ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৭
নেই দেশের নাগরিক
“জুনাইদ সাহেব একটু এদিকে আসবেন।“ মজিদ ভাট জুনাইদ মোল্লাকে পাশের ঘুপসি ঘরটার আড়ালে ডাকলেন। জুনাইদ মোল্লা পেছন পেছন থপথপ করে ঢুকলেন। দুজনের মধ্যে ফিসফিস করে কী সব গোপন আলোচনা চলল। নবী আর আতিফ ছোট্ট কুঠুরি জানালার আড়াল দিয়ে দেখল, লেফটেন্যান্ট মজিদ ভাট কী সব বলছেন আর জুনাইদ মোল্লা শুধু মাথা নাড়িয়েই যাচ্ছেন! আতিফের মনটা ভয়ে নাড়া দিয়ে উঠল, আইএসআই’এর অফিসারটা কি আমার মনের কথা বুঝে নিয়েছেন! বিশ্বাস নেই, ঝানু গোয়েন্দা।
গোয়েন্দার পাঠ তো কম পড়া নেই! মুখের কথার ঢং দেখেই পেটের কথা আন্দাজ করতে পারেন। যাকে বলে নাড়ি টিপা ডাক্তার। যদি সেরকম কিছু আন্দাজ করেই ফেলেন, তাহলে তো তার নয়াপাড়া যাওয়া বন্ধ। ঘেরাবন্দি থাকতে হবে। ঘরের চৌকাঠও পার হওয়া যাবে না। সেরকম মনে করলে, কালকের মধ্যেই এখান থেকে অন্য জায়াগায় উড়িয়ে নিয়ে যাবেন। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দুদিন বিছানায় ফেলে রাখবেন। বেশি বাড়াবাড়ি করলে, এই ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতেই সবার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবেন। তখন না বাঁচবে বাপ না বাঁচবে ছেলে। সব গল্পের ওখানেই ইন্তেকাল হয়ে যাবে।
মিনিট পাঁচেক পর দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আতিফ প্রথমে জুনাইদের চোখের দিকে তাকাল, বোঝার চেষ্টা করল তার চোখের ভাষা। আতিফ লক্ষ্য করল, জুনাইদ অন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে কি না। নাহ, সেরকম কিছু বুঝতে পারা গেল না। আতিফ নিশ্চিত ছিল, যদি তাকে নিয়েই আলোচনা হয়, তাহলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই জুনাইদ তার দিকে একটু অন্য ভঙ্গিতে তাকাবেন। কিন্তু সেসবের কোনো লক্ষণ না দেখা যাওয়াই আতিফ নিশ্চিন্ত হলো, তাকে নিয়ে আলোচনা হয়নি। আলোচনার টপিক ছিল হয়ত অন্য কিছু। ফুরফুরে মেজাজে মেজর জেনারেল জুনাইদ নবীকে জিজ্ঞেস করলেন, “নবী তুমি তাহলে কাল ভোরেই রওনা দিচ্ছ।“ নবী মাথা নড়িয়ে বলল, “জি হুজুর।“
“তোমরা সফল হবেই, ইনশাল্লাহ।“ বুকের ছাতিটা কয়েক ইঞ্চি অতিরিক্ত ফুলে উঠল জুনাইদের। তারপর নবীর পিঠে হাত রেখে বললেন, “একটা কাফের মারলে লক্ষ্য নেকি পাওয়া যায়। আর তোমরা কাফেরদের ঘাটি উড়াতে যাচ্ছ। আল্লাহর জান্নাতের দরজা তোমাদের জন্যে হাট করে খোলা রয়েছে। তোমাদের এ জন্ম স্বার্থক। তোমরা শহীদ হওয়ার পথে এগোচ্ছ। আল্লাহ আমাদের মোনাজাত নিশ্চয় কবুল করবেন। আমরা জিতবই।“ কথাগুলো জুনাইদের হৃদয় নিংড়ে বের হয়ে এল। গর্বে ফুলে উঠছে তার বুক। আসলে তারা সবাই যে একই খিদমতের কাজে সামিল। স্বেচ্ছায় গলায় পরে নিয়েছেন মৃত্যুর বরণডালা। মেজর জেনারেল জুনাইদ মোল্লা যৌবনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর রোহিঙ্গা সেনা ছিলেন। টানা দশ বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। তারপর দেশে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হলে, রাগে ক্ষোভে চাকরি ছেড়ে ‘রোহিঙ্গা জেহাদি ফৌজ’এ নাম লেখান। নিজেকে একটু একটু করে মুজাহিদ তৈরি করেন। এদিকে আসাতে তার একটা দগদগে ‘ঘা’ও তাকে ঠেলা দিয়েছিল। তার সদ্য বিবাহিতা টগবগে বৌ’কে মিয়ানমার সেনা ধর্ষণ করে খুন করেছিল। সে রাগ তিনি হজম করতে পারেননি। তার মনে গনগন করে জ্বলে উঠেছিল প্রতিহিংসার আগুন। সে আগুনই তাকে টেনে এনেছিল জেহাদি জীবনে। তিনি সরাসরি সেনাবাহিনী থেকে আসায়, আর জে এফ’এর কাজের অনেকটা সুবিধা হয়। আর জে এফ’এর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে সরাসরি ট্রেনারের পদ দেন। তার প্রশিক্ষণে অল্পদিনের মধ্যেই একটা দুর্ধর্ষ মুজাহিদ টিম আক্রমণ হানার জন্যে তৈরি হয়ে যায়। তিনি মুজাহিদদের বারবার বলতেন, কঠোর পরিশ্রমের কোনো মাইর নেই। ত্যাগ ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই সাফল্য আসবে। আর সঙ্গে থাকতে হবে আল্লাহ রসুলের ইবাদত। মনের এলেম। তিনি বার বার একটা কথা বলতেন, ‘হাঁটিতে পারে না কেউ না খেয়ে আছাড়, পানিতে না নেমে কেউ শেখে না সাঁতার’। তার প্রশিক্ষণের কলাকৌশলে মুগ্ধ হয়ে আর জে এফ তাকে ‘মেজর’ পদে উন্নিত করে। জুনাইদও আর জে এফ’এর জন্যে নিজেকে হান্ড্রেড পারসেন্ট নিংড়ে দেন।
“আতিফ, তুমি কিন্তু এই কটাদিন কোত্থাও বেরোবে না। চব্বিশ ঘণ্টা কন্ট্যাক্টে থাকবে।“ কণ্ঠস্বর একটু কড়া করে বললেন জুনাইদ। কথায় একটু তেঁতো তেঁতো ঝাঁঝ। আতিফ মাথা নাড়াল, “জি”। জুনাইদ নবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা তো থাংখালীর চোরা বর্ডার দিয়েই যাবে। সেরকমই তো প্ল্যানিং হয়েছে। তিনজনের একটা মুজাহিদ বাহিনী ‘থানচি ট্রেনিং ক্যাম্প’ থেকে আসবে। তোমরা বিকেলের মধ্যেই থাংখালী পৌঁছে যাবে। ওখানে আমাদের কমিশন্ড অফিসার ব্রিগেডিয়ার সালিমুদ্দি থাকবেন। তিনিই পুরো ব্লুপ্রিন্টটা ছকেছেন। তিনিই পুরো মিশনটার পরিচালনায় থাকবেন।“
“জি।“ আবারও মাথা হেলাল নবী। জুনাইদ বলতে থাকলেন, “মনে রেখ, একটা আঘাত মানে শত্রুর একটা হাড় ভেঙে দেওয়া। তার রাতের ঘুম হারাম করে দেওয়া। ঘাড়ের কাছে মৃত্যুর নিশ্বাস ফেলা। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, একটা বালুখালী উড়িয়ে দিয়েই হয়ত মায়ানমার সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে না। কিন্তু একথাও ঠিক, এই একটা আক্রমণে ওদের মনে যে ভয় ঢুকবে তাতেই আগামীতে অনেক কাজ সহজ হয়ে যাবে। কথায় বলে, শরীরের আঘাতের চেয়ে মনের আঘাত মারাত্মক।“
“শয়তানদের হৃদয় বলে কি কিছু আছে? মানুষ-খোলের ভেতরে সব ইট-কাঠ-পাথরের কলকব্জা এঁটে আছে। নাড়িভুঁড়ি সব পাষাণ। মুখের দাঁত হৃদয়ের দাঁত হয়ে গেছে। সে দাঁতে পুরা আছে গোখরোর বিষ। নেকড়ের থাবা। ওদেরকে কুচি কুচি করে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিলেও আমার শান্তি হবে না। আমাকে আগুন বানিয়ে দিতে পারেন? আগুন, যে আগুন কখনো নিভবে না। তারপর আমাকে ছুড়ে ফেলে দেবেন, মায়ানমার সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে, পুড়ে ছাড়খাড় করে দেব সব। যতক্ষণ না সব পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ আমি নিভব না।“
“তোমার ভেতরে তো সে আগুন জ্বলছেই নবী, মুজাহিদের আগুন, এ আগুন তো কখনো নেভে না। আমি তো আঁচ পাচ্ছি, তোমার মধ্যে এ আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। তার লেলিহান শিখা জিভ লকলকাচ্ছে। শুধু কাফেরগুলোকে কাছে পাওয়ার অপেক্ষা। তারা কাছে এলেই চৈত্রের শুকনো খটখটে খড়কুটোর মতো পটপট করে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।“ জুনাইদ নবীকে উতপ্ত হতে দেখে আরও খানিকটা তাতিয়ে দিলেন। তাদের জেহাদি সেনার ভাষায়, যেকোনো অ্যাটাকে যাওয়ার আগে, মনমেজাজ এরকম গনগনে হলে, ভালো সিগন্যাল। ভেরি গুড অ্যাচিভ। শত্রুর বিরুদ্ধে মেজাজটাকে ঘেঁটে দিয়ে আরও একটু খচিয়ে দেওয়াই নিয়ম। এক্ষেত্রে বুদ্ধি যেমন লাগে, ঠিক তেমনি রাগ ও হিংসাও লাগে তার ঢের। এ তো আর শুধু নিজের গা বাঁচানো লড়াই নয়, এ হলো, নিজের মৃত্যুর সঙ্গে হাজার শত্রুর মৃত্যু ছিনিয়ে নেওয়া। নিজেকে আজরাইলের কাছে সঁপে দিয়ে হাজার আজরাইলকে শত্রুর শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া। এখানে জীবনের বদলে মৃত্যু, তারপরে মৃত্যুর বদলে আবারও জীবন। নতুন জীবন, নতুন দেশ, নতুন দেশের স্বাধীন স্বাদ। আর সে জীবনের স্বাদ পেতে গেলে, মৃত্যুকে বরণ করে নিতেই হবে। মৃত্যু আর রক্ত ছাড়া যে পৃথিবীতে কখনো স্বাধীনতা আসেনি। আসেও না। কেউই বিনা যুদ্ধে এক ইঞ্চি মাটি ছাড়তে চান না। এ যে অনিবার্য অর্ঘ। নিশ্চিত বলিদান। একজনের মৃত্যুদানের বিনিময়েই যে অন্যজনের সুখ। আর সে সুখের জন্যে কাউকে না কাউকে যে শহীদ হতে হবেই। উৎসর্গ করতে হবে, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-কুটুমে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা সাধের মানবজীবন। ইহকালের সুখ-আহ্লাদ। আনন্দ-ফুর্তি। ঠাট্টা-মশকরা। কাফনের সাদা থানের মতো দাফন হয়ে যাবে সব হিসেব, সব লেনদেন। শুধু ধ্রুব তারার মতো টিমটিম করে বেঁচে থাকবে আল্লাহ-রসুলের দ্বিনের জন্যে আত্মত্যাগ। সে ত্যাগের কথা গল্প-কাহিনি হয়ে মানুষের মুখে মুখে না রটুক, মানুষ তার নিজের মাথা গোঁজার ঠাই পেলেই হলো। ব্যস, এতেই শান্তি, এতেই জান্নাতবাস। একটা মানুষ একটা দেশ পাবে, এর চেয়ে বড় বর আর কী হতে পারে! একটা ঘর, ঘরের ভেতরে খাট, মাথার ওপরে চালা, চালার ডগায় পাখি বসার পায়া, একটা উঠোন, উঠোনে রজনীগন্ধা ফুল, একটা হেঁশেল, হেঁশেলে সেদ্ধ ভাতের হাঁড়ি, এক বিঘে ভুঁই, ভুঁইয়ে লকলক করা ধানের শীষ তারপর দাওয়ায় শীতলপাটি বিছিয়ে গোটা পরিবার একসাথে থালা পেড়ে বসে মায়ের বেড়ে দেওয়া ভাত খেয়ে নিশ্চিত রাতের ঘুম, অন্ধকারের ঘোমটা সরিয়ে তালগাছের মাথা দিয়ে ঝিরঝির করে নেমে আসা চাঁদের হলুদ বাঁটা মিষ্টি আলো। উঠোন ঘর বারান্দার সে নিঝুম জ্যোৎস্না মেখে খিলখিল করে সারা রাত হাসা, এইই তো দেশ। একেবারে নিজের দেশ। এই টুকুর জন্যেই তো নিজের সুখ আহ্লাদ হারাম করে এক স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে যেতে হবে।
“হুজুর, কায়রাপরীর টংকীর ব্যাপারটা একটু দেখুন, চীনের সঙ্গে তো আপনাদের দহরম মহরম ভালো।“ মজিদ ভাটকে সাহস করে কথাটা বলল আতিফ।
“ওটা চীনের পলিটিক্যাল লাইন। ওরা এ লাইন থেকে কোনোভাবেই পিছপা হবে না। চতুর চীন জানে যে, মায়ানমার তাদের কর্তৃত্বে থাকলে, ভারতকে জব্দ করা অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। চিন কায়রাপরীর টংকীতে সামরিক ঘাটি বানাবে। যাতে করে উত্তর-পূর্ব ভারত তাদের নিশানায় থাকে।“ মজিদ ভাট চীনাদের গোপন চক্রান্তের অন্দরের কথা বললেন। যেন হাঁড়ি চেছে সর খাওয়ালেন। ‘খক’ করে একটা শুকনো কাশি কেশে, আতিফের দিকে তাকিয়ে নবী চোখ টিপল। কিন্তু ওদিকে না তাকিয়ে আতিফ বলল, “আমার কিন্তু মনে হয়, চীনের আসল মকশদ, মায়ানমারকে তিব্বতের মতো দখল করে নেওয়া। তাদের উদ্দেশ্য গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে একটা বৃহৎ ‘বৌদ্ধ এস্টেট’ বানানো।“
“এ প্রসঙ্গ এখন আলোচনা না করাই ভালো, তাতে ঘাস মারতে গিয়ে গম মারা পড়ে যাবে।“ কিছু একটা ইঙ্গিত করে ফিসফিস করে বললেন জুনাইদ মোল্লা।
“চীন কিন্তু বিচক্ষণ চালাক। তাদের কাছে ধর্মের চেয়ে অর্থনীতি আগে। তারা এসব ছোট ছোট দেশগুলোকে নিজেদের কব্জায় এনে, বাণিজ্যের বহর বাড়াতে চায়। তাদের কিন্তু আসল টার্গেট, বিশ্বের প্রথম অর্থনীতির দেশ গড়ে ওঠা।“ বললেন মজিদ ভাট। ফট করে আতিফ সুর টেনে বলল, “আর এ কাজটা তারা প্রথমে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়েই করে। কেননা, মানুষ তো ধর্মের কাছে দুর্বল।“ লেফটেন্যান্ট মজিদ ভাট চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, “যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যেখানে ধর্ম সেখানে ধর্ম, যেখানে সংস্কৃতি সেখানে সংস্কৃতি, আর যেখানে বল প্রয়োগের প্রয়োজন সেখানে বলপ্রয়োগ। চীনাদের মতিগতি বোঝা খুবই মুশকিল। তারা রহস্যময় জাতি। আর সেজন্যেই তো কথায় বলে, চীনাদের মনেও একটা করে ‘চীনের প্রাচীর’ গাঁথা আছে। আমাদের পাকিস্তানের কিছুই করার নেই। চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতেই হবে। কারণ, ভারতকে টাইট করে রাখতে হলে, আমাদের চীনের সাহায্য প্রয়োজন। সুতরাং কোনোভাবেই আমরা চীনকে রাগাতে যাব না। সে চীন মায়ানমারে সামরিক ঘাঁটি বানাক আর না বানাক।“ কথাটা বলতে বলতে দরজার দিকে পা বাড়ালেন লেফটেন্যান্ট মজিদ ভাট। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “বেশ, আমরা এখন আসছি। তোমরা নিজেকে ভালোভাবে তৈরি করে নাও। ইবাদতে মনপ্রাণ ঢেলে দাও। জান্নাতবাসী হও। খোদাহাফেজ।“ পায়ের জুতার খটখট শব্দ চৌকাঠ পেরিয়ে গেল।
জানালার করিডর দিয়ে তখনো ভেসে আসছে পাহাড়ি পাখি লং টেইল ব্রডবিল’এর কিচিরমিচির। স্থানীয় ভাষায় যার নাম লেঞ্জা মোটাথুটি। তার সুরেলা সুর সকালের মিষ্টি রোদ মেখে ফিনফিনে হাওয়াকে মাতাল করে দিচ্ছে। সকালের হাওয়াও যেন মোহিনী বাঁশি হয়ে উঠছে। আতিফ দোতলার বাইরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চোখ ধেড়িয়ে দেখছে, জুনাইদ মোল্লা আর মজিদ ভাট কাঠের সিঁড়ি দিয়ে খটখট করে নেমে যাচ্ছেন। তাদের পায়ের পাদানির ওপর দিয়ে নেমে যাচ্ছে তার মন থেকে চিড়বিড় করে বের হওয়া ক্ষেদ। মজিদ ভাটের শেষ কথাটায় আতিফের ভেতরটা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছে, বলেন কি না জান্নাতবাসী হও, আরে জ্বলজ্যান্ত তরতাজা টগবগে তরুণকে মৃত্যুর ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে ইবাদতগিরি দেখাচ্ছেন! আমরা মানুষ না কুরবানির ছাগল গরু? সে দিকে কোনো মায়াদয়া নেই! এ কথাটা তো বলতে পারতেন, যাও, যুদ্ধ জয় করে ফিরে এসো। তা না আগেই ভেবে নিলেন, আমরা যেন ইচ্ছে করেই মরতে যাচ্ছি! যেন আমাদের কবর কাটাই আছে, শুধু লাশের খাটিয়াটা গেলেই হলো! আমাদের বাঁচার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই! আমরা যেন মালেকুল মওত’কে কাঁধে করেই বয়ে নিয়ে যাচ্ছি! সেই জান কবজের ফেরেশতা আজরাইলকে নখ বাড়িয়ে জান কবজের আগেই, আমরা যেন আমাদের নিজের জান শরীর থেকে নিংড়ে বের করে হাতে নিয়ে বলব, এই নিন, আপনাকে আর কষ্ট করে আমাদের জান কবজ করতে হবে না, আমরা নিজেরাই আমাদের জান শরীর থেকে বের করে আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি। পৃথিবীর সব দেশের সব কালের হুকুম জারি করা লোকগুলো কি এরকমই কাঠখড়ে হোন! মানুষের জানের ওপর বিন্দুমাত্র দয়ামায়া তো নেইই, রক্ত-মাংসের শরীরটার প্রতিও নেই কণামাত্র করুণা!
চলবে...
এসএন