ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩৮
নেই দেশের নাগরিক
“আর যদি নৌকো পাড়ে ভেড়াতে না পারে!” সাদ্দামের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল আতিফ। সাদ্দাম এবার ফ্যাসাদে পড়ে গেল, তাই তো! তাহলে! যা ঝড় হলো তাতে নদীর ওপর নৌকো ভেসে থাকা অসম্ভব। আতিফের ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকাল সাদ্দাম। মুখটা ইট চাপা দেওয়া ঘাসের মতো হলুদ হয়ে গেছে। চোখে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া। মুখের আদলে এতিম এতিম ভাব। সাদ্দাম মনে মনে ভাবল, এই মুখে কী আর মিথ্যে সান্ত্বনা দেব। সত্যি যে বড় কঠিন। বড় রুঢ়। ওর যে পরিবারকে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনায় পুরো জল ঢেলে দিয়েছে আশ্বিনের ঝড়। পরিবারের সঙ্গে মিল হওয়ার এক আনা সম্ভাবনাও যে নেই। তবুও মনের আসল কথাটাকে জিভের তলে আটকে রেখে ওপরে ওপরে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “নৌকোর মাঝি যদি দক্ষ হন, আর নৌকোর কাঠামো যদি পোক্ত হয়, তাহলে এ ঝড়ে খুউব বেশি ক্ষতি করতে পারবে না।”
আতিফ ভাবল, মতি ভাই নৌকো চালনায় যথেষ্ট দক্ষ। নৌকোবাইচ প্রতিযোগিতায় ঢের কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। নুহু ভাইও ভালোই সঙ্গ দেয়। তার হাতের বাহুতে বলদের দোম। বুকে নেকড়ের সাহস। সুতরাং মাঝি হিসেবে তারা সুদক্ষ পাল্লাদার। আর আমাদের বাড়ির ‘ঘাটবাড়ি কৌশা’ নৌকোটা একটু পুরোনো হলেও, কাঠে এখনো ঘুণ ধরেনি। রোদে জলে শুকিয়ে ভিজে এখনো সেভাবে ফাটল ধরেনি। এখনো হাতুড়ের ঘা দিলে ‘টং’ করে ওঠে। এতটুকুও টুস্কায় না। তা ছাড়া, বছর বছর নৌকোর খোলে আলকাতরা মাখানো হয়। যত্নআত্তিরের কোনো খামতি থাকে না।
যে আতিফ বাড়িতে থাকলে একবারও নৌকোয় ওঠে না। একবার মজা করেও ছুঁয়ে দেখে না। মা হালেমা ‘আমরা হলেম কি নদীর কূলের মানুষ, সাঁতার আর নৌকো না চালাতে জানলে হয়, যা শিখে রাখ’ বলে কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করলে আতিফ তিড়িংবিড়িং করে বলত, ‘জেলের ছেলে জেলে হবে কেন? লেখাপড়া শিখে চাকরি করবে। ব্যবসা করবে। গোটা বংশ সারাজীবন একই ঘাটে পড়ে থাকবে কেন?’ সেই আতিফ এখন, নৌকোর ফাঁটল খুঁজছে, নৌকোটায় কোথাও তিল পরিমাণ ঘুণ ধরেছে কি না, তা হন্যে হয়ে হাতড়াচ্ছে। নৌকোটা কতটা ঝড়ের ঝাপটা এড়াতে পারবে, তার চুলচেরা পরিমাপ করছে। একই বলে, ঘাটের ছেলে ঘাটে ফিরে আসা। যে নাড়ি কেটে পেটের ছেলে দূরে চলে গেছিল সেই নাড়ির টানেই আবার নাড়ির বাঁধনে ফিরে আসা।
বাইরের বীভৎসতা দেখে আঁতকে ওঠে আতিফ। বেশীরভাগ ত্রিপলের ঘর ঝড়-বৃষ্টিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! যাকে বলে, একেবারে মাটিতে মিশে যাওয়া। চারিদিকে হাহাকার আর আর্তনাদ। এই সময়ে আশ্বিনের ঝড়টা যেন ঘা’এর ওপর বিষফোঁড়া! লোকগুলো এমনিতেই ভিটেমাটি আত্মীয়স্বজন হারিয়ে সহায় সম্বলহীন পথের ভিখিরি হয়ে গেছে, তার ওপর আবার এমন জানে মেরে দেওয়া ঝড়! আল্লাহর রহমানের রহিম হয়েও বান্দার ওপর কেন এত রুষ্ট? আল্লাহ গযব দেওয়ার কি আর জায়গা পেলেন না? পাকা ফলনে মলন দিলে যা হয়, নয়াপাড়ার এই শরণার্থী শিবিরের এখন সেই অবস্থা! মানুষ, গরু, ছাগল, ভেড়া, ত্রিপলের ঘর ঘাসপাতার মতো পানিকাদায় পুঁতে গেছে! জীবন এখানে নাক অবধি মরে কোনরকমে বেঁচে আছে। “সাদ্দাম, এখানকার শরণার্থীদের খাবারের সমস্যা কেমন?” জানতে চায়ল আতিফ। “চরম। কেউ একবেলা খেয়ে কেউ আবার অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।”
“কেন? ইউনিসেফ তো টনটন খাবার পাঠায়। সেগুলো কোথায় যায়?” “সেগুলোর সব কি আর এখানে পৌঁছায়? মাঝপথে নিশ্চয় কিছু হাপিস হয়ে যায়।” “শরণার্থীদের খাবারও চুরি! লোপাট! মানুষ আর কত নিচে নামতে পারে! ছিঃ!” “মানুষ তো জ্যান্ত মানুষকেই খেয়ে ফেলছে, আর এ তো খাবার। লোপাট তো করবেই।” “এখানে যা দেখছি, ত্রিপলেরও তো প্রচুর ঘাটতি। বহু মানুষ খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাচ্ছে।“
“নীল আকাশ হল ছাদ আর মাটি হল বিছানা। পৃথিবীর সব উদ্বাস্তুদেরই তো এই অবস্থা। না আছে মাথার ওপর ছাদ না আছে পায়ের নিচে মাটি।” “তোরা খাবারের দিকটা ব্যাপক জোর দে। এদিক ওদিক লোক পাঠিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ কর।”
“সে পথও তো মারা। বাংলাদেশ সেনা এখান থেকে কোন রোহিঙ্গাকে অন্যত্র যেতে দেয় না। নথিভুক্তিকরণের সময় সেটা কড়া ভাবে বলে দিয়েছে।” “কেন, আগে যে সবাই এদিক ওদিক কাজ করতে যেত?” “এখন নিয়ম বদলেছে। এখন কড়াকড়ি বেশি। ঢাকা শাহবাগ চত্বরে বোমব্লাস্টের পর থেকে এই কড়াকড়িটা বেড়েছে।” “তাহলে তো কাজ করা খুবই মুশকিল। তোর কাজও কঠিন হয়ে গেছে নিশ্চয়?” “কঠিন মানে, কোন কঠিন, যাকে বলে জান হাতে করে কাজ করতে হচ্ছে। তবে দেশের জন্যে তো এটুকু করতেই হবে। আমরা তো আর নুন-তেলের মানুষ নই? আমরা হলেম গুলি-বারুদের মানুষ। জীবন তো এমনিতে যাবেই, যাবেই যখন তখন দেশের স্বাধীনতার জন্যেই যাক। ‘স্বাধীন রাখাইন রাষ্ট্র’ আমরা প্রতিষ্ঠা করবই।” সাদ্দামের বুকের সিনা কয়েক ইঞ্চি ফুলে ওঠে। চোখে মুখে জেহাদের বিপ্লবী-মন্ত্র। “রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধি এখানে আসেন?”
“হ্যাঁ, শুধু কি রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধি, অনেক দেশের প্রতিনিধিই এখানে আসেন। তারা এলাকা পরিদর্শন করেন। অনেকেই ত্রাণ পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান।” “শোন, মানুষের ক্ষোভকে কিন্তু কাজে লাগাতে হবে। ক্ষোভ, হিংসা, রাগ যত বাড়বে, আর জে এফ’এর সদস্য সংখ্যাও তত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে।” “সে ফরমুলা আমার জানা বন্ধু। পেটের খিদেকে আগুন বানিয়ে শত্রুর দোরে ছুড়ে দাও। মনের হিংসাকে ‘বোম’ বানিয়ে শত্রুর ডেরায় ফেলে দাও। ব্যস, কেল্লাফতে।”
“একদম ঠিক। দারুন বলেছিস। একেই বলে ‘চালাকির দ্বারা কাজ হাশিল করা’।” চোখ ঘুলিয়ে উঠল আতিফ। তারপর চোখের মণিতে টিপ করে পাতা ফেলে, মুহূর্তে ঘোমটা টানার মতো ওপরে তুলে বলল, “আচ্ছা, এখন নাফ নদীতে আছে, এমন কেউ তোর পরিচিত নেই?” “না, সেরকম কেউ নেই। তবে কাজের সূত্রে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এই যা। সেটাও না না করে মাসখানেক তো হয়ে গেল।” “ওদের কারও সঙ্গে কোনোভাবে কন্ট্যাক করা যাবে না?” “না না, তা কী করে সম্ভব? আমার কাছে তো ওদের কোনো ফোন নম্বর নেই।” “কন্ট্যাকটা করা গেলে খুব ভালো হতো রে!” আফসোস করে আতিফ। ধীরে ধীরে পা তুলে ত্রিপলের চাটায়ের ঘরের ভেতরে ঢুকল আতিফ। ছাপুর ঘরটার মাথার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে বৃষ্টিস্নাত আধক্ষোয়া চাঁদ।
তরমুজের ফালির মতো চাঁদটা ফিনফিনে সাদা থানের মতো মেঘ কেটে কেটে যাচ্ছে। স্কুলে পড়া কবিতার লাইনটা একটু ঘুরিয়ে তার মনে ঠক করে ওঠে, মেঘ দেখে করিস নে ভয়, আড়ালে তার চাঁদ হাসে। সত্যিই আকাশ পারেও বটে এত কলা করতে! কানে রূপোর দুল আর পরনে হলুদ শাড়ি পরে খুপরি ঘরের মটকার ফাঁক দিয়ে ঘুমোতে আসছে জ্যোৎস্না। তার লাবণ্যমাখা শরীর ঝড়ে কুঁকড়ে যাওয়া ত্রিপলের ঘরটাকে মাদকাময় করে তুলছে। সঙ্গের গা কাঁটা দেওয়া হীমশীতল বাতাস সে শরীরে আরও মোহময়ী খুসবু ছড়িয়ে দিচ্ছে। মাটির সোঁদা গন্ধ সে বাতাসের ঘাড়ে ভর করে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়। ডাগর ধানের শীষের গন্ধ মাটির সোঁদা গন্ধে মিশে মনের একতারায় পাগলপারা সুর তুলছে। অন্য সময় হলে আতিফ নাক ডুবিয়ে ঘাস, মাটি, ধান, কাদাপানির ঘ্রাণ নিত। শুঁকত গন্ধ। কিন্তু আজ তার উচাটন মন সেদিকে সিঁদ কাটতেই পারছে না। মনের মধ্যে পুঁতে আছে দুশ্চিন্তার ঘোর।আপনজনকে খুঁজে পাওয়ার তাড়না। মনের আকাশে এভাবে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ জমলে, ফুলকেও কাঁটা মনে হয়। চাঁদের আলোকে মনে হয় কাঠপোড়া আগুন। জীবনের সব স্বাদ তখন কষ্টে তেতো হয়ে যায়।
আতিফের ক্লান্ত শ্রান্ত চোখ আলতো করে মুদে আসতেই, বাড়ির নৌকোটার কথা ‘ধড়াক’ করে উঠল। তার মা’এর মুখটা বড্ড মনে পড়ছে। মনে পড়ছে হাড়গিলে বাপ’টার কথা। মতিভাইয়ের রোদপুড়া তামাটে মুখ। চোখ খুললেই, ফালি চাঁদের একটা মিহি আলো চোখের আয়নায় ঠিকরে পড়ল। চোখের দুই কোণ চাপা অশ্রুতে চিকচক করছে। অশ্রুর এই বিন্দু ফোটায় প্রতিবিম্বিত হচ্ছে, নাফ নদী, আশ্বিনের ঝড়, ঘাটবাড়ি কৌশা নৌকো আর আব্বা মায়েদের মুখ। অন্য সময় হলে, এভাবে কাস্তে চাঁদের আলো চোখে ঠিকরে পড়লে মনের আকাশে হেসে উঠত পূর্ণিমার মতো ভরা যৌবনের চাঁদ। আর আজ সেই একই আলোকে তার শত্রুর ছোড়া তীর মনে হচ্ছে। যে মনের আকাশে উড়ে বেড়াত লাল-নীল ঘুড়ি, সেই আকাশে এখন চরে বেড়াচ্ছে মরা খেকো শকুন। আতিফের মন কাগজের ঠোঙার মতো একটু একটু করে গুটিয়ে যাচ্ছে। দেহের বদল হতে ঢের সময় লাগলেও, মনের বদল যে মুহূর্তে হয়ে যায়। এই লাগে কাশফুলের দোলা তো ওই লাগে আগুনের ছ্যাকা। জীবন এখানে এক অঙ্কের বিয়োগ। শূন্যের গুণ। উদরে যাওয়া মলাট।
সাদ্দাম দড়ির খাটিয়াটাকে ঝেড়েঝুরে বলল, “শুয়ে পড়। রাত অনেক হয়ে গেছে।” রাত কি শুধু এই চরাচরেই হয়েছে? মনের চরাচরে তো সেই কবে থেকেই রাত হয়ে আছে। সেখানে তো শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। সূর্যের বিন্দুমাত্র দেখা নেই। সে রাতে কতবার আছড়ে পড়েছে ‘আশ্বিনের ঝড়’ ‘কালবৈশাখী’, পাড় ভেঙে হৃদয়ের দুকুল প্লাবিত করে দিয়েছে মনের নাফ নদী। গাছপুড়া মানুষপুড়া দাবানলের আগুন দাউদাউ করে পুড়িয়ে দিয়েছে মনের বসতভিটে। সে রাতের যে সকাল হওয়ার নাম নেই! শুধু অন্ধকারেই মুখ ঢুকিয়ে বসে আছে। মনে মনে বিড়বিড় করে আতিফ। মনের দেওয়ালে আঁচড় টানে মনের কালি। মনের কথনে সুর বাঁধে যন্ত্রণার বাঁশি। মনের অন্ধকারে নেমে আসে আরও ঘন রাত। পাশের খেতি থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁর ডাক। দূরে শিয়ালের হুক্কাহুয়া। মিহি করে ভেসে আসছে সাপের ব্যাং ধরার করুণ শব্দ। ‘ক্যাঁচ’ করে একটা শব্দ গেঙড়ে উঠল! সাদ্দাম পা তুলে শাট হয়ে শুলো খাটিয়াটার একপাশে। বালিশে রাখা মাথা ঘুরিয়ে বলল, “আয়, শুয়ে পড়। ভোর ভোর উঠতে হবে।”
“নাহ, শুব না। শুলে হবে না। এখনই রওনা দিতে হবে।” থুতনি সরু হয়ে উঠল আতিফের। ‘তড়াক’ করে উঠল সাদ্দাম। চোখে বিস্ময়। “এখন রাত কটা বাজে, জানিস? এই চত্বরে এত রাতে বের হওয়া কতটা বিপদের তা তোর আন্দাজও নেই। আমি জানি। আমি আড়াই বছর ধরে এখানে আছি। এখানকার পানি-হাওয়া কি কথা বলে, তা আমিই জানি। তুই হয়ত জানিস না, এখন বাংলাদেশ সরকার প্রত্যেক রোহিঙ্গার পায়ে সন্দেহের বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। পায়ের পাওঠায় পাওঠায় পাতা থাকে তাদের গোপন আড়কাঠি।” মেজাজ কুসুম গরম হয়ে ওঠে সাদ্দামের। এলাকার চালচুলোর আভাস দেয়। দেয় গোয়েন্দাদের হাঁড়ির খবর। আতিফ তার একগুঁয়েমিকে রশা দিয়ে আরও কড়া করে বাঁধে। বলে, “আমাদের জীবন শেয়ালের, নেড়ি কুত্তার, রাতবিরেত বলে কোনও শব্দ নেই। আরাম আয়েশ কবেই হারাম হয়ে গেছে। এখন একটা মিনিট নষ্ট করা মানে, ভুলের ‘পরে ভুল করা। জীবন থেকে জীবনকে হারিয়ে ফেলা। আমাদের জীবনকে কেউ যদি ছাগলের খাল ছাড়ানোর মতো ছাড়িয়ে নেয়, তবুও আমাদের উচিৎ, সত্যের জন্যে ‘ভ্যা’ করে যাওয়া। মৃত্যু আমাদের কানের দুল, গলার হার। মৃত্যুভয়ের জন্যে আমাদেরকে ঘরে শুয়ে থাকতে হবে? এত মোমের মানুষ আমরা কবে হলাম, সাদ্দাম? তুই হয়ত ভুলে যাচ্ছিস, আমরা জীবনের কাঠিতে কবেই বারুদ লাগিয়ে নিয়েছি। এতে আগুন লাগবে তো এখন আর তখন কী।”
চলবে...
আগের পর্ব পড়ুন