অদিতি ফাল্গুনীর
যখন সাংসদেরা খচ্চরের চেয়ে সস্তা
(নিকারাগুয়ার বিপ্লবী কবি ও ক্যাথলিক যাজক আর্ণেস্তো কার্দেনালের জন্ম ১৯২৫ সালে। নিকারাগুয়ার গ্রানাডায়। মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পরে নিউইয়র্ক সিটির কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। ক্যাথলিক এই ধর্মযাজক ১৯৭৯-১৯৮৮ সাল নাগাদ নিকারাগুয়ার বিপ্লবী স্যান্দিনিস্তা সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী ছিলেন এবং এর জন্য ভ্যাটিক্যান সিটি তাঁকে প্রকাশ্যে তিরষ্কার করে। ১৯৭৯ সালে স্বৈরাচারী সমোজা সরকারের অবসানের বিদ্রোহে এই কবি অংশ নিয়েছিলেন। সমোজা সরকারের বিরুদ্ধে লেখা তাঁর বিদ্রোহ ও প্রণয়ের কবিতাগুলোয় সে সময়কার উত্তাল নিকারাগুয়ান জীবনের প্রতিফলন ধরা পড়ে। বিপ্লবে অংশ নেয়া কোনো যুবক আবার ডানপন্থী ধনিক শ্রেণির সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়া প্রেমিকার উদ্দেশ্যে বিদ্রোহী যুবকের আর্তি মাখা কবিতায় শুধু স্প্যানিশভাষী পাঠক নয়- সেসব কবিতা পৃথিবীর নানা ভাষায় অনুদিত হয়ে জয় করেছেন কবি সারা পৃথিবীর নানা দেশের পাঠকের মন। এই কবিতা টিকার্দেনালের ‘জিরো আওয়ার’ থেকে অংশ বিশেষ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ডোনাল্ডডি. ওয়ালশ। একশো ভাগ রাজনৈতিক এই কবিতাটি বাংলায় ‘ঢাকাপ্রকাশে-র পাঠকদের জন্য এখানে ভাষান্তর করার সাহস নিলাম)
চন্দ্র প্লাবিত রাত ও আগ্নেয়গিরি
আর রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ থেকে আসা আলোয়
উত্তপ্ত মধ্য আমেরিকার ক্রান্তীয়রাত,
সৈন্যদের ব্যারাক ও কার্ফ্যুর বিষাদগ্রস্থ হুঁশিয়ারী।
‘প্রায়ই একটি সিগারেট খেতে খেতে
আমি স্থির করেছি যে একটি মানুষের খুন হওয়া উচিত।’
সিগারেট খেতে খেতে উবিকোবলেন
তাঁর বিয়ের কেকের মত গোলাপী প্রাসাদে বসে,
তাঁর মস্তিষ্ক শীতল, প্রাসাদের বাইরে
জনতাকে ফসফরাস বোমায় ছত্রভঙ্গ করা হচ্ছিল।
স্যান সালভাদরের রাতগুলো যেন গুপ্তচরে ঠাসা,
ঘর আর বোর্ডিং হাউসগুলোয় ফিসফিস আলাপ
আর পুলিশ স্টেশনগুলোয় আর্তনাদ।
কারিয়াসের প্রাসাদে জনতা পাথর ছুঁড়েছে।
তাঁর অফিস কক্ষেরএকটি জানালা গুঁড়িয়ে গেছে
এবং পুলিশ বিক্ষোভকারী জনতার উপর গুলি ছুঁড়েছে।
এবং চকোলেট কেকের মত প্রাসাদ থেকে
ম্যানাগুয়া হয়ে উঠেছে মেশিনগানের আরাধ্য লক্ষ্য
আর ইষ্পাত হেলমেট পরা বাহিনী
সড়কগুলোয় টহল দিচ্ছে।
প্রহরী! এখন রাত ক‘টা বাজে?
প্রহরী! এখন রাত ক‘টা বাজে?
হন্ডুরাসের ক্যাম্পেসিনো (কৃষকেরা) তাদের টুপিতে টাকা ভরে নিয়ে যেত
যখন সেই ক্যাম্পেসিনো (কৃষকেরা) তাদের বীজ বুনত মাঠে
এবং হন্ডুরাসবাসী ছিল নিজেরাই তাদের জমির মালিক।
যখন তাদের ছিল নগদ টাকা
এবং ছিলনা কোন বিদেশী ধার-দেনা
অথবা জে.পি.মর্গ্যান অ্যান্ড কোম্পানির জন্য প্রদেয় কোন খাজনা।
এবং ফল কোম্পানী ক্ষুদ্র, কাদামাখা চাষীদের সাথে
কোন প্রতিযোগিতায় ছিল না।
কিন্তু একদিন ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি এলো
আর তার সহায়ক হিসেবে এলো টেলা রেইল রোড কোম্পানি
এবং ট্রুহিলো রেইলরোড কোম্পানি
ক্যুইয়ামেলফ্রুট কোম্পানির সহযোগী হিসেবে
এবং ভাক্কারো ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি
তার ওপরে স্ট্যান্ডার্ড ফ্রুট অ্যান্ড স্টিমশীপ কর্পোরেশনের
স্ট্যান্ডার্ড ফ্রুট এ্যান্ড স্টিমশীপ কোম্পানি :
ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি
ছাড় অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ঘটালো বিপ্লব
এবং সেই সাথে দিলো
রপ্তানী ও আমদানি মূল্যে লক্ষ লক্ষ ডলার অব্যাহতি ,
পুরনো অধিগ্রহণের পরিমার্জ্জনা ও
নতুনতর শোষণের জন্য দেয়া অনুদান,
চুক্তি ভঙ্গ, সংবিধানের অমান্যতা...
এবং প্রতিটি শর্তই কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত
জমি বাজেয়াপ্ত বা ক্রোকের ক্ষেত্রে দায় বা শর্তাবলীসহ
(গোটা দেশের দায়, কোম্পানির নয়)
শর্তাবলী লিখবে অবশ্যই কোম্পানি
রাষ্ট্রের কাছে জমি চাষের অধিকার ফিরিয়ে দেবার বিনিময়ে
(যা রাষ্ট্রগুলোই বহুজাতিককে দিয়েছে বিনামূল্যে)
এবং ৯৯ বছর পরে...
‘এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি বা কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন
সব আবাদের ক্ষেত্রে
যা কিনা ঠিকাদারের উপর নির্ভরশীল
এবং ফলশ্রুতি হিসেবে যে আবাদে এই কোম্পানির ভবিষ্যতে
কোন স্বার্থ থাকতে পারে
সেসবই পূর্ববর্তী শর্তাবলীর ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত হবে...‘
(যেহেতু কোম্পানি ও চুক্তির ভাষা বিকৃত করে)
শর্ত ছিল যে কোম্পানি রেলপথ বানিয়ে দেবে,
অথচ কোম্পানি তা‘বানাচ্ছিল না,
কারণ হন্ডুরাসে খচ্চরেরা ছিল রেলপথের চেয়ে সস্তা,
আর ‘একজন সাংসদ ছিল একটি খচ্চরের চেয়ে দামে কম‘,
যেমনটা জেমুরে বলতেন,
যদিও তিনি আয়কর ফাঁকি দেয়া উপভোগ করছিলেন
কোম্পানির দেয়া ১৭৫,০০০ একর জমির দান নিয়েও,
এই জমির বদলে জাতির জন্য প্রতিমাইল রেলপথ
যা তার বানানোর কথা ছিল
তবে তিনি বানাননি, দেশকে তিনি কিছুই ফিরিয়ে দেন নি
যদিও তিনি বানাননি এক মাইলপথও (কারিয়াস সেই একনায়ক
যে রেলপথের সবচেয়ে বেশি মাইল রাস্তা বানায়নি)
এবং সর্বোপরি সেইবাজে রেলপথ
যা জাতির কোন কাজেই লাগেনি
কারণ এই রেলপথ ছিল দুই বিশাল আবাদী জমির মাঝখানে
কারণ এই রেলপথ ছিল না ট্রুহিলো এবং তেগুচিগালপা
শহরদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে।
এই কোম্পানিরা বিকৃত করে ভাষা এবং বিকৃত করে সংসদ,
আবাদী জমিতে কলা পচে
অথবা রেলপথের ধারে গাড়িতে পচন ধরে কলায়,
অথবা কলাগুলো কেবল অতিরিক্ত পেকে গেলেই কাটা হয়
যাতে তাদের বাতিল করা যেতে পারে
যখন তারা ঘাটে পৌঁছে অথবা সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হয়
টনটন কলা.
সার সার কলার কাঁদিকে বলা হয় মজে গেছে অথবা বড্ড বেশি শুকনো,
অথবা শুকনো কলা, অথবা কাঁচা, অথবা অতিরিক্ত পেকে যাওয়া, অথবা রোগগ্রস্থ
যাতে করে কোন সস্তা কলা না থাকে,
অথবা কোন কলাই সস্তায় কিনতে না পাওয়া যায়।
যতক্ষণ না নিকারাগুয়ার অতলান্তিক উপকূলে ক্ষুধা প্রবল হয়ে ওঠে।
এবং কৃষকদের জেলে পোরা হচ্ছে ৩০ সেন্টে কলা না বেচার জন্য
এবং তাদের কলাগুলো ফেঁড়ে ফেলা হচ্ছে বেয়নেটে
এবং মেক্সিকান ট্রেডার স্টিমশীপ তাদের বজরাগুলোসহ ডুবে যায়
এবং হরতালকারীরা বুলেটের ভয়ে সন্ত্রস্ত।
(এবং নিকারাগুয়ার সাংসদেরা একটি উদ্যান ভোজে আমন্ত্রিত)।
কিন্তু ঐ কালো শ্রমিকটির সাতটি বাচ্চা।
আর তুমি কী বা করতে পারো? তোমাকে ত‘ খেতে হবে,
এবং তারা যে মজুরিই দিক তোমাকে মেনে নিতে হবে।
এক কাঁদি কলার মূল্য হিসেবে ২৪ সেন্ট।
বোস্টনে যখন ট্রপিক্যাল রেডিওর সহকারী হিসেবে
কেবল সংযোগ দেয়া হচ্ছিলো:
‘আমরা অনুমান করি যে বোস্টন নিকারাগুয়ার সংসদে
সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাংসদদের অর্থ দিতে তার অনুমোদন জানাবে
যেহেতু দলটি কোম্পানির জন্য অসংখ্য সুবিধাপ্রদান
করে।‘
এবং বোস্টন থেকে এই বার্তা ট্রেলিগ্রাফে পৌঁছে যাবে গ্যালভেস্টনে
এবং গ্যালভেস্টন থেকে কেবল এবং টেলিগ্রাফ যোগে মেক্সিকোয়
এবং মেক্সিকো থেকে কেবল সংযোগে স্যানজুয়ান দেল সুহ
এবং স্যানজুয়ান দেল সুহ থেকে পুয়ের্তোলিমোনে পৌঁছে যাবে টেলিগ্রাফ যোগে
এবং পুয়ের্তোলিমন থেকে পাহাড়ি এলাকায় নৌকায় করে
নির্দেশ পৌঁছে যায় ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানিতে:
‘ইউনাইটেড আর কলা কিনছে না।“
এবং পুয়ের্তোলি মনে শ্রমিকেরা ছাঁটাই।
এবং ছোট ছোট কারখানাগুলো বন্ধ করা হয়েছে।
কেউই তার ধার-দেনা পরিশোধ করতে পারছে না।
এবং রেলপথের ধারে গাড়িগুলোয় কলার সার পচছে
কারণ কোন সস্তা কলা থাকতে পারবে না
যাতে কোন সস্তা কলা না পাওয়া যায়
এক/একটি কলার কাঁদির দাম ১৯ সেন্ট।
মাসিক বেতনের বদলে শ্রমিকদের ঘন্টাপ্রতি মজুরি,
পাওনা টাকার বদলে ধার-দেনা,
কলা আবাদ পতিত বা পরিত্যক্ত,
যেহেতু তার এখন কোন দরকার নেই,
পতিত জমিন দেয়া হয়েছে বেকারদের কলোনীকে,
এবং কোস্টারিকায় ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানী
এবং কোস্টারিকায় তার সহযোগী কোস্টারিকা ব্যানানা কোম্পানি
এবং নর্দার্ণ রেইলওয়ে কোম্পানি এবং
দ্য ইন্টারন্যাশন্যাল রেডিও টেলিগ্রাফ কোম্পানি
এবং কোস্টারিকা সাপ্লাই কোম্পানি
এবং আদালতে এক অনাথের বিরুদ্ধে মামলা লড়ছে
রেল লাইনের লাইন চ্যুতির খরচ ২৫ ডলার
তবে গোটা রেলপথ মেরামত করতে আরো বেশি খরচ হবে।
এবং সাংসদেরা খচ্চরের চেয়েও সস্তা, জেমুরে যেমন বলতেন।
তুর্কী কলা ব্যবসায়ী স্যাম জেমুরে ভ্রাম্যমান, আলাবামায় থাকেন,
একদিন এক ভ্রমণে বের হয়ে গেলেন নিউঅর্লিয়ন্সে
এবং সেখানে তিনি দেখলেন যে ইউনাইটেডফ্রুট কোম্পানি সমুদ্রে ছুঁড়ছে কলা
এবং তিনি সব ফল কিনবার প্রস্তাব দিলেন ভিনেগার বানাবেন বলে,
তিনি সব কলা কিনলেন এবং তার পর নিউ অর্লিয়ন্সেই সেইকলা বেচলেন
এবং ইউনাইটেডের হন্ডুরাসে তাঁকে জমি দিতে হলো,
যাতে করে নিউ অর্লিয়ন্সে তিনি তাঁর আগে করা চুক্তি ভঙ্গ করতে পারেন,
এবং এভাবেই স্যাম জেমুরে হন্ডুরাসে রাষ্ট্রপতিদের নিযুক্ত করে থাকেন।
তিনিই গুয়াতেমালা এবং হন্ডুরাসের ভেতর সীমান্ত উত্তেজনা সৃৃষ্টি করেন
(যার অর্থ হলো ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি এবং তাঁর নিজের কোম্পানির ভেতর উত্তেজনা)
সেই সাথে ঘোষণা দেন যে হন্ডুরাস (তাঁর নিজের কোম্পানী) অবশ্যই
‘বিতর্কিত এলাকায় এক ইঞ্চি জমিও ছাড়বেনা-
বিনাযুদ্ধে দেবে না সূচাগ্র মেদিনী
শুধু তাই নয়
হন্ডুরাসের অন্য কোন এলাকাতেও
তার কোম্পানী থাকবে না কোন বিতর্কে...
(যখন ইউনাইটেড নিকারাগুয়ার লাম্বার কোম্পানির
সাথে এক আইনী যুদ্ধে হারিয়ে দিচ্ছিল হন্ডুরাসের অধিকার)
যতক্ষণ না সেই মামলা শেষ হয়
সে একীভূত হয় ইউনাইটেডের সাথে
এবং তারপর তার সব শেয়ার বিক্রি করে ইউনাইটেডকে
এবং তারপর বিক্রির লভ্যাংশ দিয়ে সে ইউনাইটেডে কেনে শেয়ার
এবং সেই শেয়ার দিয়ে সে বোস্টনে দখল করে রাষ্ট্রপতির পদ
(হন্ডুরাসের বিভিন্ন রাষ্ট্রপতিকে তাদের কর্মীসহ কিনে নেন)
এবং এখন তিনি হন্ডুরাস ও গুয়াতেমালা উভয়েরই মালিক
এবং এভাবেই সব অবসন্ন জমি নিয়ে আইনীযুদ্ধ শেষ হয়
যে জমিগুলো এখন আর না হন্ডুরাস
না গুয়াতেমালার কোন কাজে আসবে।