ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২২
নেই দেশের নাগরিক
“আধখানা রাখাইন নৌকোতে নাড়া বেঁধেছে যে! সে কী কম লোক! কম নৌকো! খোলে খোলে মানুষের জট! কুকুর বেড়ালের মতো গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে! সবাইকে জায়গা দিলে, চারখানা নয়াপাড়া লাগবে। কক্সবাজার উপচে বান্দারবান টপকে চট্টগ্রাম ঢেকে যাবে! আমি তো সিকি ভাগের এককোণাও এগোতে পারিনি। লোকের মুখে ঘটনাটার কথা শুনেই পালিয়ে আসতে হলো! অন্ধকারে আন্দাজ করিনি তাই, এখান থেকে নয়াপাড়ার ঘাট অনেক দূর।“ কথাটা বলতেই বলতেই খক খক করে কেশে উঠল মতি। মুখে জল ঢুকে গেছিল। জলে বাধা পেয়ে কথা ‘খক’ করে কাশি হয়ে বেরিয়ে এলো। ইয়াসিন মাস্টার চোখের মণি ঘুরিয়ে বললেন, “সাবধানে মতিভাই, মুখ তুলে চলুন। যেকোনো সময় বিপদ হয়ে যেতে পারে!“
বিপদ কী শুধু জলে? বিপদ আগে পিছে, ওপরে, নিচে, চারদিক থেকে ছেকে ধরে আছে। কোন দিকে আর মুখ তুলে চলব? আল্লাহ বলেন কি না, তিনি নাকি মানুষের জন্যে ছাদ বানিয়েছেন, ‘আসমান’ নামের ছাদ, যখন এই আসমান জল্লাদের মতো কুঠার নিয়ে তেড়ে আসে, তখন কোন বাপ ঠেকাবে? এই আসমানে একটা মই লাগিয়ে দিলেই তো পারতেন? খপ করে ধরে খড়বড় করে আসমানে উঠে পড়তাম। তারপর জান কবজের ফেরেশতাকে বলতাম, এই নিন, আপনাদের কাছ থেকে ধার করা রুহু, যেখান থেকে ধার দিয়েছিলেন, সেখানে জমা করে নিন। যে রুহুর পায়ের মাটি নেই, মাথার ছাদ নেই, সে রুহু কখনো শরীর হতে পারে না। রুহুকে ‘হাওয়া’ করে পাঠালেই পারতেন? ফুঁ দিয়ে যেকোনো দিকে চলে যেত পারত। না হতে হতো ‘ঘরকা’ না হতে হতো ‘ঘাটকা। না লাগত ‘চালা’ না লাগত ‘চুলো’। চোখদুটো আসমানের দিকে করে খেয়ালি হয়ে উঠল মতি। মনের নদীতে জোয়ারের জল তুলল। সে জলের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল ভাবনার উপকূলে। অনুভূতির তটরেখায়। চোখ যেন আর শুধু দৃশ্য দর্শনের ইন্দ্রিয় নয়, মনের আবেগ অনাবেগের ক্যানভাস।
সবাই হাঁ করে বসে আছে! চোখ ফেড়ে দেখছে তাদের! যেন বিশ্বজয় করে ফিরে এসেছে মতিরা। অথবা তারা যেন অন্য গ্রহের মানুষ। ছইয়ের ভেতরে কাঁদনের গোঙানি শোনা গেল! মেয়ে মানুষের ফোঁপানো কণ্ঠস্বর! হ্যাজাব্যাজা হয়ে মতি আর ইয়াসিন মাস্টার নৌকোর কাছে পৌঁছল। নুহু কপালের ভাজগুলোকে ওপরে ঠেলে মতিকে বলল, “কোথায় গিয়েছিলে! কাউকে কিছু না বলে, কিছু না জানিয়ে, আচমকা দুম করে হাওয়া!”
“কেন, আবুল তো জানে?” নৌকোর খোলে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে গা মুছতে মুছতে বললেন ইয়াসিন মাস্টার।
“আবুল! ও ব্যাটা তো ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছিল! এক্ষুণি উঠল। ঘুম থেকে উঠে, সবাইকে কাঁদতে দেখে তবেই কবলাল।“ আবুলের দিকে চোখ বাঁকিয়ে বলল নুহু। ইয়াসিন মাস্টারের দিকে ভয় চোখে তাকিয়ে আবুল ধড়ফড় করে বলল, “আরে আমি তো এদের বলছি, মাস্টাররা পাড়ের খোঁজ নিতে গেছেন, এরা সে কথা বিশ্বাসই করছেন না। বলছেন, আপনারা নাকি বার্মাসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেছেন, মায়ানমার সেনারা আপনাদের গুলি করে মেরে ফেলবেন!” বৈঠা হাতে ভেটুল গাছের গুঁড়ির মতো পা’গুলো খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে আবুল। তার গোস্ত ঝুলা পা’গুলোর ফাঁক দিয়ে গলে যাচ্ছে নদী থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে উঠে আসা অন্ধকার। ছিদল দাঁতগুলো আবারও নড়ে উঠল, “আরে আমার কি দয়া মায়া নেই? আমি কি কোনদিন মাস্টারের ক্ষতি করেছি? নিজের জান দিয়ে মাস্টারকে ভালোবাসি। মাস্টাররা না থাকলে এই আবুল কি আজ দুনিয়ায় বেঁচে থাকত? রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে আপনারা মানুষ করেছিলেন বলেই তো আজ কথা বলতে পারছি। আপনারাই তো আমার বাপ-মা। রক্তের সম্পর্কের চেয়ে আপনাদের সাথে আমার সম্পর্ক কোনো অংশে কম নয়। তবুও এমন করে মাঝে মধ্যে খোটা দেবেন, যেন আমি পর, রাস্তার কুড়িয়ে আনা ছেলে।“ ফুঁপিয়ে ওঠে আবুল। গামছা দিয়ে চেপে মুখ ধরে। একটা আস্ত বেটাছেলে মোমের মতো গলে পড়ছে!
“তোমরাও হয়েছ সব এক একটা গাড়ল! ওকে কেন যে কষ্ট দাও! ওরও তো একটা মন আছে নাকি? ও তো একটা মানুষ? আর আমাকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করার কী আছে? ক্ষয়ে ক্ষয়ে আর এক পোয়া জীবন তো বাকি পড়ে আছে! সেটুকুই তো ঠোঙায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই নদীর নুনপানি খেয়ে সেই এক পোয়াও ফুরিয়ে যাবে! সেসব নিয়ে এত ভাবনার কী আছে? জীবনের ঘড়িতে দম দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন আল্লাহ, কখন যে থেমে যাবে, তা কি কেউ বলতে পারে?” বিড়বিড় করে উঠলেন ইয়াসিন মাস্টার। মাথা ছাপড়িয়ে ছইয়ের ভেতরে ঢুকলেন। একটা হলুদ আলো সিঁদুর মেখে খিলখিল করে হাসছে ছইয়ের বাতায় বাতায়। সেখান থেকে কোলের শিশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দু’পাশের খোলে। অন্ধকারের গায়ে পশমের সুতোর মতো ফিনফিন করছে হামাগুড়ি দিয়ে আসা সে আলো।
“ভাইজান আপনার কিছুতে লাগেনি তো?” অশ্রুজড়ানো কণ্ঠে ইয়াসিন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করল আবুল।
“না রে না, কিচ্ছু হয়নি, খুউব বেশি দূর তো যাইনি।“ ছইয়ের ভেতর থেকে গড়া দিয়ে আসা আলোর সাথে ভেসে এল ইয়াসিন মাস্টারের গলা। কথাটা বলেই, তিনি দু’পায়ের জাঙের মাংস লুকিয়ে টিপলেন। ব্যথায় কনকন করছে। অভ্যাস না থাকলে যা হয় আর কি। টানা সাঁতার কেটে টনটন করে টাটাচ্ছে। ইয়াসিন মাস্টার মনে মনে বলছেন, টাটাচ্ছে টাটাক, না ফুল্লেই হল। যন্ত্রণা মনের মধ্যে পুরে হজম করা যাবে, কিন্তু পা ফুল্লে তো সবাই জেনে যাবে। তখন সবাই ডাঙা খোঁজা বাদ দিয়ে ফোলা পা নিয়েই পড়ে থাকবে! তখন ধান ভানতে এসে শীবের গীত গাহানোয় হবে!
গামছাটাকে চিপে ঘাড়ে ফেলে ছইয়ের ভেতরে কোলকুঁজো হয়ে ঢুকতে ঢুকতে বিড়বিড় করছে মতি। এক হাঁড়া রাত ঠোঁট বাঁকিয়ে ঢুকে পড়েছে ছইয়ের অন্দরমহলে। অন্ধকার ছেকে আছে ছইটাকে। এবার গলা খেঁকিয়ে উঠল মতি, “আরে লম্ফ টম্ফ ধরাবে না এই অন্ধকারেই ঘাপটি মেরে বসে থাকবে?”
“কেরোসিন নেই।“ আরিফার মিহি কণ্ঠ অন্ধকারে কাঁটার মতো বিঁধল। কণ্ঠটা ভারি বেসুরো। শুকনো লংকার সাথে কাচা নুন যেন বেটে লাগানো আছে।
“তেল নেই! বলছ কী!” চোখ থেমে গেল মতির।
“হ্যাঁ, আধকুপিও নেই।“
“হাই আল্লাহ!” মতির মাথায় হাত। সে নুহুর দিকে চোখ বাজিয়ে বলল, “কী রে নুহু, আসার সময় কেরোসিনের ডামটা আনিসনি?”
“জানই আনতে পারছিলাম না তো কেরোসিনের ডাম!” চোখ পাকালো নুহু।
“এখন কী করা যাবে!” মতির জুলপি চুঁইয়ে নামছে দুশ্চিন্তা।
“কী করা আর যাবে, চুপ করে বসে আল্লাহ আল্লাহ করতে হবে!” ঠেস মারল আরিফা। আঁচলের পাড় কোমরে গুঁজল।
“রাত বিরেতের ব্যাপার! আলো টালো না থাকলে হয়?” কপাল ঠুকল মতি।
“ওদের কাছে এট্টুআট্টু চাইলে দেবে না?” মতলব বের করল নুহু।
“তা হয়। কিন্তু……।“ ঠোঁট কাটল মতি। আরিফা থড়বড় করে বলে উঠল, “কিন্তু’র আবার কী আছে? আমরা একসাথেই তো থাকছি, দেবে না ক্যানে?”
“দেখি, ওদের আবার আছে কি না।“ কথাটা ফিসফিস করে বলে, আবুলদের নৌকোর দিকে পা বাড়াল মতি। দু ধাপ এগিয়ে আবার গলা চেপে বলল, “নুহু, তুই যা না ক্যানে, একটুখানি তেল চেহে আন।“
“আমি যাব না, আমাকে দেবে না, একটা বিড়ি দিতে চায় না, সেখানে কেরোসিন তেল দিতে চাইবে? ওসব হাড়কিপ্টে লোক।“
“আস্তে কথা বল।“ চোখ ট্যারাল মতি। “কোথায় কী কথা বলতে হয় জানে না, আর ফদফদ করে বকে যায়! বিড়ি আর কেরোসিন তেল কি এক হলো!” দাঁত খিটমিট করে উঠল মতি, “কথার কোন মাথা মুণ্ডু নেই, বলতে হয় তাই বলে দেয়।“ তারপর আরিফার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “দেখি দাও, কুপিটা আমাকেই দাও, আমিই যাচ্ছি।“ ডুবে যাওয়া চাঁদের উল্টো পিঠের আধো আলো ছইয়ের চালা দিয়ে ছেকে যেটুকু ঢুকছে তাতে আরিফা বুঝতে পারল মতির রগাচগা হিলহিলে হাতটা পেতে আছে। ছায়াঘন অন্ধকারে আন্দাজে ছইয়ের কোণায় হাত চালাল আরিফা। একটা নিভে আসা আলতো গরম ভাপ ঠেকল হাতে। কুপির গা’টা এখনও গরম আছে! নেভা তো খুউব বেশিক্ষণ হয়নি? মতিদের ফেরার কিছুক্ষণ আগেই নিভল। শেষ শীখাটা নেভার ধোঁয়া এখনও মিহি করে উড়ছে। কুপিটা স্বামীর হাতে দিল আরিফা। একেবারেই পাতলা ঠনঠনে! কুপিটা কানের কাছে নিয়ে গিয়ে দু-একবার ঠনঠন করে নড়াল মতি। নাহ, তেলের বংশ নেই! একেবারে শুকিয়ে হাড় হয়ে গেছে। নারিকেলের কৌটো কেটে কুপিটা বানানো। মতি নারিকেলের কৌটোটাকে মাপ করে কেটে দিলে, আরিফা কাপড় ছেড়া ত্যানা সরু করে পাকিয়ে সলতে বানিয়েছিল। এভাবে বানানো কুপির আলো নাকি হলুদ হয়। মাটির দেওয়ালে সে আলো পড়লে, দেওয়ালগুলো মনে হয় যেন কাঁচা হলুদ বেটে লাগানো আছে।
“মাস্টারভাই, ও মাস্টারভাই।“ দুই নৌকোর জোড়াতালির ওপরে দাঁড়িয়ে মোলায়েম কণ্ঠে হাঁক দিল মতি।
“কী হলো, মতিভাই, কিছু বলছেন?” অন্দর থেকে ইয়াসিন মাস্টারের উৎকণ্ঠার সুর।
“একটু বাইরে আসবেন। দরকার ছিল।“
মতির বাপের অসুখটা কি আবার বাড়ল! লোকটার যা যাই যাই অবস্থা, তাতে কখন কী হয়ে যায়, বলা মুশকিল! ভাবতে ভাবতে মাথা ঝুঁকে বাইরে বেরোলেন ইয়াসিন মাস্টার। “কী হয়েছে, মতিভাই!”
“আপনাদের কাছে কি এক কুপি কেরোসিন তেল পাওয়া যাবে?” মতির কণ্ঠে আকুতি।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
এসএন