েছ, মা
শত বিপর্যয়েও আমি যেন কখনোই নারীত্ব বিসর্জন না দেই
আমি যেন চালিয়ে যাই লড়াই
আমার তো সেই মুহূর্তেই মরে যাওয়ার কথা ছিল
ধর্ষণের পর আমার খুন হওয়ার কথা ছিল
আমার রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ভোগ-উচ্ছিষ্ট শরীরের পড়ে থাকার কথা ছিল
শহরতলীর নর্দমায়
এই পৃথিবী কবেইবা মেনে নিয়েছে সেই নারীকে
যে নিজেকে বাঁচাতে পুরুষের বুকে বসিয়ে দেয় ছুরি
তাই আমাকে ছুড়ে দেওয়া হলো
দুঃসহ কয়েদখানার এই নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে
ওরা বলে, আমি ঠাণ্ডা মাথার পরিপাটি খুনি
তুমি তো জানো, মা
এর আগে আমি কোনোদিন
একটা মশা কিংবা আরশোলাও মারিনি
অথচ ওরা আমাকে দিল মৃত্যুদণ্ড
তবু এ নিয়ে কোনো অনুযোগ নেই
কেননা একটা মৃত্যুতেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না
যেহেতু আমি নিজেকে তুলে দেইনি পুরুষের ভোগে
যেহেতু আমি চোখ থেকে ঝরাইনি একটি ফোঁটাও জল
যেহেতু আদালতে আমি ছিলাম আগাগোড়া নিরুত্তাপ
যেহেতু আমি করিনি নতমস্তক প্রাণভিক্ষা
তাই বিচার বিভাগের কাছে মনে হলো
মনে মনে আমি পুরুষালি
অথচ আমার হাতের তালু কী নরম তুলতুলে
লম্বা নখে কী দারুণ জেল্লা
আর আমি কোন দুঃখেইবা হতে যাব হতচ্ছাড়া পুরুষালি
আমি তো তোমার কাছেই আবিষ্কার করতে শিখেছি, মা
নারীত্বের অপাপবিদ্ধ সৌন্দর্য
তবু আমার মাথা মুড়িয়ে দেওয়া হলো নির্জন কারাবাস
নারীত্বের কী নির্মম পুরস্কার
হায় আইনের প্রতি আমার কী সুগভীর আস্থাই না ছিল
তুমিই তো বলেছ, মা
সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অধ্যবসায় প্রয়োজন
তাকিয়ে দেখো সেইসব পুলিশের দিকে
আইনজীবীর দিকে
বিচারকের দিকে
যারা আমার অধিকার পিষে দিয়েছে বুটের নিচে
মিথ্যে আর অজ্ঞানতার কুয়াশায় আড়াল করেছে সত্য
ওরা কি জানে না, মা
চোখের সামনে থাকলেই সব সত্যি হয়ে যায় না
তাই বুঝি মিথ্যে হয়ে যায় অপমৃত্যু
আর হাজার হাজার বছরের অন্যায়-অবিচারের মুখোমুখি
সত্যি হয়ে ওঠে জেলখানার নয়াচিঠি
বৃষ্টি
মা খুব বৃষ্টিতে ভিজত সুযোগে পেলেই
রিকশায় রাস্তায় ছাদে উঠোনে
বারান্দায় বা জানালায় যতটুকু পারত ছাঁট লাগাত
বাবা ওরকম ভিজতে চাইত না
তবে ভালোবাসত বৃষ্টি
মাঝেমধ্যে বাড়িয়ে দিত হাত
ইচ্ছে ছিল একটা কবিতার বই লিখবে
নাম দেবে
বৃষ্টি
ওদের দুজনের ঘরে জৈষ্ঠ্যের খটখটে রাতে
বৃষ্টি এলো
ওদের মেয়ে
নাম রাখল
বৃষ্টি
ফুটফুটে মেয়েটা কাঁদত না একদম
জন্মের পর বহু কষ্টে কাঁদাতে হয়েছে
মা দুধ দিতে ভুলে গেলেও কাঁদত না
বিছানা থেকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে গেলেও না
এমনকি পাশের বাড়ির দুষ্টু ছেলেটা এসে সবার চোখের আড়ালে জোরে চিমটি কাটলেও
ঠোঁট জোড়া একটুকু ফুলে উঠত কেবল
কিছুতেই কাঁদতে চাইত না একেবারে
বড় হয়ে মেয়েটা বৃষ্টি হতে চেয়েছিল
সবাইকে বলত
আমি একদিন ঠিক সত্যি সত্যি বৃষ্টি হয়ে যাব
বগুড়া থেকে ঢাকাগামী রাতের বাসটা খালি হয়ে গেল মাঝপথে
যাত্রী বৃষ্টি একা
কাল সকালেই তার চাকরির পরীক্ষা গুলশানে
বাসের ভেতরে ও বাইরে ভাদ্রের গরম
চালক আর সহযোগী মিলে তিনজন
সকালে ওর মৃতদেহ পাওয়া গেল ভাওয়ালের বনে
চরাচরে বৃষ্টির ক্রন্দন
বৃষ্টি নামের মেয়েটা সত্যি সত্যি বৃষ্টি হতে চেয়েছিল
স্বাধীনতার পুঁথি
এলো আবার ফিরে
এলো আবার ফিরে বছর ঘুরে স্বাধীনতার দিনটা
বুকের মধ্যে কাঁপন তোলে বঙ্গবন্ধুর ঋণটা
আহা সাতই মার্চে
আহা সাতই মার্চে বজ্রকণ্ঠে ঐতিহাসিক ভাষণ
তাসের ঘরের মতো ধসে পাকিস্তানের শাসন
ভুট্টো ইয়াহিয়া
ভুট্টো ইয়াহিয়া টিক্কা খানে ফন্দি ফিকির করে
আগুন ধরায় বাংলাদেশের লাখো লাখো ঘরে
মারে সোনার ছেলে
মারে সোনার ছেলে গুলি করে শহীদ তিরিশ লক্ষ
আজও কাঁদে বাংলা মায়ের রক্তঝরা বক্ষ
তবু লড়াই করে
তবু লড়াই করে বীর বাঙালি অশ্রু মুছে হাতে
লড়াই চলে বাঁচামরার দিনে এবং রাতে
সুর্য ওঠে নামে
সুর্য ওঠে নামে চাঁদের কান্না জোছনা হয়ে ঝরে
নদীর বুকে জোয়ার জাগে সোহাগে আদরে
মাথা তোলে পাহাড়
মাথা তোলে পাহাড় ঝরনা ঝরে সাগর গর্জে ওঠে
রক্তজবা কৃষ্ণচূড়া রুদ্রপলাশ ফোটে
বাজে অগ্নিবীণা
বাজে অগ্নিবীণা বিষের বাঁশি ছোটে বাঁধনহারা
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বোঝেনি কুত্তারা
ওরা মানুষ তো নয়
ওরা মানুষ তো নয় পাকিস্তানি জানোয়ার হায়েনা
প্রাণ দিয়ে পেয়েছি বাংলা রক্ত দিয়ে কেনা
অমর একাত্তরে
অমর একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সংকটে সংগ্রামে
সাত কোটি বাঙালি লড়ে বঙ্গবন্ধুর নামে
লক্ষ্য স্বাধীনতা
লক্ষ্য স্বাধীনতা স্বাধীন বাংলা সোনার বাংলা ভাইরে
মার্চ মাসের এই ছাব্বিশ তারিখ ঘোষণা তার পাইরে
মুক্তিযুদ্ধ চলে
মুক্তিযুদ্ধ চলে জীবনমরণ দীর্ঘ ন মাস ধরে
অবশেষে বিজয় পেলাম ষোলোই ডিসেম্বরে
আজকে বাংলাদেশে
আজকে বাংলাদেশে কোকিল ডাকে সোনায় মোড়া ভোরে
প্রাণের আলোয় নাম লিখেছি হৃদয়ে অন্তরে
আমার সোনার বাংলা
আমার সোনার বাংলা তোমার মাটি
সোনার চাইতে খাঁটি
স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ মাথা তুলে হাঁটি
আমার দেশের মাটি
আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথাখানি
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেই বাংলাদেশের বাণী
সকল কিছুর ঊর্ধ্বে
সকল কিছুর ঊর্ধ্বে জানি সবাই একটাই মর্মকথা
সবার ওপর মানুষ সত্য, সত্য মানবতা