ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২১
নেই দেশের নাগরিক
“আমরা গো, ভয় নেই আমরাও রোহিঙ্গা।“ ধোকাতে ধোকাতে বললেন ইয়াসিন মাস্টার। তার মুখ ভয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে। মুখের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে মুখ বাড়াল লোকটা। ভাসা ভাসা চোখ বের করে দেখল, তার নৌকোর কাছে দু’জন জলজ্যান্ত মানুষ! জলে ভিজে থরথর করে কাঁপছে! লোকটা ধড়ফড় করে উঠে বসল, “আপনারা এখানে কী করছেন?” ইয়াসিন মাস্টার ফিসফিস করে বললেন, “পাড়ে মনে হয় কিছু একটা ঘটেছে। মাঝে মাঝে গুঞ্জন ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ আগে গুলির শব্দও হয়েছে। সেসব পরখ করতে......।“
ইয়াসিন মাস্টারের কথা শেষ না হতেই লোকটা ভ্রূ টান করে বলে উঠল, “গুলি!” লোকটার চোখে মুখে আতঙ্কের কালো ছায়া। “হ্যাঁ, গুলি, আসল ব্যাপারটা কী সেটা পরখ করতেই সামনের দিকে যাচ্ছি।“ বলল মতি। মতি এবার কেখলে মাছের মতো থুতনি তুলে বলল, “মাস্টার, আপনি এই ডিঙ্গিতেই উঠে বসুন। একটু জিরোন। আমি সামনে গিয়ে দেখে আসছি।“
ইয়াসিন মাস্টার এবার আর ‘না’ বলতে পারলেন না। তিনি এলে ভূতি হয়ে গেছেন। “ঠিক আছে, যান, তবে বেশি দূর যাবেন না। যেখান থেকে খবরটা পাবেন সেখান থেকেই চট করে ঘুরে আসবেন।“ কথাগুলো বলেই ডিঙিটার কিনারায় বুক ঠেকিয়ে পা দিয়ে ঠেলা মেরে ডিঙিটার ওপরে উঠে বসলেন ইয়াসিন মাস্টার। মতি আলো-আঁধারিতে বুক সাঁতার দিয়ে সামনে এগোতে থাকল। ঢেরখানি দূরে চলে এল মতি। এদিকটায় প্রায় সকলেই জেগে আছে। গুঞ্জনটা এবার হল্লা হয়ে কানে লাগছে। একটা বড় আকৃতির কৌশা নৌকোর কাছে এসে সে থামল মতি। এখান থেকে চিৎকার চেঁচামেচিটা স্পষ্ট ভেসে আসছে। তাদের কথা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও, কথার সুর শুনে মনে হচ্ছে, বিজিবি-র সঙ্গেই ক্যাচালটা বেঁধেছে। বিজিবি-র সেনাকর্তাদের কথাও হাওয়াতে ঘোট পেকে জট পেকে ভেসে আসছে। মতি আর সামনে না গিয়ে, কৌশা নৌকোটার লোকজনকে জিজ্ঞেস করল, “পাড়ে কী হয়েছে গো ভাই? এত চ্যাঁচামেচি কেন?”
“আপনি আবার কোত্থেকে ভেসে এলেন!” একজন ভদকা গলার লোক ভ্রূ কুচকাল। সে নৌকোর ধারিতে হনুমানের লেজের মতো পা ঝুলিয়ে বসেছিল। মতিকে দেখে থড়বড় করে পা গুটিয়ে নিল।
“পেছন থেকে আসছি গ। পাড়ে কী হয়েছে তার খোঁজ নিতে।“ ধুকাচ্ছে মতি।
“আরে আপনি তো এলে ভূতি হয়ে গেছেন! থামেন, থামেন, এ জন্যে আর আপনাকে কষ্ট করে সামনে যেতে হবে না। কী হয়েছে, আমিই আপনাকে বলে দিচ্ছি।“
লম্বা হিলহিলে একটা লোক ফদফদ করে উঠল। লোকটাকে নিচে মুখ বাড়িয়ে কথা বলতে দেখে, নৌকোর অন্যান্য যাত্রিরা উৎসুক চোখ নিয়ে বাদুড়ের মতো মুখ বাড়িয়ে মতিকে জরিপ করতে লাগল। লোকটি ফিসফিস করে বলল, “সামনের দিকের একটা দল লুকিয়ে ছাপিয়ে নয়াপাড়া ক্যাম্পে ঢোকার চেষ্টা করছিল। বিজিবির সেনারা সেটা দেখে ফেলে। তারা তাদের নৌকোয় ফিরে যেতে বলে। রোহিঙ্গা দলটার সদস্যরা সে কথা শুনতে রাজি হয় না। তারা জোর করে ভেতরে ঢুকতে যায়। তখন বিজিবি গুলি চালায়। এখনো যা শুনতে পাচ্ছি, তাতে দশজন নাকি গুলি খেয়ে মারা গেছে! বাকিরা ওখানে বসে আন্দোলন করছে। কিন্তু বিজিবি সাফ বলে দিয়েছে, ওরা একজনকেও নয়াপাড়াতে ঢুকতে দেবে না।“ “বলছেন কী!” চোখ থির হয়ে আসে মতির। অসহায়ের মতো বলে, “কখনই ঢুকতে দেবে না!”
“নাহ, আমরা ভোর হলেই অন্য কোথাও চলে যাব। আপনারাও এখান থেকে পালিয়ে যান। বিজিবিকে বিশ্বাস নেই, কখন ধ্যাড়াধ্যাড় গুলি চালিয়ে দেবে।“
লোকটি কঠিন সত্যটা বলল। কপালের ভাঁজ চওড়া হলো মতির। আবারও অন্য কোথাও! মাথায় হাতুড়ির বাড়ি পড়ে তার। আর কোথায় বা যাব! ডাঙ্গাগুলো সবই তো একে একে শিল করে দিচ্ছে! কড়া নজরদারি। একটুও ফাঁকফোকর নেই! যাকে বলে সীমান্ত টাইট। কিন্তু জানে বাঁচতে হলে তো কোনো না কোনো ডাঙায় উঠতেই হবে। মতি আর কথা বাড়ায় না। এখান থেকেই চট করে ঘুরে তাদের নৌকোর উদ্দেশে রওনা দেয়। ধোকানো শরীর এবার জলের ওপর আকাশের দিকে মুখ করে অর্ধনিমজ্জিত হয়ে চিৎ সাঁতার কাটতে শুরু করে। তার মুখের ওপর এসে পড়ে ডুবন্ত চাঁদের শেষ আলো। চাঁদটা একটু একটু করে ক্ষয়ে আসমানে বিলিন হয়ে যাচ্ছে! মতি হাঁ করে জ্যোৎস্না খায়। আসমান থেকে নেমে আসা নক্ষত্রদের আলো চিবোয়। সেসব আলোতে তার ধকল মেশা মুখটা হলুদ হয়ে ওঠে। নুনজল মেশা মুখটার কাঁচাসোনা কাঁচাসোনা ভাব।
মতি রাতের আকাশে ফুটন্ত তারা দেখে মনে মনে বলল, হে আল্লাহ, আর পারছি নে, আমাদের এবার আকাশের তারা করে নাও। জল-হাওয়া-মাটি ঘাঁটা অনেক হলো। মানবজন্মের মিঠে স্বাদ আর পেলাম কই? তেতো স্বাদ চাখতে চাখতেই তো এ জীবনের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল! এবার সুতো গুটিয়ে নাও। ইহকালের ঠেলা আর নিতে পারছি নে। জ্যোৎস্না নিভু নিভু। চাঁদ একটু একটু করে মেঘের আড়ালে মিশে যাচ্ছে। এবার হুড়মুড় করে নেমে আসবে অন্ধকার। মতি জলের মধ্যেই তার মড়ার মতো ভাসমান শরীরটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে জোরে জোরে প্রজাপতি-সাঁতার কাটতে লাগল। চিথোল মাছের মতো ভুষ ভুষ করে এগোতে থাকল। শরীরে বল নেই, তবু কোথা থেকে একটা বলদের বল ঠেলা দিয়ে উঠছে। ষাঁড়ের সিং ঢিপানোর মতো জলের তোড়কে ঢিপিয়ে যাচ্ছে। যে নৌকোগুলোর পাশ ছুঁয়ে সে এগোচ্ছে, সেগুলো এবার আগুনের ভাপে জমানো গুড়ের ভিড়ের মতো টলমল করে নড়ে উঠছে! তবে কি সবাই এখান থেকে পালানোর ফন্দি আটছে? ঘুরিয়ে নিচ্ছে নৌকোর মুখ? আমাদের নৌকো তো সব পেছনে আছে! যাকে বলে একেবারে ছায়গাদায়! নৌকোগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেলে, আমাদের নৌকোটাকে এই অন্ধকারে খুঁজে পাব তো! খাটুনির ঘামের সঙ্গে দুশ্চিন্তার ঘাম মেশে মতির গায়ে। আসমান দেখা কপাল আরও চিকচিক করে ওঠে। সেসব বিন্দু বিন্দু ঘামের ওপর ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলো পড়ে বিন্দুগুলোকে রূপোর মতো লাগছে। আচমকা একটা উড়ন্ত কালো ছায়া স্যাৎ করে তার মুখের ওপর দিয়ে চলে গেল! মনে হয় সামুদ্রিক বাদুড় টাদুড় হবে।
মতি ভাবল, এই তো আজরাইল ফেরেশতা ঘোরাফেরা শুরু করে দিয়েছে! ছোঁ মারল বলে! নাহ, নৌকোটা সেভাবে দূরে সরে যায়নি! পুব দিকে তিন-চার শিতেন মতো একটু হেলে গেছে, এই যা। প্রথমে তো ভয়ই পেয়ে গেলেন ইয়াসিন মাস্টার, মতি যেভাবে মড়ার মতো ভেসে এল! ডান হাত হালের মতো করে, বা’হাত দাঁড় বানিয়ে জল ঠেলে, মতি নৌকোটার খোল ধরল।
“আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম!” শুকনো গলায় বললেন ইয়াসিন মাস্টার। “ভয়! কে ?” প্রশ্ন করল মতি। “না, অত দূর তো! তাও আবার এই রাতের বেলা সাঁতার কেটে যাওয়া!” ডান’হাত বাড়িয়ে দিলেন ইয়াসিন মাস্টার।
“না, এখন আর ওপরে ওঠার সময় নেই।“ তাড়া দেখাল মতি।
“সময় নেই! মানে খারাপ কিছু ঘটেছে?” ডিঙি নৌকোর লোকটা চোখ বড় করল।
“হু।“ ঘাড় নড়াল মতি।
“কী ঘটেছে মতিভাই?” এবার ইয়াসিন মাস্টারের উৎসুক চোখ।
“গুলি।“
“গুলি!” ডিঙি লোকটার হুমড়ি খেয়ে পড়ার দশা।
“কেউ হতাহত হয়েছে?” চোখ থির ইয়াসিন মাস্টারের।
“খুন।“
“খুন! মানে মার্ডার! উরি বাপ রে!” গলা কেঁপে উঠল লোকটার। পারলে শূন্যে লাফ দিয়ে আসমানে উঠে পড়ে।
“দশজন মারা গেছে।“ পরিসংখ্যান জানাল মতি।
“দশজন!” কোটর থেকে মণি বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো ইয়াসিন মাস্টারের। একটা শুকনো ঢোক গিলে চাপা গলায় বললেন, “কী করে মারা গেছে বলে শুনলেন? বিজিবি পাড় থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়েছে, না ধরে নিয়ে গিয়ে ‘ফায়ারিং স্কোয়াডে’ দাঁড় করে রেখে গুলি করেছে?” ঘটনার ভেতরে ঢোকার জন্য দরজায় টোকা দিলেন ইয়াসিন মাস্টার। মতি, ডিঙিনৌকোটার মটকা ধরে ঘুঁত ঘুঁত করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “রোহিঙ্গাদের একটা দল বিজিবির চোখে ধুলো দিয়ে সীমান্ত টপকানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তারা বিজিবির নজরে পড়ে যায় এবং বিজিবি নিষেধ করা সত্ত্বেও তাদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে, বিজিবি গুলি চালাতে বাধ্য হয়। গুলিতে দশজনের স্পটেই মৃত্যু হয়েছে। এখন ওখানে চরম ঝামেলা চলছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা আন্দোলনে সামিল হয়েছে।“
আন্দোলন! বিক্ষোভ! বিজিবির বিরুদ্ধে হাতনাড়া! স্লোগান! নির্ঘাত সব কটা বেটা মরবে। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে এল বলে! গোখরোর ফণার সামনে কেউ ফোঁস করে? যেকোন দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী মানেই তো এক একটা গোখরো সাপ। মাথার ঘেলু গুঁড়ের কড়াপাকের মতো পাকিয়ে উঠতে লাগল ইয়াসিন মাস্টারের। ক্যাকটাসের পাতা যেমন গুটিয়ে কাঁটা হয়ে যায়, ইয়াসিন মাস্টারের মাথার ঘেলুগুলোও গুটিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ছুন্নি হয়ে যাচ্ছে! মতি নৌকোর কানা ছেড়ে ছলাৎ করে জল খামচে ধরে বলল, “আর দেরি করা ঠিক হবে না, মাস্টার। তাড়াতাড়ি চলুন। আমাদেরও এখান থেকে কেটে পড়তে হবে। ওদিক থেকে নৌকোগুলো সব ঘুরিয়ে আনছে!”
“চলুন মানে, এক্ষুণি চলুন।“ বলেই ঝপাং করে জলে ঝাঁপ মারলেন ইয়াসিন মাস্টার।
শুধু তার রক্ত-মাংসের দেহটাই লাফ দিয়ে জলে পড়ল না, রক্ত-মাংসের দেহের সঙ্গে লাফ দিল তার শরীর খুঁটে খুঁটে ঢুকে পড়া মৃত্যুভয়। দুশ্চিন্তার জমাট মেঘ। ডাঙা খোঁজার তাড়না। দুজনেই বুক-সাঁতার দিয়ে এগোতে থাকলেন। একজনের হাত আরেকজনের হাতে মাঝেমধ্যেই ঠক্কর লেগে যাচ্ছে। একজনের হাতে ঠেলা জল আরেকজনের ঠেলা জলে লেগে ফোঁস করে উঠছে। নদীর থির বুকে মিহি করে উঠছে চিকন ঢেউ। সে ঢেউ’এর তিন আঙুল চার আঙুল আনত ঢালে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলো তেরছা করে পড়ে ঝলমল করে উঠছে। মতি গায়ে জোর লাগালে, ইয়াসিন মাস্টারও গতরে বল ঠেলছেন। যেন দুটো বোয়াল মাছ পাল্লা দিয়ে চলেছে! পিছনে মৃত্যুভয় তাড়া করলে মনে হয় যেকোনো জীব এভাবেই পড়িমরি করে ছুটে। এভাবেই তাড়া খায়। আসলে জন্মের পর পর থেকেই তো মৃত্যু জীবনকে তাড়া করে বেড়ায়। মানুষ সেসব বুঝেও বোঝে না। শুধু পালাতে চায়। লুকোতে চায়। হাঁতড়ে খামচে পড়িমরি করে ছুটছে দুজনে। যেন তারা মনে করছে নাফ নদীটা কয়েক খামচা জলাপুকুর। দু-চারবার খামচেই পেরিয়ে যাব! নৌকো যেন ফুরোতেই চায়ছে না! ইয়াসিন মাস্টার বিড়বিড় করেন, “কত ভেতরে গেছিলাম গো! রাস্তা ফুরোচ্ছেই না!”
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
এসএন