ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৮
নেই দেশের নাগরিক
জুনাইদ মোল্লারা গাড়ি চেপে ‘ভুউউ’ করে বেরিয়ে গেলে, আতিফ ধড়ফড় করে ইয়াসিন মাস্টারের নম্বরে ফোন করল। ‘যে নম্বরে আপনি ডায়াল করছেন, সেটি এখন বন্ধ করা আছে’। “ধ্যুর”! মেজাজ আরও খাট্টা হয়ে উঠল আতিফের। আরে বাবা একজ্যাক্ট লোকেশানটা জানতে পারলে তো হতো, হুট করে দুদিনের মধ্যে ঘুরে চলে আসতাম। কথাটা আতিফের মনে আউড়িবাউড়ি খাচ্ছে।
“অত মেজাজ হারালে হবে না বন্ধু।“ বলল নবী। ব্যালকনির কাঠের করিডরে দাঁড়িয়ে সেও লেফটেন্যান্ট মজিদ ভাটদের চলে যাওয়াটা দেখছিল। খট খট করে হেঁটে এল আতিফের কাছে। সকালের নাবালক রোদ ব্যালকনির রেলিংএ হামাগুড়ি দিয়ে দেওয়ালে উঠছে। জানালার কার্নিশ ছুঁয়ে কেবলই কথা শিখছে ‘দিন’। নবী নকশার কারিকুরি করা কাঠের রেলিংএ হেলান দিয়ে কণ্ঠ কাঠ করে বলল, “যে জীবন গেছে, গেছে, সে জীবনের জাবর কেটে আর কী লাভ! আমরা এখন শেষ দ্বীপে এসে ঠোকর খাওয়া নদী, এপার ওপার ভেঙে-গড়ে মোহনায় এসে ঠেকেছি। মৃত্যু নামক সমুদ্রের গিলে খেতে আর কতটুকুই বা বিলম্ব আছে! সমুদ্রে বিলীন হলেই তো মুক্তি।“
“এ মুক্তি কীসের? দেহের না মনের? দেহের মুক্তি তো পচনে, কিন্তু মনের মুক্তি তো পচনে নয়? মানুষ যদি এত সহজেই মনের মুক্তি পেয়ে যেত, তাহলে আর কেনই বা ‘দেশ’ কেনই বা ‘ঘর’? একটা ডোবাপুকুরের স্রোত হয়েই ডাঙায় মিশে যেতে পারত। কোনো খড়কুটোরও হিসেব লাগত না। শুধু ‘ঢিল’কে বলত, আরও একটু আগে এসে ঢেউ তোলনি কেন?”
আতিফের মনের একতারাটা ‘টিং’ করে বেজে ওঠে। একটা বাউল হাওয়া সুর গেয়ে ওঠে আহত মননে। নবী আরও খেয়ালি হয়ে ওঠে, “এ মুক্তি শুধু দেহের, মনের নয়। শুধু নিজের মুক্তির জন্যে তো এ পথে আসিনি? এ মুক্তি সমষ্টির। একটা জাতিসত্তার মুক্তি। মনের মুক্তি হলে কী করে আর ‘দেশ’ ফিরে পাব? ‘দেহ’ ‘মন’ দুইয়ের মুক্তি হলে তো সে মৃত্যু ছাগলের, গরুর, ভাগাড়ের পশুর। দেহের মুক্তি হবে আর মন থেকে যাবে মানুষের মাঝে, তবেই না শহীদ, দেশ ও জাতির জন্যে বলিদান? সে ‘মন’ থেকে যাবে মানুষের মননে, বই ও দেওয়ালে, কথা ও সুরে। লেখনির বর্ণমালায় সে ‘মন’ অমরত্ব পাবে। মানুষের গল্পে হয়ে উঠবে ‘চরিত্র’। ‘দেশহীন’ মানুষদের কাছে এনে দেবে ‘দেশ’। ‘ভিটেহীন’ মানুষদের কাছে এনে দেবে ‘ভিটে’।“
“তুই তো পরশু আবার নিজের জন্মভিটেই ফিরে যাচ্ছিস। তোর কেমন আনন্দ হচ্ছে?”
“এ আনন্দ কাফনে মোড়া আনন্দ। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাচ্ছে, এর চেয়ে আনন্দের তো কিছু হয় না? তবু এ আনন্দের পেটে এক রূপ পিঠে আরেক রূপ। পেটে ‘ঘর’ পাওয়ার স্বপ্ন আর পিঠে মৃত্যুর খাড়া। এমন আনন্দ যেন আল্লাহ আর দ্বিতীয় কাউকে না দেন.....।“ ফুঁপিয়ে ওঠে নবী। কান্নার দলা বুক ঠেলে উঠে আসে। আতিফ ঘাড়ে হাত দেয়। বলে, “চোখের পানি মুছ নবী, এ পানি দেখার কেউ নেই।“ তারপর দূরের বককন গাছটার দিকে আনমনা চোখে তাকিয়ে উদাস গলায় বলে, “মাটির মালিক আল্লাহ, তবুও মাটির জন্যেই দুনিয়ায় সব থেকে বেশি মানুষ মরে! মাটির মায়া শরীরের মায়ার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় রে। বিটি মাটি, মাটি বিটি, এইই তো জীবন।“
“আমি তো আগামীকাল ভোরেই চলে যাব। তুই কী করবি?” প্রশ্ন করল নবী।
“সেটাই তো ভাবছি রে, হাতে আর মাত্র চার দিন বাকি, যা করার এই চার দিনের মধ্যেই করতে হবে।“ মাথা ঠুকে আতিফ। নবী চোখ নাচিয়ে বলে ওঠে, “আইডিয়া।“
“আইডিয়া! কী আইডিয়া?” করলাফালির মতো ফেড়ে ওঠে আতিফের চোখ।
“না, থাক।“ কথাটা ঢোক গেলার চেষ্টা করে নবী।
“না, থাক, মানে?” থির চোখ বেঁকে উদগ্রিব হয়ে ওঠে আতিফ।
“কিচ্ছু না, তোকে জাস্ট বাজিয়ে দেখছিলাম।“
“এটা একদম ঠিক হচ্ছে না, নবী। সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা মশকরা ঠিক নয়। তুই মৃত্যু নিয়েও মশকরা করতে পারিস!”
“ঠাট্টা ঠিক নয় রে।“
“তবে!”
“একটা ভাবনা মাথায় এসেছে, ভাবছি তোকে সেটা বলা ঠিক হবে কি না।“
“কোনো কিন্তু না রেখে ফটাফট বলে ফেল। আমি না তোর জানপেরানের বন্ধু?“
“খারাপ মাইন্ডে নিবি না তো?”
“আরে না না, বন্ধুর কথা আবার খারাপ মাইন্ড কী রে!”
“না, আসলে কথাটা একটু অন্যরকম তো, তাই আর কী।“
“অত, ভড়ং না করে বলে ফেল তো, তখন থেকে শুধু গৌরচন্দ্রিকা গেহেই যাচ্ছে! কথাটা পেট থেকে বের করার জন্যে এবার কি পেটে লাথি মারতে হবে?” খচে উঠে আতিফ। একটা ঠাট্টার ঘুষি তুলতে উদ্যত হলে, নবী থতমত করে বলে ওঠে, “আরে থাম, থাম, অত খচে যাচ্ছিস কেন? তোকে কি আর জ্বালানোর ফুরসত পাব? পরশু তো পরকালের টিকিট কেটেই নেব। তখন না থাকবে এ বান্দা, না থাকবে এ বন্ধুর জ্বালাতন।“
“তোর মতো বন্ধুর জ্বালাতন যে জন্ম জন্মান্তর ধরে সহ্য করতে রাজি আছি রে। আল্লাহর কাছে দোয়া চাইছি, তুই যেন পরকালে গিয়েও আমাকে এভাবেই জ্বালাতন করিস।“
নবীকে বুকের মধ্যে পুরে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে আতিফ। নবীরও বুকের বাঁধ ভেঙে যায়। ডুকরে ওঠে। দুই বন্ধুর কাঁদনে সকালের ঝিরঝিরে বাতাসের চোখও সিক্ত হয়ে ওঠে। কষ্টের সুরেলা ধ্বনি পাতাকাঁপার শব্দে মিশে সদ্য ফোটা সকালকে কান্নাতুর করে দিচ্ছে। পাতার আড়াল দিয়ে ঝিলমিলিয়ে পড়া রোদ দুই বন্ধুর চোখের পাতায় এসে ভিজে যাচ্ছে। তাদের ডুকরানো দেখে রোদ টের পাচ্ছে, চোখের কান্নার চেয়ে অন্তরের কান্নার হাহাকার বেশি। যন্ত্রণা বেশি। দেহের চেয়ে ঢের বেশি কাঁদছে রুহু।
“আরে ধুর, আমরা আবার কাঁদছি কেন? আমরা না মুজাহিদ? আমাদের না কাঁদতে নেই। এসব নাকে চোখে মুখে পেটে ফ্যাত ফুত করতে নেই। হাস, হাস, হা হা হা, হাস, হাস, আতিফ, হাস, নবী তুইও হাস, হা হা।“ মাথা ঝুঁকে নিজের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসির রস মিশিয়ে কেমন যেন পাগলের মতো হেসে ওঠে নবী। আতিফ ‘থ’ মেরে যায় নবীর আচরণে। ছুঁড়াটা কি পাগল হয়ে গেল নাকি! কী সব আজেবাজে বকছে! নবীকে উচ্চস্বরে যাত্রাপালার ভিলেনের মতো ঢাক ফাটা হাসি হাসতে দেখে, দুই হাতের কব্জি ধরে ঝাকা দিয়ে বলে উঠল, “এসব কী পাগলামি করছিস, নবী? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল!”
“হ্যাঁ, মাথা খারাপ, মন খারাপ, হাড় মজ্জা সব খারাপ হয়ে গেছে। ভালো রেখেই বা কী হবে। বৌ হবে? বাচ্চা হবে? সংসার হবে? মানুষের জন্মস্বাদ তো পেলামই না। শুধু বারুদ আর কার্তুজের স্বাদেই এ জীবন লোহালক্কর হয়ে উঠল! ফুল না হতাম, একটুখানি মোম তো হতে পারতাম? কারও উষ্ণ ছোঁয়াই একটুখানি গলতে তো পারতাম? গলতে কার না ইচ্ছে করে! গলনেই তো সৃষ্টি। মেঘ গলে বলেই তো বৃষ্টি। না গললে সৃষ্টি হবে কী করে! না গলেই ধোঁয়া হয়ে যেতে হচ্ছে। ধোঁয়া! কিছু না পেয়েই ফুরনোর ধোঁয়া! কোনো মানুষ কি কাঠখড় পোড়ানোর ধোঁয়া হতে চায় না মানুষ গলনের ধোঁয়া হতে চায়? মানুষের ছোঁয়াই মানুষের গলন। জীবনের স্পর্শে জীবনের গলন। সে গলনে আদর আছে, তাপ আছে, আর আছে সমর্পণ। শরীরের সাথে সাথে মনেরও সমর্পণ। এই সমর্পণেই তো বেজে ওঠে সৃষ্টির গান। জীবনের করতাল।“
“কী রে দার্শনিক হয়ে গেলি নাকি! তুই জানিস, তুই কী সব বকছিস!”
“জানি রে জানি। সব মানুষই তো কখনো না কখনো দার্শনিক হয়ে ওঠে। সে হাটের আলু-পটল বিক্রেতাই হোক আর দর্শনের পুঁথি গিলে খাওয়া ইউনিভার্সিটির ডক্টরেটই হোক। যিনিই জীবনকে ছেঁচেছেন, তিনিই দর্শনের পাঠ লিখেছেন। আমরা না হয় শাড়ি ভাঁজের দর্শন শিখিনি, বারুদে আগুন ছোঁয়ার দর্শন তো শিখেছি? জীবনের দর্শন তো ‘মক্কা না ফক্কা’ নয়? জীবনের দর্শন শ্বাসে, বাঁচার স্বাদে। তুই আবার কম কীসে যাস, বন্ধু?”
“এসব ক্লাসের লেকচার শোনাবি, না, ‘আইডিয়াটা’ বলবি? বড়বড় বাতলিং তো ভালোই শিখেছিস?” ঠোঁট বাঁকিয়ে ওঠে আতিফ।
“আচ্ছা, বৌ’র শাড়ি ভাঁজ করে দেওয়ার মধ্যে কতটুকু ‘দর্শন’ লুকিয়ে থাকে জানিস?”
“শালা, আমার তো একশখানা বৌ আছে যে, ওসব ঘেঁটেঘুটে জানা আছে!” রেগে টং হয়ে ওঠে আতিফ।
“না থাক, একটু ভাব, একটু কল্পনা কর।“
“হ্যাঁ, এখন ওসবই ভাবি, জন্মদাতা বাপ-মা পানিতে ঢুবে মরছে, কাল বাদ পরশু নিজেই মরতে যাচ্ছি, আর এখন বসে বসে পরের বৌ’র শাড়ি ভাঁজ করা ভাবি! তোর মাথার ঘেলু মনে হয় সব গোবর হয়ে গেছে!”
“জীবনের স্বাদ তো নিতে শিখলি না! মরণের আগের শ্বাস পড়া পর্যন্ত জীবনের স্বাদ নিতে হয়। মানব জন্ম তো একবারই না? আল্লাহর হাদিস-কোরান তো তাইই বলছে।“
“তো, তুই নাক চুবড়িয়ে স্বাদ নিবি তো অত ভাববিহ্বল হয়ে পড়ছিস কেন? অত দুঃখ কষ্ট মাখা কথা আউড়াচ্ছিস কেন?” আতিফের কথার বাণে এবার ঘায়েল হয়ে যায় নবী। চুপ করে ‘কাপ’ নিয়ে নেয়। আতিফ তার মাথায় আবারও ঠক করে টোকা দেয়, “কী রে, ‘আইডিয়াটা’ বল।“
“ওহ, হ্যাঁ, আইডিয়া।“ নবী এমন করে কথাটা উচ্চারণ করে যেন কোনো ধ্যানমগ্ন ঋষির কেউ ধ্যান ভাঙিয়ে দিল। তারপর কণ্ঠস্বর নিচু করে ফিসফিস করে বলল, “আইডিয়াটা আর কিছুই নয়, একটা খুন।“
“খুন!” আকাশ থেকে পড়ল আতিফ। তার চোখ কপালে উঠার জোগাড়।
“হ্যাঁ, খুন, একটা ছোট্ট খুন। আমরা তো আস্ত একটা ‘রাষ্ট্র’কে খুন করতে চলেছি, সে তুলনায় এটা একটা মামুলি খুন। সেটা একটা গুলিতেও হতে পারে, আবার একটা সাড়ে তিন হাত দড়িতেও হতে পারে।“
“কী সব বকছিস, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না!”
“ঢুকবে, ঢুকবে, ঠিকই ঢুকবে। ঢুকবে না যাবে কোথায়?”
“অত হেঁয়ালি না করে, ব্যাপারটা এবার খুলে বলত।“
“বলবই তো, বলার জন্যেই তো ভেবেছি। না বললে, কাজটা হবে কী করে?”
“ওহঃ, আবার সেই হেঁয়ালি! ছাড় তোর ওসব বাটপাড়ি কথা।“ মেজাজ খাটা করে ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে আতিফ মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলল, “দেখি, এবার ফোন করে লোকটাকে পাই কি না।“ বলেই মোবাইলটা কানে ধরল। পর পর দুবার ‘রিডায়াল’ করে ‘ধুর’ বলে যেই বিরক্তি প্রকাশ করল আতিফ, অমনি ব্যালকনির করিডর থেকে ভেসে এল, “মেজর জেনারেল জুনাইদ মোল্লা খতম!”
চলবে...
এসএন