ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩০
নেই দেশের নাগরিক
“আর এই ঘাগুমাল’টাকে ‘আউট’ করতে না পারলে, তুই কিন্তু এই মাকড়সার জালের ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারবি না। এই যে তুই ভাবছিস, দু’দিনের মধ্যে চুরি করে গোপনে এখান থেকে হুট করে তোর আব্বা-মা’দের হদিশ করতে যাবি, সেটা ও মাল বেঁচে থাকা অবধি হবে না। সেটা করতে হলে, ওকে ‘আউট’ করতেই হবে। ওর মৃত্যুই আমাদের সমাধান।“
“কিন্তু সেটা তো আরও মারাত্মক কঠিন কাজ। ব্যাপক ঝুঁকি। বিপদ একেবারে পায়ে পায়ে।“
“শোন, একটা কথা আছে না, বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো।“
“হ্যাঁ, তা আছে।“
“তাহলে, আবার চিন্তা কীসের?”
“চিন্তা কীসের মানে? ‘প্রবাদ’ আছে মানেই কি ‘সমাধান’ আছে? ও তো কথার কথা। সব কথা কি সব জায়গায় খাটে?”
“ভুলে যাস না, ‘সমস্যা’ আছে মানেই ‘সমাধান’ আছে। শুধু খুঁজে বের করার বুদ্ধি লাগে, এই যা।“
“কিন্তু, এ যে অন্ধকার আর অন্ধকার, ঘুটঘুটে অন্ধকার। ওসব চক্রান্ত আর অভিসন্ধির কাঠখড়ও তো দেখতে পাওয়া যাবে না!”
“অন্ধকারকে দেখার জন্যেও আল্লাহ মানুষকে একটা চোখ দিয়েছেন। সে চোখ বন্ধ রাখলে হয় না। আর সেটা হলো, বুদ্ধির চোখ। বুদ্ধির চোখের সামনে সব অন্ধকারই আলো।“
“কিন্তু, এ সমস্যার মাথা তো বহুদূর লম্বা। তার নাগাল পাওয়া কি সম্ভব?”
“সমস্যার মাথা নয় বন্ধু, সমস্যার গোঁড়া কাটতে হয়। আর তার জন্যে শিকড়ে শিকড়ে চলতে জানতে হয়।“
“তোর অত ধাঁ ধাঁ’ওয়ালা কথা আমি বুঝতে পারছি না। কী করতে হবে এখন সেটাই বল।“ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আতিফ। জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে চোখ ফেলল। বাইরে ‘সকাল’ হামাগুড়ি দিয়ে উঠে, ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ করে কেবলই হাঁটছে। রোদের মাড়িতে গজাচ্ছে দাঁত। জানালার রডের ফাঁক দিয়ে তেরছা করে ঢুকছে ‘কিত কিত খেলা বয়সী দিন’।
“শোন আতিফ, আমি একটা প্ল্যান অলরেডি করে রেখেছি। তুই যদি সঙ্গ দিস, তবেই সেটা করা সম্ভব।“ আতিফের ঘাড়ের কাছে এসে দাঁড়ায় নবী। আতিফ তার দিকে মুখ তুলে দাঁড়ায়। থুতনি ছোট করে বলে, “কী প্ল্যান?”
“ওদিকে আয়।“ বলে নবী জানালার কাছ থেকে সরে এসে ঘরের আড়ালে এসে দাঁড়াল। আতিফও তার কদমে কদম মেলাল। “এখানে বোস” বলে সোফাটায় আলতো করে বসল নবী। আতিফ চেপে বসতে গিয়ে ‘কচ’ করে একটা মিহি শব্দ গেয়ে উঠল। নবী যেখানে বসেছিল সেখান থেকে কিছুটা সরে গিয়ে আতিফের গা ঘেঁষে বসল। তার দেহের ভারে কুঁচকে যাওয়া শোফার গদিটা তাওয়ায় ভাজা রুটির মতো ফুলে উঠল। “ভালো করে শোন, আতিফ।“ বলে নবী তার মনের মধ্যে আঁটা ষড়যন্ত্রের ‘ফন্দিফেউর’গুলো ফুসুরফুসুর করে বলতে লাগল। সেসব শুনতে শুনতে আতিফের থির চোখগুলো ঘুঘু পাখির মতো ঘোলা পাকিয়ে পাকিয়ে চিলের মতো ধারালো হয়ে উঠতে লাগল। পাকানো দড়ির মতো টান হয়ে উঠতে লাগল চোখের তটরেখার চামড়া। মণির নিচে রক্ত রঙের নালা। যেন রাগ আগুন হয়ে বেরিয়ে আসছে। কানের লতিকায় নেমে এসে জমছে প্রতিহিংসা।
“ঠিক আছে। তুই যা বললি, তাইই হবে। তোর কথামতোই কাজ হবে।“ গা ঝাড়া দিয়ে উঠল আতিফ।
“ও কে বন্ধু, চল, এবার গৃহযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।“ বলে হো হো করে হেসে উঠল নবী। আতিফের ঠোঁটের কলসা দিয়েও বেরিয়ে এল বাঁকা হাসি। চোখও ট্যারা করে ‘ফিক’ করে উঠল।
সাত
‘দেহ’টা গাড়ির ভেতরে ন্যাকড়ার মতো দুমড়ে মুচড়ে গেছে! সামনের ভিউকাঁচ ভেঙে চোখ ফুঁড়ে গেছে! ‘সেফটি বেল্ট’ ব্যবহার না করায়, শরীরটা হ্যাঁচকা টান সামলাতে না পেরে একেবারে ‘ঠক’ করে কাঁচে লেগে থেঁতলে একাকার! একেবারে স্পটডেথ! পেছনের সিটে বসে থাকা দু’জন নিরাপত্তাকর্মীর মাথা-বুক-পেট এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে লোহালক্কড় ঢুকে একেবারে ছ্যাড়ড়া ব্যাড়ড়া হয়ে গেছে! মনে হয় ‘বাপ গো’ বলারও সময় পায়নি! ড্রাইভারের পেট চিরে ঢুকে পড়েছে ‘স্টেয়ারিং’। চোখের মণি ফুঁড়ে আটকে গেছে সম্মুখের কাবা শরীফের ছবি রাখা স্টিলের নকশাকাটা শো-পিসদানিটা। লালরঙের বিলাসবহুল ‘অডি এ সিক্স’ গাড়িটির চারজন সওয়ারিরই ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয়েছে। ঝাঁ চকচকে গাড়িটি চট্টগ্রাম-বান্দরবান মহাসড়ক থেকে ছিটকে পাশের নয়ানজলিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। গাড়িটা যেখানে আটকে আছে, সেখানে নাগবল্লীফুলের একটা ঘন ঝোপ। চারপাশকে ছেয়ে আছে পাহাড়ি ভাঁটফুল। দোপ হয়ে আছে জংলি ঝুমকা লতা। পুরো গাড়িটা ঠোঙার মতো দুমড়ে মুচড়ে গেছে। দশ চাকার পাথর বোঝায় ট্রাকটা পেছন থেকে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এসে সরাসরি ‘চারচাকা’ গাড়িটাকে ধাক্কা মেরে, ‘গ’ করে আরও হাইস্পিডে পিকআপ তুলে পালিয়েছে। জায়গাটা একটা ফাঁকা মাঠ। কাছের বাজারঘাট বলতে গেলে, সেই দূরে রোয়াংছড়ি পুলিশ-ফাঁড়ি। তাও সেটা কম করে আট দশ মাইল তো হবেই। রাস্তার দুপাশে সেরকম বাড়িঘরও নেই। মাইল খানেক দূরে একটা ধাবা গোধূলির আলোতে লুকোচুরি খেলছে। সন্ধ্যা কেবলই তার ঝাঁপি খুলছে। মাগরিবের আযান দেওয়া মিনিট কুড়ি মতো হলো। ‘অডি এ সিক্স’ গাড়িটা যখন পেছনের পাহাড়ের ঢালের হিন্দু গ্রাম ধোপাছড়ি ছেড়ে আসছিল, তখনই মিহি করে কানে ভেসে আসছিল শঙ্খধ্বনি। তাও সেটা আধঘণ্টা মতো হয়ে গেল। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটাকে দেখে রাস্তায় চলন্ত দুএকটা গাড়ি ‘ঘ্যাঁচ’ করে থামল। কেউ জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখে চলে গেলেন। কেউ কেউ গাড়ি থেকে বেরিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটার ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকিঝুকি মারতে লাগলেন। তারপর আপন আপন গন্তব্যে কেটে পড়তে লাগলেন।
এদিক ওদিক হুচুক পুচুক করে, তিনটে রাস্তা বদলে একটানা প্রায় তিরিশ কিমি পথ পেরিয়ে একটা পেট্রোল পাম্পের কাছে এসে থামল ট্রাকটা। পাম্পটার গা লাগা একটা চাটাইয়ে ঘেরা চায়ের দোকান। গাড়িটা তখনো ‘কটকট’ করছে। পাকা ইটের রঙের ট্রাকটার ইঞ্জিনটা তেতে আগুন। পেট্রোল পাম্পের তালগাছের মতো লম্বা ল্যাম্পপোস্টের দুধ সাদা আলোতে গাড়ির পেছনের লোহার উপরে লেখাগুলো জ্বলজ্বল করছে। কালো কালি দিয়ে বড়বড় হরফে লেখা গাড়ির নম্বর। তার উপরে নীল কালি দিয়ে লেখা ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন’। তার এক সিঁথি নিচে লাল রঙ ধেড়িয়ে লেখা, ‘ডোন্ট কিস মি’। ‘হড়াম’ করে বামদিককার গেট’টা খুলে লাফ মেরে নিচে নামল আতিফ। ডান দিকের ড্রাইভারের আসন থেকে পাদানিতে পা দিয়ে ‘থপ’ করে নামল নবী। দুজনের মুখেই সাফল্যের চওড়া হাসি। চোখে খুশির কাশফুল। আতিফ নবীর কাছে আসতেই, নবী বলল, “ব্যাটা খালাস।“
“খালাস মানে, একেবারে ভুউউ করে উপরে পাঠিয়ে দিয়েছি। সরাসরি আজরাইলের দরবারে।“ আতিফের ঠোঁটে যুদ্ধজয়ের হাসি।
“প্ল্যানিংটা কেমন ছিল, বল?” লাল রঙের গামছাটায় মুখ মুছতে মুছতে বলল নবী।
“ফাটাফাটি।“
“একেই বলে, লাঠিও ভাঙল না আবার সাপও মরল। তবে, সাবিরকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে। ও একেবারে ঠিক ঠিক খবর দিয়েছে, কখন হোটেল থেকে বেরোলেন, কখন গাড়িতে উঠলেন, গাড়ির রঙ, নম্বর, রুট, সমস্ত কিছুর ব্যাপক টাইমিং করে দিয়েছে! ওর মতো পাকা ছেলে না থাকলে, আমরা এত সহজে কাজটা হাসিল করতে পারতাম না।“
“আসলে, সাবিরের ফোন মানে ছিল, বেটা জুনাইদ মোল্লার মৃত্যুর ফেরেস্তা আজরাইলের ফোনকল। হা হা।“ আতিফের ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি।
“আর আমরা হলেম কি সেই আজরাইলের নখ-দাঁত। হা হা।“ নবীর ঠোঁটেও তাচ্ছিল্যের হাসি।
“কেউ লরির নম্বরটা দেখে নেয়নি তো!” আতিফের চোখে সন্দেহের মেঘ।
“আরে না না, যখন ঘটনাটা ঘটে, তখন ওখানে কোনো জনমানুষ ছিল না। না ছিল মানুষ, না ছিল কোনো গাড়ি। আমি তো ওই জায়গাটার জন্যে অতক্ষণ পেছন পেছন যাচ্ছিলাম। আমি তো জানি ওই জাগাটায় সব থেকে ফাঁকা। ধাক্কা মেরে পালিয়ে আসার পক্ষে আদর্শ। আর কেউ যদি দূর থেকে দেখেও থাকে, কিচ্ছু কবলাবে না। আরে এখন কেউউ ঝুটঝামেলার মধ্যে ঢুকতে চায় না। সবাই আপন আপন গা বাঁচিয়েই চলে। সুতরাং ও টেনশন মনের মধ্যে পুষে রাখার কোনো দরকারই নেই। একেবারে ফ্রেস থাক।“
“ঠিক তো?”
“আলবাত ঠিক।“
“ওকে, তাহলে চল, এবার জম্পেস করে একটা চা খাই।“
“তা আর দেরি কেন? এক্ষণই চল।“ বলেই নবী চায়ের দোকানটার দিকে পা বাড়াল। যেতে যেতে আতিফ বলল, “তবে তুই যা ড্রাইভ করলি না, একেবারে পাকা ড্রাইভার। হেঁচিয়ে পেঁচিয়ে, এদিক ঘুরিয়ে ওদিক ঘুরিয়ে, হাইস্পিডে পিকআপ তুলে, গ গ করে যেভাবে গাড়ি টানলি, মায়রি, তুই এরোপ্লেন চালাতে পারবি।“
“ছোট থেকেই আমার গাড়ি চালানোর নেশা। আমাদের বাড়িতে একটা ট্রাক্টর ছিল, আমি মাঝেমধ্যেই চালাতাম। কতদিন ট্রাক্টরে করে জমি বাতাল করেছি। আর আর জে এফ’এ এসে তো হাতটা আরও পোক্ত করতে হলো। আমরা যে মুজাহিদ, আমাদের সবই শিখে রাখতে হয়।“ বাড়ির কথা বলতেই, আতিফের আব্বা-মা, ভাইয়েদের কথা মনে পড়ে গেল। ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল মন। ভারী গলায় আতিফ বলল, “কাল সকালেই বেরিয়ে যাব। আর দেরি করা একদম ঠিক হবে না।“
“সেইই ভালো। আবার তো ফিরে আসার ব্যাপার আছে।“ আতিফ একটা তেলচিটচিটে কাঠের বেঞ্চের উপর পা ঝুলিয়ে বসল। নবী জলের জগটা হাতে নিয়ে ঝোপের আড়ালে চলে গেল। হাতের চেটোয় জল ঢেলে চোখে মুখে ছিটা দিল। পরপর তিনবার জলের ছিটা দিল মুখে। তিন সিকি ক্লান্তি যেন জলের মধ্যে দিয়ে ঝরে গেল। বেশ ফ্রেস লাগছে শরীরটা। জলের জগটা একটা কাঠের টুলের উপর রেখে আতিফের পাশে আরাম করে বসল। “তুই চোখে মুখে পানি দিবি না?” জিজ্ঞেস করল আতিফকে। “নাহ, এই ঠিক আছি। ঘরে গিয়েই গোসুল করে নেব।“ বলল আতিফ।
“এই দুটো দুধ চা।“ নবী হাঁক ছেড়ে চায়ের অর্ডার দিতেই আতিফ বলল, “অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। চা বাদ দিয়ে অন্য কিছু খাবি কি?”
“নাহ, শুধু চা, তুই খেলে খা।“
“নাহ, আমিও কিচ্ছু খাব না, পেট’টা গুড়গুড় করছে। অনলি চা।“
চলবে...
এসএন