ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব: ১২
অঘ্রানের অন্ধকারে
তুরির লেখা পুরো পড়া হয়নি। কয়দিন বুঁদ হয়ে লিখেছি। লেখা আরও খানিকটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে তুরির নোটবুকে লেখাটা পড়ে শেষ করা দরকার।
তুরির নোটবুক খুলে বসলাম। আগে যে পর্যন্ত পড়েছি তারপর থেকে পড়তে থাকলাম। তুরি বেশ গুছিয়ে লিখেছে।
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে আশপাশ কিছু দেখা যাচ্ছে না। আগারগাঁ বস্তির পাশে চওড়া রাস্তা। এই রাস্তার নাম ষাটফুট। তারপাশে এক ঝুপড়ি ঘরে ময়লা বিছানা পাতা। তোশকের এক জায়গায় সেলাই খুলে গেছে। সেখান থেকে জমাটবাঁধা তুলো বের হয়ে এসেছে। বিছানা থেকে দুর্গন্ধ আসছে। সেই দুর্গন্ধ শাবিনের নাকে লাগছে না। সে ঘরের মেঝেতে দলা পাকিয়ে বসে আছে।
সিগারেটের রাংতার ওপরে হেরোইন। তার নিচে মোমবাতি জলছে। শাবিন বাংলাদেশের দুই টাকার ঝকঝকে কড়কড়া নতুন নোট পেঁচিয়ে চিকন পাইপের মতো বানিয়ে ফেলেছে। এই নোট দিয়ে হেরোইন নেওয়া অনেক সুবিধা। তার সামনে পুন্নি নামে এক মেয়ে বসে আছে। সে শাবিনকে এখানে নিয়ে এসেছে। শাবিন হেরোইন জোগাড় করেছে।
পুন্নি প্রথমে লম্বা শ্বাস সে নাক দিয়ে ভেতরে হেরোইন টেনে নিল। তারপর শাবিন একইরকম করে দুই টাকার পেঁচানো নোটের ভেতর দিয়ে নাকে হেরোইন টেনে নিয়েছে।
অন্যরকম অনুভূতি শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে শরীর হালকা হয়ে গেছে। মনের ভেতর তীব্র ফুর্তি। শাবিন উঠে দাঁড়াল। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ঝপাত করে বিছানার ওপর পড়ে গেল।
পুন্নি এসে শুয়ে পড়ল শাবিনের গায়ের ওপর। ফিসফিস করে বলল, সবুজকে ডাকিসনি কেন আজ?
তুই জানিস না কেন ডাকিনি?
পুন্নি দুই হাত দিয়ে একটা একটা করে চাঁদের শার্টের বোতাম খুলছে আর বিড়বিড় করে বলছে, তুই হাবিবকে কথা দিয়েছিলি আমরা একসঙ্গে খাব।
আমি কাউকে কখনো কথা দিই না। আর কথা দিলে রাখতেই হবে তাও মনে করি না।
পুন্নি দুই হাত দিয়ে শাবিনের গা থেকে শার্ট খুলে নিতে নিতে বলল, তুই আমাকে ভালোবাসিস?
খুব ভালোবাসি।
কতটুকু ভালোবাসিস?
আকাশের সমান।
শাবিনের উদোম বুকে, পিঠে পুন্নি এমনভাবে খামচাচ্ছে যেন তার কিছু হারিয়ে গেছে সে খুঁজছে। শাবিনের বুকের সঙ্গে লেপটে গেল পুন্নি। গলা টান করে চাঁদের মুখের কাছে নিয়ে এলো। পুন্নির গায়ে ঘাম। ওর গায়ে টকদই আর বুনো জংলা মেশানো উগ্র গন্ধ। পুন্নির গলায় শাবিন ঠোঁট ছুঁয়ে আছে। পুন্নি দুপা দিয়ে শাবিনের কোমর পেঁচিয়ে ধরেছে। সাপে পেঁচানো মানুষের মতো পুন্নির শরীরের ভেতর শাবিন নিজের শরীর মুচড়াচ্ছে। মুচড়াতে মুচড়াতে পুন্নির পা দুটো ফাঁক করে ওর শরীরের ওপর চেপে বসল। ঠিকমতো বসে থাকতে পারল না। গড়িয়ে পাশে শুয়ে পড়ল।
এই ঘটনা শাবিন আমাকে বলেছে। আমাদের বিয়ের আগে থেকে পুন্নির সঙ্গে শাবিনের সম্পর্ক।
শাবিন বাসায় ফিরল সন্ধ্যার সময়। রিকশা থেকে শাবিন নামল। পুন্নি রিকশায় বসেছিল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম বাড়ির দোতলার বারান্দায়।
নিচে নেমে দরজা খুলে দিলাম। শাবিনকে দেখে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। জিগ্যেস করলাম, মেয়েটা কে?
কোন মেয়েটা?
যে তোমার সঙ্গে রিকশায় এলো।
পুন্নি। আমার বন্ধু।
তোমরা প্রতিদিন একসঙ্গে থাকো?
এত প্রশ্ন করছ কেন?
সে কি তোমাকে ভালোবাসে?
বাসেই তো। অনেক ভালোবাসে। সে তোমার মতো ম্যাড়মেড়ে না। একবার বিছানায় এলে ভাঙচুর করে ছাড়ে।
তুমি ভাঙচুর পছন্দ করো, বলোনি তো?
সেই রাতে শাবিন বিছানায় বসে ফেনসিডিলের তিনটা বোতল বের করল। বোতলের ছিপি ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, এই সুখ শুধু পুন্নি দিতে পারে। ঢকঢক করে দু বোতল ফেনসিডিল খাওয়ার পর শাবিনের নেশা ধরে গেল। তার শরীর কাঁপছে। সে আরেক বোতল ফেনসিডিল খুলে বসেছে।
আমি বললাম, ওটা আমাকে দাও।
কী মনে করে শাবিন ফেনসিডিলের বোতল আমার হাতে দিয়ে দিলো। ঠিক করেছি এখন থেকে শাবিনের সঙ্গে আমিও ফেনসিডিল খাব। গলগল করে মুখের ভেতর ফেনসিডিল ঢেলে দিলাম।
শাবিন সিগারেট জ্বালিয়েছে। সিগারেটের গন্ধ ভালো লাগছে। শাবিনের কাছে সিগারেট চাইলাম। শাবিন তার আধাখাওয়া সিগারেট আমাকে দিয়ে দিলো।
সিগারেটে টান দিতেই কেন জানি অপরিচিত তিতকুটে ভাব ছড়িয়ে পড়ল পুরো মুখে। আমার বমি বমি ভাব শুরু হলো। শাবিন বলল, আজ পুন্নির সাথে শুয়েছিলাম। আর শোব না। তোমার সাথে শোব।
জিগ্যেস করেছিলাম, তুমি আর কার কার সাথে শুয়েছ?
আর কারও সাথে শুইনি।
আমার ধারণা শাবিন সত্য কথা বলেনি। বললাম, কার কার সাথে শুয়েছ বলতে হবে না, আমি ছাড়া আর কতজনের সাথে শুয়েছ সেটা বলো।
শুধু পুন্নির সাথে।
শাবিনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে যেতে রুচিতে আটকাচ্ছিল। সে আরেকজনরে সঙ্গে শুয়েছে সেজন্য না, মিথ্যা কথা বলছে সেজন্য। মদ থেয়ে মাতাল অবস্থাতেও কেউ মিথ্যা কথা বলতে পারে সেটা শাবিনকে দেখে বুঝলাম।
শাবিন আগারগাঁ বস্তির পাশে ষাটফুট রাস্তার ধারে ঝুপড়িঘরে পুন্নির সঙ্গে সময় কাটানোর কথা বলে গেল। গাঁজা কিনতে গিয়ে কীভাবে পুন্নির সঙ্গে তার পরিচয়, বিয়ের আগে তারা কোথায় কোথায় যেত শাবিন সব বলল।
বিছানা ভাসিয়ে হড়হড় করে বমি করলাম। বমির উৎকট গন্ধ আসছে। শরীর নেতিয়ে পড়েছে। উঠতে পারছি না। শাবিন বমির পাশে দলা পাকিয়ে শুয়ে পড়েছে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। শাবিন ঘুমাচ্ছে।
হাত টান করে শাবিনের গায়ের ওপর দিয়ে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
(চলবে)