ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৫
দ্য ফার্স্ট ম্যান
কোমলতা আর করুণার যে তরঙ্গ তাৎক্ষণিকভাবে তার হৃদয় ভরে দিয়েছে সে তরঙ্গ যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বাবার স্মৃতির প্রতি ছেলেকে টেনে আনার মতো আত্মার তাড়না, তা বলা যাবে না। এ তরঙ্গ হলো অন্যায়ভাবে নিহত একজন সন্তানের প্রতি বয়সী একজন মানুষের তরফ থেকে সমবেদনা। এখানে কিছু একটা আছে যেটা স্বাভাবিকতার ক্রমকে মানে না। সত্যি বলতে কী, এখানে আসলে বিন্যাসের আদৌ কোনো ক্রমই নেই। বরং এখানে রয়েছে পাগলামি আর বিশৃঙ্খলা: বাবার চেয়ে ছেলের বয়স বেশি। তার চারপাশে সময়ের আবর্তন ভেঙে যাচ্ছে। তবে কবরের ফলকগুলো আর তার বাহ্য দৃষ্টিতে নেই; এগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে নিজে অনড়। আর যে নদী শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে চলেছে তার মধ্যে বছরগুলো নিজস্ব স্থানে নেই। বছরগুলো যেন ঢেউ, তট এবং জলাবর্তের বেশি কিছু নয়। এই জলাবর্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জ্যাক নিদারুণ যাতনা আর করুণার কবলে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আশপাশের আরও কয়েকটা কবর ফলকের দিকে দৃষ্টি ফেলে জ্যাক বুঝতে পারল, এখানে ছড়িয়ে আছে যে বালকেরা তারা বেদনাক্লিষ্ট প্রাপ্তবয়স্কদের বাবা। এই প্রাপ্তবয়স্করা মনে করে, এই বর্তমান সময়ে তারা জীবিত আছে। জ্যাক যেমন নিজেই বিশ্বাস করে, সে এই সময়ে জীবিত আছে; সে নিজেই নিজেকে এই অবস্থায় তৈরি করেছে; নিজের শক্তি এবং ওজস্বিতা সম্পর্কে তার পরিষ্কার ধারণা আছে; নিজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে এবং নিজেকে আয়ত্বের মধ্যে রাখতে সক্ষম সে। কিন্তু এই মুহূর্তের এই অদ্ভূত বিবমিষায় দেখতে, পাচ্ছে প্রত্যেকটা মানুষ একটা করে প্রতিমূর্তি তৈরি করে, বছরগুলোর আগুনের মধ্যে কাঠিন্য তৈরি করে, তার মধ্যে সে নিজেই প্রবেশ করে সেটার পতনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এখন সে দেখতে পাচ্ছে, সেই প্রতিমূর্তি ভেঙে যাচ্ছে, ধসে পড়ছে। অবশিষ্ট আছে শুধু এই যাতনাক্লিষ্ট হৃদয়; চল্লিশ বছর ধরে তার নিজের সঙ্গে রয়ে গেছে পৃথিবীর যে ভয়ঙ্কর বিন্যাস তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বেঁচে থাকতে ব্যাকূল এই হৃদয়। সমগ্র জীবনের গোপনীয়তা থেকে তাকে যে দেয়াল আড়াল করে রেখেছে সেই দেয়ালের বিরুদ্ধে চলছে হৃদয়ের সংগ্রাম। আরো দূরে যেতে, সীমানার বাইরে যেতে, আবিষ্কার করতে, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শেষ বারের মতো এক সেকেন্ডের জন্য এবং চিরকালের জন্য নিজের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে ব্যাকুল এই হৃদয়।
নিজের জীবনের দিকে দৃষ্টি ফেরায় জ্যাক: তার এই জীবন বোকামিপূর্ণ, সাহসী, কাপুরুষসুলভ এবং স্বেচ্ছাচারী। যে গন্তব্য সম্পর্কে সে কিছুই জানে না সেই গন্তেব্যের দিকেই সব সময় ধাবিত হয়েছে তার জীবন। সে জীবন শেষ-অতীতের জীবন; তাকে ওই জীবন দানকারী সেই মানুষটি তাকে ওই জীবন দান করার পরই চলে গেছেন সমুদ্রের অন্য পারে; বিদেশ বিভূইয়ে তার মৃত্যু হয়েছে-সেই অতীত জীবনে আসলে সে কল্পনায় আনার চেষ্টাই করেনি ওই মানুষটির পরিচয়। উনত্রিশ বছর বয়সে সেই মানূষটিও কি পলকা, পীড়িত, চাপা, একগুঁয়ে, ইন্দ্রিয়-পরবশ, স্বপ্নবাজ, নৈরাশ্যবাদী এবং সাহসী ছিলেন না? হ্যাঁ, অবশ্যই। এরকম সব বৈশিষ্ট্যই তার ছিল। আরও বেশি যা কিছু তার ছিল সেগুলো হলো, তিনি তখন ছিলেন জীবিত, তিনি ছিলেন একজন ব্যক্তি মানুষ। যেখানে তার জন্ম সেখানে ওই মানুষটি জীবিত অবস্থায় ঘুমিয়েছেন; একজন অচেনা মানুষের মতো চলে গেছেন। তার সম্পর্কে জ্যাকের মা তাকে জানিয়েছেন, তিনি দেখতে জ্যাকের মতোই এবং তিনি যুদ্ধের ময়দানে মারা গেছেন। যে রহস্য জ্যাক বইপত্রের মধ্যে, মানুষের মাঝে ব্যাকুল হয়ে অনুসন্ধান করেছে সে রহস্য এখন মনে হচ্ছে খুব নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে এই মৃত মানুষটির সঙ্গে, এই অল্প বয়সী বাবার মধ্যে। তার অস্তিত্বের চারপাশে, তার নিজের বেড়ে ওঠার মধ্যে সেই রহস্যের অবস্থান। আর এখন মনে হচ্ছে, সময়ের মধ্যে এবং রক্তের মধ্যে যে জিনিসটি খুব নিবিড়ভাবেই ছিল সেটাকে খুঁজতে সে বহু বহু দূর ঘুরে ফিরেছে। সত্যি বলতে গেলে, সে আসলে এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় কারও সাহায্য তেমন পায়নি। যে পরিবারে তার বেড়ে ওঠা সেখানে সবাই খুব কম কথা বলে। সেখানে কেউ পড়াশোনা জানে না। দুঃখী আর হতোদ্যম মায়ের ওই পরিবারে আর কে আছে? তার মা ছাড়া আর কেউ তাকে চিনতই না। মা ও তার অনেক কিছুই ভুলে গেছেন-এ ব্যাপারে জ্যাক নিশ্চিত। ওই মানুষটি অচেনা থেকেই মারা গেছেন। এই পৃথিবীতে তিনি অচেনা মানুষের মতোই বিচরণ করেছেন একজন ক্ষণস্থায়ী ব্যক্তি হয়ে। জ্যাকের নিজেরই দায়িত্ব ছিল তার সম্পর্কে নিজেকে জ্ঞাত করানো- তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু জ্যাকের মতো ব্যক্তির কিছুই নেই, অথচ সে গোটা পৃথিবীকেই চায়। সে জানে, তার সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে তৈরি করা এবং পৃথিবীকে জয় করা কিংবা বুঝতে পারা তার জন্য যথেষ্ট নয়। মোটের ওপরে খুব দেরি হয়ে গেছে তাও নয়; এখনও অনুসন্ধান করতে পারে; এখনও জানার চেষ্টা করতে পারে এই মানুষটি সম্পর্কে। পৃথিবীতে আর যে কোনো মানুষের চেয়েই বেশি আপন মনে হচ্ছে এই মানুষটিকে। সে চেষ্টা করে যেতে পারে।
বিকেল শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্কার্টের খসখস শব্দ, একটি কালো ছায়া তাকে এই কবরস্থান এবং চারপাশ ঘিরে থাকা ওই আকাশের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে। তাকে এখন চলে যেতে হবে। এখানে আর কিছু করার নেই। কিন্তু এই নামটা থেকে, কবর ফলকে খোদাই করা ওই বছরগুলো থেকে কিছুতেই নড়তে পারে না জ্যাক। ওই বাঁধাই করা কবরের নিচে ছাই আর ধূলি ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু তার মনে হয় বাবা আবার জীবিত হয়েছেন। বাবার জীবনটা একটা অদ্ভূত নীরবতার জীবন। জ্যাকের মনে হতে থাকে, সে আবারও বাবাকে ত্যাগ করে চলে যাবে বুঝি। বাবাকে পিছে ফেলে সে আগের মতোই আরেকটা রাতের অশেষ নিঃসঙ্গতার কাছে ফিরে যাবে। এই নিঃসঙ্গতার মাঝেই এতকাল তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। সেখানেই সে একাকী পড়ে থেকেছে। শূণ্য আকাশে আকস্মিক বিকট প্রতিধ্বনি উঠছে: একটা অদৃশ্য উড়োজাহাজ বোধ হয় শব্দের সীমা অতিক্রম করে গেল। কবরের দিকে পেছন ফিরে জ্যাক করমারি তার বাবাকে ফেলে চলে যাচ্ছে।
(চলবে..)