ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৯
নেই দেশের নাগরিক
খরগোশের মতো কান খাড়া করে উঠল আতিফ! ভ্রূ টান হয়ে চোখ কপালে আটকে গেল! কানের জুলপি টান হয়ে উঠছে। চোখের মণিতে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বিস্ময়! ঠোঁটজোড়া কাটা মাছের পাখনার মতো ফিনফিন করে হেলে উঠল, “আস্তে নবী!” বলেই নবীর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে ঘরের ভেতরে ঢোকাল আতিফ। তারপর তার হলহল করে হালতে থাকা শরীরটাকে চার দেওয়ালের মধ্যে লুকিয়ে বলল, “তুই কী বলছিস, তুই জানিস?”
“আলবাত জানি। হান্ড্রেড পারসেন্ট জানি।“
“তোর মাথা সত্যি ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে মানে, পুরো হান্ড্রেড অ্যান্ড হান্ড্রেড পারসেন্ট ঠিক।“
“আমার তো মনে হচ্ছে, তোর মাথায় মগজ বলে আর কিচ্ছু নেই। যা আছে তা হলো মড়ার খোল। আর.....।“
“আর কী?” ঠোঁটে বাঁকা হাসি নবীর।
“আর তোর পিঠে মরণের পাখা গজাচ্ছে।“
“মরণের পাখা আবার গজাচ্ছে কী রে! মরণের পাখা তো কবেই গজিয়েছে। এ পাখা নিয়েই তো ঘুরে বেড়াচ্ছি।“
“আর ঘুরে বেড়াতে হবে না। তুই যা ভাবনাচিন্তা মাথায় করে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিস, তাতে তোর ছায়াই তোর পাখা কেটে দেবে। তুই কি ভুলে যাচ্ছিস, তুই যাকে খুন করার কথা বলছিস, তার লোক ছায়ার মতো মানুষের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ায়।”
“তুইও একটা কথা ভুলে যাচ্ছিস, আতিফ, ছায়ারও ছায়া থাকে। বাপের যেমন বাপ থাকে, তেমনি ছায়ারও ছায়া থাকে।“
“কিন্তু একটা জিনিস আমার মাথায় কোনোভাবেই ঢুকছে না, হঠাৎ ‘জুনাইদ মোল্লা’ কেন?” ‘জুনাইদ মোল্লা’ নামটা বলার সময় কণ্ঠটা একেবারে নামিয়ে মিনমিন করে বলল আতিফ।
“অত ভয়ের কিছু নেই। অত চুপসে যাচ্ছিস কেন? তুই তো ব্যাটা ভয়ে ছানা ময়দা হয়ে যাচ্ছিস!” নবী আতিফকে ঠেস মারল। আতিফ দরজার দিকটায় একবার চোরা দৃষ্টি ফেলে বলল, “তুই পোড়া লোহা হো গা। ইস্পাত হো গা। আমি ময়দা হয়েই থাকতে চাই।“
তারপর কণ্ঠ লুকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ, হঠাৎ জুনাইদ মোল্লা কেন? ওঁকে উপরে পাঠিয়ে আমাদের কী লাভ? আমি তো চোখের সামনে কিছুই সেরকম দেখতে পাচ্ছি ন্যা!”
“দেখতে পাবি, দেখতে পাবি, ঠিক দেখতে পাবি। দেখার মতো দেখলে ঠিকই দেখতে পাবি। শ্বাসমূলের মতো একটু মাটি ফুঁড়ে ওঠ, ঠিকই দেখতে পাবি। ওই মাল’টাই তো যত নষ্টের গোঁড়া।“
“যত নষ্টের গোঁড়া! জুনাইদ স্যার! আমাদের জে সি ও জুনাইদ মোল্লা যত নষ্টের গোঁড়া!” চোখ, ঘেলু সব ঘোল পাকিয়ে যাচ্ছে আতিফের। নবীর কথায় সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হিসেবের কোনো অংকই মেলাতে পারছে না সে। ‘কচ’ করে কাঠের চেয়ারটা টেনে এলানো বস্তার মতো ‘ধপ’ করে বসল। নবী সোফাটার পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, “ব্যাটা, জুনাইদ, দু’দিক থেকে মালকড়ি ভালোই কামাচ্ছে।“
“দু’দিক থেকে মানে!” চোখ বড় করল আতিফ।
“দু’দিক মানে, ‘আইএসআই’ আর ‘এমএসএস’।“
“’এমএসএস’! মানে, চীনের গুপ্তচর সংস্থা?”
“ইয়েস ফ্রেন্ড, চীনের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, মিনিস্ট্রি অব স্টেট সিকিউরিটি। যাকে আমরা বলি, ড্রাগনের আগুন।“
“’এমএসএস’র সাথে আবার কী করে কানেকশন তৈরি করলেন!”
“ওটাই তো ঘেলুর খেল, বন্ধু। তলে তলে সব ঘাটের পানি খাচ্ছেন। এ মুখে একবার চুমু খাচ্ছেন, ও মুখে একবার চুমু খাচ্ছেন। মালটা ‘ঘাগু’। আগাও খান তলাও খান। অথচ আমরা ওসবের কিছুই টের পাই না। ‘আইএসআই’এর কাছ থেকেও কাড়ি কাড়ি টাকা নিচ্ছেন আবার ‘এমএসএস’এর কাছ থেকেও কাড়ি কাড়ি টাকা নিচ্ছেন। আর আমাদের মতো ভিটেছাড়া, এঘাটে ওঘাটে ঠক্কর খাওয়া, দিশাহীন, অবসাদগ্রস্ত, দিকভ্রান্ত ছেলেদের ‘বেহেশত’ ‘হুরি’র স্বপ্ন দেখিয়ে ‘মুজাহিদ’ বানাচ্ছেন। আর আমরা তাতে ‘ধেই’ করে নেচে উঠছি। ‘শহীদ’ হওয়ার জন্যে ছটফট করছি। আমরা তো ভাঙা থাম। শেকড় উপড়ানো গাছ। আমাদের যেন কিচ্ছুই করার নেই। শুধু নিজেই নিজের কবরটুকু খুড়লেই বাঁচি!”
“তুই এতসব জানলি কী করে?”
“আমি তো আর তোদের মতো চিনির মতো মিশি না, আমি ওদের সাথে তেলের মতো মিশি। মিশে ভূত হয়ে যাই না। পানি হয়েও যাই না। আলাদা করে হয় তলে অথবা ওপরে ভেসে থাকি। শোন, জীবনটাকে সোজা পেরেকের মতো করে লাভ নেই, অত সোজা হলে হাতুড়ির ঠোকা খেয়ে পুঁতে যেতে হবে। পারলে একটু ব্যাঁকা ট্যারা হো।“
“তুই এত চালাক, আগে তো একচুলও জানতাম না!”
“জানার কী দরকার? আর এ তো চালাকি নয়? এ হলো ‘পেছনের চোখটা খুলে রেখে চলা আর কী।“
“তুই ওভাবে পানি মেপে চলতে পারিস!”
“না পারার কী আছে। আল্লাহ মগজে বুদ্ধি তো কম দেননি? এ মগজ যেমন বারুদ হতেও পারে, আবার মোম হতেও পারে।“
“তুই যে ভেতরে ভেতরে এত শুঁয়োপোকার মতো চরে বেড়াস, তা ঘুণাক্ষরেও আঁচ পাইনি কোনদিন!”
“এ যে মাকড়সার জালের দুনিয়া। পদে পদে বাঁধা। ফন্দি-ফেউর। চোখ-কান না খুলে চললে তো সমূহ বিপদ। মাথার ঘেলু থেকে যেমন ‘গোলাপ ফুল’ ফোটাতে হবে, ঠিক তেমনই, ঘেলুর দাঁত-নখও ফোটাতে হবে।“
“তুই এত পাকা হলি কবে, নবী!” তাজ্জব হয়ে যাচ্ছে আতিফ। যেন এ নবী তার এতদিনের চেনা নবী নয়, এ কোথা থেকে দুম করে পড়া অন্য নবী। অন্য মানুষ।
“মানুষ এমনি এমনি পাকা হয় না, বন্ধু, তাকে পাকতে হয়। মানুষ আপনা আপনি বয়সে পেকে যায়, কিন্তু বুদ্ধিতে পাকে না, বুদ্ধিতে পাকতে গেলে, তাকে বুদ্ধি ঘেঁটেই পাকতে হয়।“
“সবই বুঝলাম, কিন্তু জুনাইদ মোল্লার মৃত্যুর সাথে আমার নয়াপাড়া ক্যাম্প যাওয়ার কী সম্পর্ক?” পিঠ খাড়া করে বসল আতিফ।
“সম্পর্ক আছে আছে। মগজে একটু ঠোকা দে, তাহলেই বুঝতে পারবি।“
“ঠোকা দেব কী, মাথা খুঁটেও কিচ্ছু পাচ্ছি না।“
“আচ্ছা, তোকে এখানে সব থেকে কে বেশি ঘরবন্দি করে রাখার জন্যে কড়াকড়ি করেন?” মাথা খুঁটে আতিফ। হন্যে হয়ে মাথার ঘেলু হাতড়ায়। মাথাটাকে হাঁটুর কাছে ঝোঁকায়। এক মাথা তিন মাথা হয়। “নাহ, ঠিক কাউকে তো সেভাবে ভেবে পাচ্ছি নে!” মাথা তোলে। নবীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কে বল তো?”
“এত সহজ লোকটাকে নাগাল করতে পারছিস ন্যা!”
“নাহ, ঠিক আন্দাজ করতে পারছি ন্যা। হ্যাঁ, তবে, একজন খুবই তোখিদ করেন।“
“হ্যাঁ, ওটাই তো টেকনিক। উপরে তোখিদদারি, আর ভেতরে চৌকিদারি।“
“মানে?”
“মানে, সহজ, পানির মতো সহজ। সে লোকটা কে?”
“জুনাইদ স্যার। এ তো সবাই জানে, জুনাইদ স্যার, আমার ব্যাপারে বেশি খেয়াল রাখেন।“
“ওখানেই তো রহস্যটা লুকিয়ে আছে।“
“রহস্য!”
“হ্যাঁ, রহস্য। একটা জিনিস কি খেয়াল করেছিস? তুই যখনই, কায়রাপরীর টংকীর কথা তুলিস, তখনই জুনাইদ স্যার কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ওই প্রসঙ্গটা তুললেই উনি কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করেন। ব্যাপারটা যেন কাঁটার মতো তাঁর গায়ে বিঁধে।“
“হ্যাঁ, তা ঠিক, কেমন আমতা আমতা করেন।“
“এখনি তো দেখলি, তুই যেমনি প্রসঙ্গটা তুললি, আর উনি অমনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। আমি তোকে চোখ টিপে ছিলাম, কায়রাপরীর প্রসঙ্গটা ওঁর সামনে না বলার জন্যে। কিন্তু তুই হাঘরা, আমার ইশারাটা বুঝতেই পারলি ন্যা!”
“কিন্তু, আমার নাফ নদীতে গিয়ে আব্বা-মাদের উদ্ধার করার সাথে, জুনাইদ স্যারের আমাকে তোখিদ করা, কায়রাপরীর টংকী, এতসবের কী সম্পর্ক!”
“এগুলো হলো এক একটা কাঁটা। নাফ নদীতে গিয়ে তোর আব্বা-মাদের উদ্ধার করাটা তোর কাছে যদি একটা ফুলের মালা হয়, তাহলে এগুলো জুনাইদ স্যারের কাছে ওই ফুলের এক একটা কাঁটা। তুই যে এত কট্টর চীন বিরোধী, সেটা উনি পছন্দ করেন না। উনি সন্দেহ করেন, তুই তলে তলে ইন্ডিয়ান গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ এর সাথে যোগাযোগ রাখিস।“
“বলছিস কী!”
“হ্যাঁ, অত অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমি ঠিকই বলছি। এ সন্দেহের দুনিয়া রে বন্ধু, সন্দেহের দুনিয়া। এখানে দেওয়ালও তার ছায়াকে সন্দেহ করে। জুনাইদ মোল্লা ভাবেন, তুই হয়ত তলে তলে, ‘র’ এর কাছে ওঁর ‘এমএসএস’ এর সাথে যোগাযোগের কথাটা ফাঁস করে দিবি। তাছাড়া উনি কোনোভাবেই চান না, চীনা সৈন্যদের কব্জায় থাকা কায়রাপরীর টংকীর গোপন কথাটা ‘র’এর কানে যাক।“
“’র’ অর্থাৎ ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’?”
“হ্যাঁ, ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা।“ মাথা নড়াল নবী। গলা থিতিয়ে বলল,“তাই উনি সব সময় তোকে ও আমাকে কড়া প্রহরায় রাখেন। আমাদের এই চোহদ্দির বাইরে কোত্থাও যেতে দেন না। আমাদের চোখে চোখে রাখার জন্যে লোক লাগিয়ে রেখেছেন।“
“লোক! আমাদের পেছনে!”
“শুধু কী লোক, বলা হয়, তাঁর কথায় এই জঙ্গলের পশুপাখি, গাছপালাও উঠবস করে। জঙ্গলের প্রতিটি পাতায় তাঁর চোখ লাগানো থাকে। তাঁকে ফাঁকি দেওয়া যার তার কম্ম নয়।“ সোফার এককোণে গা এলিয়ে দিয়ে বসল নবী। সোফার কভার থেকে বের হওয়া সুতোর খুঁট আঙুল দিয়ে পাকাতে পাকাতে বলল, “এই বালুখালি চৌকি আক্রমণের প্ল্যান ‘লিটলবার্ড অ্যাকশন’ এর নীলনকশাও তাঁর মাথা থেকে আসা। তিনিই এর মূল ‘মাস্টারমাইন্ড’। এর পেছনেও তাঁর একটা গোপন অভিসন্ধি আছে।“
“এখানেও অভিসন্ধি!”
“হ্যাঁ, অভিসন্ধি। ছকের ভেতরে ছক।“
“ছকের ভেতরে ছক!”
“হু।“
“সেটা আবার কী?”
“আমরা যেই বালুখালি চৌকি আক্রমণ করব, অমনি চীন মিয়ানমার সরকারকে বলবে, মিয়ানমারের সীমান্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই আক্রমণের পেছনে ‘র’ এর ভূমিকা আছে। ভারত যেকোনো সময় এইসব সেনাঘাঁটি দখল করে নিতে পারে। ফলে, এসব সেনাচৌকি আমাদের কব্জায় থাকাটা বড্ড দরকার। এইভাবে, পরিকল্পনা করে পরোক্ষভাবে বালুখালি চৌকি চীনাদের হাতে তুলে দেওয়া মেজর জেনারেল জুনাইদ মোল্লার টার্গেট। কারণ, চীন জানে, বালুখালি চৌকি তাদের কর্তৃত্বে থাকলে, ভারতকে নিশানা করা আরও সহজ হয়ে যাবে। সমুদ্রপথে ঢিল ছোড়া দূরত্বে যে ভারত।“
“এত কিছু!” ষড়যন্ত্রের হাঁড়ির খবর শুনে আতিফের চক্ষু চড়কগাছ।
চলবে...
এসএন