ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩৩
নেই দেশের নাগরিক
“আকাশ এ রকম হলে, ঝড়ের দাঁত নখ আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। জান খেয়ে তবেই তার জান জুড়োয়। মেজাজ শান্ত হয়।” দড়িটাকে নৌকোর খোলের সঙ্গে বেঁধে গিট দিতে দিতে মিনমিন করল মতি। নুহু, দড়ির অপর প্রান্তটা নৌকোর খোলে আঁটা কাঠের পাটাতনের মধ্যে পুরে একপাক ব্যাড় দিয়ে, আবার ছইয়ের মাথার ওপর দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, “ছুঁড়লাম, ধর ভাই।” অন্ধকারেই ‘খপ’ করে ধরল মতি। প্রান্তটা ধরে টান করে বাঁধল। মাথার উপর তখন যবের বাঁকা শীষের মতো চাঁদ। চাঁদটা থেকে কালো মেঘের রাক্ষুসে মুখটা দু-মানুষ দূরে। চাঁদটাকে গিলে খাওয়ার জন্যে, কালো ষাঁড়ের মতো শিং খাড়া করে শুসে আসছে! পাকা গমের পাতার রঙের মতো চাঁদের চিকন আলোতে দড়িটা ছইয়ের এপার-ওপার করে ছইটাকে শক্ত করে বেঁধে নিল দুই ভাই। দড়িটায় চাঁদের সেই চিকন আলো পড়ে দড়িটা রূপোর রেখার মতো ঝলমল করছে। মতি দুধাপ এগিয়ে এসে, ছইয়ের গায়ে হাত দিয়ে নড়িয়ে দেখল,ছইটা শক্ত হয়েছে কি না। আগের মতো ল্যাকপ্যাক করছে কি না। নাহ, আঁটির মতো শক্ত হয়ে গেছে। ছোটখাট ঝড় এর একটা বাতাও নড়াতে পারবে না। ভাবল, মতি। নুহুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “নোঙরটা হাতের নাগালের মধ্যে রাখ।”
“ঠিক আছে।” ঘাড় হেলাল নুহু। খড়মড় করে হেঁটে নৌকোর মাঝের খন্দে এলো। হাতের নাগাল দিয়ে পরখ করল, নোঙরটা ঠিক আছে কি না। ফিনফিন করে বয়তে থাকা হাওয়াটা ক্রমশ জট পাকাচ্ছে। আকাশের কালো ষাঁড় মেঘও পায়ের খুড় দাপাটে শুরু করেছে। ফুঁসে উঠছে সিং। বিদ্যুতের ঝলকানিতে নখের আঁচড়ের মতো চিড়ে চিড়ে যাচ্ছে কালো বোরখা পরা আকাশের গা-গতর। এই গা শিরশির করা আশ্বিন মাসের ঝড় গেরস্তের হাঁড়ি পর্যন্ত উপড়ে দেয়। বৃষ্টির ছাট শিলের মতো শক্ত হয়। যেন মনে হয়, গায়ে ছুটে এসে শুকনো ঢিল লাগল। জট পাকিয়ে যখন ঝড়টা গাছের মাথা খেয়ে ধেয়ে আসে, তখন তার রাক্ষুসে চোখ দেখে মনে হয় উঠোনও খোলের মতো উপড়ে নেবে। মেঘটা পুব দিকের রাখাইনের আকিয়াবের মাথায় ঢোল পিটছে দেখে নুহু বলল, “ভাই, নৌকোটা পুব-পশ্চিম মুখ করে রাখছি। ঝড়টা মনে হচ্ছে আকিয়াবের দিক থেকে আসছে। পুব-পশ্চিম মুখ করে রাখলে, হাওয়ার বাধা কম লাগবে।”
“হু, তাইই কর।” মাথা ঝুকাল মতি। মনে মনে বলল, ঝড় আকিয়াবের দিক থেকে আসবে না তো কোন দিক থেকে আসবে? যত ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদ-আপদ তো ওই মুখ পোড়া দেশটা থেকেই আসবে। আজরাইল যে ওখানেই গেড়ে বসেছেন। সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে তাবু খাটিয়েছেন। ওদিক থেকে ঝড় আসবে না তো কি ফুল আসবে? দেশটার মানুষ খেয়ে পেট ভরছে না! আবারও খামচা খামচা জান খাওয়ার জন্যে আকাশ ফুঁড়ে ফুঁসছে! মেঘ যত গেংড়িয়ে উঠছে, মতি তত ‘মালেকুল মওত’এর গন্ধ টের পাচ্ছে। আঁচ করতে পারছে তার উপস্থিতি। মতি অনুধাবন করছে, আজ ঝড়-বৃষ্টির ফেরেশতা মেকাইল আর মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইল হাতে হাত মিলিয়েছেন। ধ্বংস অনিবার্য। মরণ নিশ্চিত। মতির আদুর গা’এ সমুদ্রের লবণ হাওয়া ঝাঁকানি দিচ্ছে। মতি বুঝতে পারছে, গরম হাওয়া ধীরে ধীরে কাল হয়ে উঠছে। বৃষ্টি বেশি দূরে নেই। মোহনা ছেড়ে উপকূলে আছড়ে পড়ছে হয়ত! গাছ-পাতা, পশুপাখি-কীটপতঙ্গ বগলে পুরে সাঁ সাঁ করে ধেয়ে আসছে! এই সময় আকাশ যেন হাঁটু পেড়ে নেমে আসে। রাক্ষুসে নখ দিয়ে খুঁটে নেয় ‘জীবন’! ধান কুড়োনির মতো জান কুড়িয়ে নিয়ে যায়। ছইয়ের অন্দরে মাথা ঝুঁকিয়ে মতি বলল, “তোমরা জামা-কাপড়, বিছানা-কাঁথা যা আছে গুটিয়ে পলিথিন দিয়ে মুড়ে দাও। যাতে করে পানিতে না ভেজে।”
“ও সব পুটলাতে ভরে নিয়েছি। শুধু সাকিবের দাদার গায়ের চাদরটা গুটাইনি। আব্বার গায়ে জড়ানো আছে।” জানাল আরিফা। শাশুড়ির দিকে মুখ করে বলল, “মা, আপনি টাপার একেবারে গা ঘেঁষে বসে থাকুন। পরনের কাপড়টা আর ভিজাবেন না। আর তো শুকনো কাপড় নেই। যেটা ভিজিয়েছেন সেটা তো এখনো শুকোইনি।”
“ঠিক আছে, মা, আমি তো টাপার মাঝখানেই জড় হয়ে বসে আছি।” ধোকানি কন্ঠে বললেন হালেমা। তিনি ছইয়ের একেবারে মধ্যেখানে হেলান দিয়ে পুটলা হয়ে বসে আছেন। বিকালে নদীতে মুখ বাড়িয়ে বদনায় জল তুলতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে গেছিলেন। সে এক খিটকেল। কেউই প্রথমে খেয়াল করেনি। যখনই, ‘ঝপাং’ শব্দটা কানে এসে বেজেছিল, অমনি চোখ পড়তেই, ‘হায় আল্লাহ’ বলে জলে ‘ঝপাং’ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নুহু। মতি নৌকোর মটকা থেকে ‘খড়মড়’ করে ছুটে এসে ‘হাপুস’ ‘হাপুস’ করতে থাকা বুড়ো হাতটাকে হুকের মতো জাপটে ধরেছিল। নুহু জলে দাঁড়িয়ে মা’র কোমর ধরে নৌকোর উপর ঠেলে চাগান দিয়ে ধরেছিল। নৌকোর ওপর থেকে টেনে তুলে নিয়েছিল মতি। সে ফাঁড়া বেঁচে গেছিলেন হালেমা। ছেলেদের কাছে খেয়েছিলেন, আচ্ছা বকুনি। মতি তো চোখ গরম করে বলেছিল, “তোমার অত নিজে থেকে মুড়োলি করা কী দরকার? যা পারবে না তা গায়ের জোরে করা কী দরকার? আমরা কি মরে গেছি? না বানের পানিতে ভেসে গেছি?”
“একবার হুকুম করলেই তো হত। আমরা তো এখানেই বসে আছি।” ভেজা কন্ঠ কাঁপিয়ে গরম করে উঠেছিল নুহু। হালেমা সেরকম কিচ্ছু বলেননি। কাকভেজা জুবুথুবু শরীরটা হালছিল। ঠোঁট মিহি করে আলগোছে বলেছিলেন, “পা’টা হড়কে গেল যে, আমি কী করব।”
“এ কি আর সমান জায়গা? উঁচুনিচু এবড়ো খেবড়ো পাটাতন। পা তো হড়কাবেই। আর তোমার পায়ে কি আর সেই জোর আছে, যে হড়কার ঝুল সামলাতে পারবে?” বিড়বিড় করে উঠেছিল মতি। হালেমা ভেবেছিল, ঠিকই তো, আমার পায়ে কি আর সেই জোর আছে? পায়ের হাড় তো কবেই নড়বড়ে হয়ে গেছে। গোস্তগুলোও শুকিয়ে শুকনো হাড়ের সঙ্গে চামটে লেগে হাড় হয়ে গেছে। এই ঠনঠনে নড়বড়ে পা কি আর বুড়ো শরীরের ভার সামলাতে পারে? এতদিন যতই সংসারের হাজার হাজার ভার সামলে আসুক, এই পাদুটোর ওপর ভর দিয়ে যতই কেটে যাক এতদিনের হেঁসেল-গোহাল, বুড়ো তো একদিন সবাইকেই হতে হয়। বয়স যেমন চুলের হয়, হাড়েরও তো হয়? তারপর নড়বড় করতে করতে এক সময় এভাবেই ‘কট’ করে ভেঙে যায়। তখন মন বুঝতে পারে দেহের বয়স হয়েছে। আবার কতদিন!
হাওয়াটা ধীরে ধীরে ঘূর্ণি পাকাচ্ছে! একবার ‘বুঁ-উ’ করে শিং বাঁকিয়ে হাওয়াটা যেই ছইয়ের ভেতরে ঢিপালো, অমনি ছেড়া গলায় একবার ‘খক’ করে ‘ঝিল্লিকাশি’ কাশলেন জাফর আলি। ‘থক’ করে উঠল হালেমার ভেতর। থুত্থুরে স্বরথলি বলে উঠল, “এই জানখেকি ঝড় তোদের বাপ’টাকে মনে হয় ছিনিয়ে নিয়ে যাবে রে!”
“মা, ওসব কথা এখন রাখো তো? আব্বার গায়ে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে দাও।” চোখ বাঁকাল মতি। মনে মনে বলল, মেঘ যেভাবে গ্যাংড়াচ্ছে, তাতে শুধু বাপ একা কেন, বাপ’এর ব্যাটাগুলোকেও ‘গব’ করে গিলে খেয়ে জানগুলোকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।
“আমার মন বলছে, এ মেঘ যত গর্জাচ্ছে, তত বর্ষাবে না।” আকাশের দিকে চোখ তুলে আলুথালু করে বলল নুহু। “এভাবে চিড়িক চিড়িক করে বিদ্যুৎ ছিঁড়ে পড়া, দুম দাম করে ঢোল ফাটানোর মতো মেঘ গর্জানো দেখে তোর কি মনে হচ্ছে, আকাশ ঢলাচ্ছে? গতবারের আগের বারের কথা তোর কি মনে নেই, এক ঝিনয়ের মতো মেঘ কীভাবে মুহূর্তে পাহাড় হয়ে আছড়ে পড়েছিল মাটিতে! ‘আশ্বিনের ঝড়’ কীভাবে ‘নিশ্চিহ্নের ঝড়’ হয়ে উঠেছিল! গ্রামের একটাও খড়ের চালা অবশিষ্ট ছিল না! উপড়ে নিয়ে গেছিল ভিতের খুঁটি। চালার ঠ্যাকনা। কীভাবে ‘বনবন’ করে ঘুরছিল, ধানের শুকনো আউড়গুলো! হিন্দুপাড়ার শ্যাম কাকার কথা মনে নেই? বুড়োটার ধুতি পাকুড় গাছের মটকায় আটকে গেছিল!”
‘শ্যাম কাকার ধুতির’ কথাটা মনে পড়ায় মনে মনে ‘ফিক’ করে হেসে উঠল নুহু। সে এক কিত্তি! মাঠ থেকে ফিরছিলেন শ্যাম বাড়ুই। সত্তর বছরের হাড়গিলে বগা বুড়ো। বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে ঝড়ের মুখে পড়েছিলেন। ব্যস, আর যান কোথায়। আশ্বিনের ঘূর্ণি ঝড়টা তার পায়ের গুল্লে দিয়ে হাঁটু ডিঙিয়ে অন্দরে ঢুকে পরনের দুধ সাদা ধুতিটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেছিল। ‘এইযযা এইযযা’ করতে করতে গায়ের সাদা পাঞ্জাবিটাকে নিচের দিকে টেনে ধরে, আলুথালু হয়ে কোনোরকমে পাশের বাড়িটার ভেতরে সেধিয়ে গেছিলেন বুড়োটা। পাকুড় গাছের চাতালে বসে থাকা জনা কয়েক এঁচোড় পাকা ছেলে-ছোকরা শ্যাম বুড়োর হাল দেখে সে কী হাসি, ‘খি খি’ করে দাঁত বের করছিল। হাসিতে একেবারে গড়ে পড়েছিল। পাকুড় গাছ লাগোয়া ধানের খেতিটায় নিড়ানি দিচ্ছিল মতি আর নুহু। মতি তো চোখ গরম করে, ছেলেগুলোর পাকামো দেখে ধমকানি দিয়ে উঠেছিল, “এই ত্যাঁদরের দল, লোকটাকে নিয়ে ঠাট্টা করা হচ্ছে? তোদের পাছায়ও যখন ঝড় সেধিয়ে যাবে, তখন বুঝবি মজা।”
চলবে...
আগের পর্ব পড়ুন