ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১৪
নেই দেশের নাগরিক
“কোথায় আজান হচ্ছে বাপ? আমাদের দংখালীর মসজিদের আজান এখানে ভেসে আসছে!” কান খাড়া করলেন হালেমা।
“না না, কোথায় দংখালী আর আমরা কোথায় আছি! এটা বাংলাদেশের নয়াপাড়া থেকে ভেসে আসছে।“ চোখ বাঁকালো মতি। তারপর হাতে পিতলের ঘটিটা নিয়ে, নৌকার কানা থেকে নদীতে পা ঝুলিয়ে বসে বলল, “ওজু করে নাও। আমি নদীর পানি তুলে দিচ্ছি।“ বলেই ‘ছলাৎ’ করে ঘটিটা জলে চুবড়িয়ে নিল। স্বচ্ছ জল। লবণ মিশে মোটা হয়ে গেছে। জলের ঘটিটা ছইয়ের কাছে হাত বাড়িয়ে আরিফাকে দিয়ে বলল, “মা’কে দাও, ওজু করবে।“ মতি নিজে কোমর কুঁজো করে হাত দিয়ে সরাসরি নদী থেকে জল তুলল। সে জল খরচ করে ওজু করতে লাগল। মতি পাকা মুসল্লি। আগে ওত পরহেজগার ছিল না। বছর পাঁচেক আগে জামাতের পাল্লায় পড়ে সেই যে নামাজ ধরল, ধরল তো ধরল, আর এক ওয়াক্তও কাজা করেনি। মতি, মুখে ওজুর জল দিয়ে বলল, “নুহু, তুই শক্ত করে হাল ধরে থাক। জোয়ার আসতে পারে। আমি নামাজটা পড়ে নিই।“ মতির খেয়াল আছে শেষ জোয়ার আসা বারো ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। গতকাল বিকেলে মুখ্য জোয়ার এসেছিল। সুতরাং একটা হাল্কা পাতলা গৌণ জোয়ার যেকোনো সময় ধেয়ে আসতে পারে! তারপরে নৌকাটা অনেকটাই মোহনার দিকে চলে এসেছে। ফলে জোয়ারের একটা প্রবল ধাক্কা খাওয়ার ঘোর সম্ভাবনা। এরকম জোয়ারে নৌকা অনেকসময় পাল্টিও খায়। ঢেউ এর ঝুঁটি ধরে আঁকড়ে থাকতে হয়। এখন নদী একেবারে ডোবা পুকুরের মতো থির। চোখে এখনও ঘুম জড়ানো। কোনো হেলদোল নেই। যেন জোয়ারের জোর ধাক্কা খাওয়ার জন্যে, চোখ বন্ধ করে অজানা সংকেতের প্রহর গুণছে! খোলা নৌকার পাটাতনের ওপরে কেবলামুখী করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল মতি। কেবলামুখী অর্থাৎ মক্কার কাবাশরীফের দিকে মুখ। ধিক ধিক করে চলছে নৌকাটা। যেন ক্লান্ত। শ্রান্ত। শরীর আর নিচ্ছে না। পূবালী বাতাসটা ঝিরঝির করে বয়ছে। আকাশের নীল তটরেখা দিয়ে উড়ে গেল এক ঝাঁক হরিয়াল। পাখিগুলোর গায়ে জড়িয়ে আছে ভোরের মিহি আলো।
নুহু আসমানের দিকে চোখ তুলে দেখল, পাখিগুলো নয়াপাড়া থেকে উড়ে যাচ্ছে আকিয়াবের দিকে। পাখিগুলোকে এভাবে শূন্যে ডানা মেলে আপন খেয়ালে উড়ে যেতে দেখে, নুহুর মনপাখিটাও পাখা ঝাপ্টালো। মনের পালকে লাগল উড়ুক্ক হাওয়ার দোলা। নুহু ভাবল, আহাঃ যদি পাখি হতাম, যেদিকে ইচ্ছে উড়ে যেতাম! কেউ কখনও মানা করত না। সব দেশই আমার দেশ হয়ে যেত। কোনো সংবিধানই আমাকে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখতে পারত না। আমি সকালে এক দেশে খেলে বিকেলে অন্য দেশে খেলতে যেতাম। আমার পালকে লেগে থাকত নানান দেশের জল-মাটি। আমি গান গাইতে গাইতে পেরিয়ে যেতাম নাফ নদী। কক্সবাজারের শিমুল গাছ থেকে শুয়োপোকা ধরে এনে দংখালীর তেঁতুল গাছে বাঁধা বাসায় কিচিরমিচির করতে থাকা শাবকছানাকে খাইয়ে দিতাম। তারপর সবাই মিলে ডানা মেলে ঘুরতে যেতাম অন্য কোনো দেশ।
মতি প্রথম রাকাতের সিজদা দিয়ে আবার খাড়া হয়ে দাঁড়াল। মিনমিন করে সুরা ‘ফাতেহা’ আউড়াচ্ছেন। মাথার ফেজ টুপিটা চুলের সাথে এঁটে আছে। চাপ দাড়িটা মুখটাকে আরও পরহেজগার ইনসান বানিয়ে দিচ্ছে। হালেমা ছইয়ের ভেতর শীতলপাটির জায়নামাজ বিছিয়ে বসে বসে নামাজ আদায় করছেন। কোমরে ব্যাথা। উঠতে গেলেই ‘কট’ করে ওঠে। মাজায়, হাঁটুতে, বাত। রাতদিন কনকন করে। খাড়া হয়ে নামাজ পড়তে পারেন না।
এসব দেখে, জাফর আলি বলেন, তোমারও সময় হয়ে এসেছে হালেমা, হাড়ের নাটবোল্ট ঢিলা হতে লেগেছে, দেখবে, হুট করে একদিন আজরাইল এসে ঠং করে বাড়ি দিয়ে জানটা নিয়ে চলে যাবে! আরিফা সাকিবের কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখল, গা’টা গরম আছে কি না। নাহ, জ্বরটা ঢেরটুকু কমেছে। গতরাতে তো হাত ঠেকানোই যাচ্ছিল না, একেবারে ছ্যাঁক করে উঠছিল। গা’টা অত গরম না থাকলেও, আরিফা আরও একবার জলপট্টি দিল। ঘুমে মুদে থাকা চোখ আলতো করে খুলল সাকিব। মৃদু নড়ে উঠল ঠোঁট, “মা”। আরিফা ছেলের মাথাটাকে বুকের মধ্যে পুরে নিয়ে বলল, “কোন ভয় নেই বাপ, কোন ভয় নেই, এই তো জ্বর কমে গেছে, সকাল হলেই একেবারে ভালো হয়ে যাবি।“ সাকিব তার জ্বরমুখো মাথাটা মায়ের কোলে রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে, “মা, আমি বাড়ি যাব। তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো।“
‘বাড়ি!’ কথাটা শুনে প্রথমে খেয়ালি হয়ে ওঠে আরিফা। তারপর ভাবে, সে কী আর এজন্মে ফেরা হবে রে বাপ? আদৌ কী আর কোনো বাড়ি কপালে জুটবে? আল্লাহ কী আর আমাদের কপালে কোনো ঠিকানা লিখে রেখেছেন? সাকিব আঁচল মুখে গুঁজে রীতিমত বায়না ধরে, “মা, আমি বাড়ি যাব, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো, এই নৌকা আমার আর ভাল্লাগছে না।“
“যাব বাপ, সকাল হলেই যাব। তুই আর একটু ঘুমিয়ে নে। জ্বরে সারারাত ভালো করে ঘুম হয়নি।“
“তুমিও তো সারারাত ঘুমোওনি মা, তুমিও ঘুমিয়ে নাও।“
হ্যাঁ, ঘুমোব, একটু সবুর কর, আমি একা কেন, আমরা সবাই ঘুমোব। এমন ঘুম ঘুমোব, এজন্মে আর চেতন পাব না। যাকে বলে, শেষ ঘুম। বার্মা সেনারা এসে আমাদের ঠিক সে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যাবে। আনমনা হয়ে উঠল আরিফা।
“মা, কী হলো? তুমি ঘুমোও। তুমি না ঘুমোলে আমিও ঘুমোব না।“ জেদ ধরে ন-বছরের সাকিব। ছেলের আবদারে ঘোর ভাঙল আরিফার, “অমন করতে হয় না, বাপ, বড়দের কথা শুনতে হয়, আমার এখন ঘুমোলে হয়? কত্ত কাজ পড়ে রয়েছে।“
“নৌকাতে আবার তোমার কী কাজ মা, এটা কী বাড়ি যে ঘুম থেকে উঠে উঠেই তোমাকে হুটপাট করে কাজে লেগে পড়তে হবে?” পাক্কা বুড়োর মতো কথা বলল সাকিব। তাই তো? এটা তো নৌকা! আমাদের দংখালীর আটপৌরে বাড়িটা তো নয়? মাথা ঠক করল আরিফার। আসলে অভ্যাসের বসে কথাগুলো মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে আরিফার। দংখালীর বাড়িতে ফজরের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিছানা থেকে উঠে পড়তে হয়। ওঠার সময় কানে আসে মোরগের ‘ক-ক ক-ক’ ডাক। সূর্য ওঠার আগেই ঘর-দোর, উঠোন-বারান্দা ঝাড়পুছ দেয়। বাড়ির সম্মুখের রাস্তাটাও ঝাড় দিয়ে সাফসুতরো করে। ধুলোর ওপর লেগে থাকে ঝাঁটার খিলের সরু সরু দাগ। খিলেনের আঁকিবুঁকি। তাতে রোদ এসে কিতকিত খেলে। মুরগির খাঁচার টিনের মুখটা খুলে দিতেই পকপক করে বেরিয়ে আসে মুরগির পাল। তারপর মতি গোয়াল ঘর থেকে গাই গরুটাকে টেনে বের করে এনে নানেরপাড়ের খুঁটিতে বেঁধে দিলে, আরিফা মুত-গোবর পরিষ্কার করে। গোবরগুলো ছেনে ছেনে পেছনের দেওয়ালে ঘুঁটো দেয়। পাটকাঠির ওপরে দলা দলা গোবর চেপে বানায় লুদা। তারপর হাতমুখ ধুয়ে এঁটো বাসনপত্তর নিয়ে বসে পড়ে কলপাড়ে। মতি পান্তা ভাত খেয়ে ঘাড়ে গামছা নিয়ে বেরিয়ে যায় মাঠে। আরিফা নুন-মরিচ, আনাচপাতি, হাঁড়িকুঁড়ি নিয়ে পিঁড়ি নিয়ে বসে আখারপাড়ে। পাঠকাঠির জ্বালান ঠেসে পুরে দিয়ে ধরিয়ে দেয় আগুন। মাথায় খিজিবিজি লেগে যায়, কত্ত কাজ! সাকিব ঘুম থেকে উঠলে, হাগা-মুতা করিয়ে দিতে হয়, শাশুড়িটার পায়ে বাতের ওষুধ ডলে দিতে হয়, শ্বশুরটাকে খাইয়ে দিতে হয় চার রকমের ওষুধ। তারপর তিন বিহেনের ধাড়ি ছাগলটা ‘ভ্যা’ করে উঠলেই, আঁচল গুছিয়ে দৌড়াতে হয়। কুরবানির খাসিটাও সারাদিন খুইখুই করে বেড়ায়। কাজ যেন ফুরোতেই চায় না, আঁঠার মতো আঁচলে লেগে থাকে।
“পাকা পাকা কথা শিখেছিস? ঘুমোও, সূর্য উঠলেই বাড়ি চলে যাব।“ মাথার চুলে আদরের ছোঁয়া লাগাল আরিফা। চুলে বিলি কাটল। আঁচল দিয়ে হাওয়া করতে করতে বলল, “ঠিক আছে, আমার কোলেই ঘুমোও। বিছানায় আর ঘুমোতে হবে না।“ ছইয়ের বাঁকানো দেওয়ালে পিঠ রেখে, পাদুটো ছড়িয়ে বসল আরিফা। ধকলের ক্লান্তি চুলের সিঁথি দিয়ে হেঁটে আসতে লাগল সারা শরীরে। সাকিবের মাথাটাকে কোলের উপর শুইয়ে দিয়ে, আঁচলের হাওয়া দিতে লাগল। ঘুম চাদরের মতো বিছিয়ে গেল সাকিবের শরীরে। তার চোখ বুঁজে এলে, আরিফা মনে মনে বলে উঠল, হ্যাঁ, সূর্য উঠলেই বাড়ি ফিরে যাব। হ্যাঁ, সূর্য, নতুন সূর্য। আতিফ একদিন বলেছিল, দেখো, ভাবি, একদিন আমরা স্বাধীন দেশ পাব, আমাদের দেশ, আমাদের নিজস্ব দেশ, সেখানে অন্য কোন দেশ নাক গলাতে পারবে না। যে দেশে থেকে কখনই মনে হবে না, আমরা পর, আমরা ভিনদেশি। সে দেশে উঠবে নতুন সূর্য। স্বাধীনতার সূর্য। আমরা সেদিন সারাদিন ধরে নাচব, গাইব আর আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠব। গায়ে মাখব স্বাধীনতার রঙ। মনে লাগাব স্বাধীন দেশের আবির। তোমরা পরবে নতুন শাড়ি। পায়ে আলতা, হাতে মেহদি। খোঁপায় রজনীগন্ধা গুঁজে গায়বে স্বাধীনতার গান। মায়েরা পড়বেন কোরআন। আব্বারা দাঁড়াবেন নামাজের কাতারে। রাস্তায় রাস্তায় বেরোবে শোভাযাত্রা। ছাদে ছাদে পতপত করে উড়বে স্বাধীনতার পতাকা। ভাবি, তুমি দেখো, আমরা সেই নতুন সূর্য একদিন না একদিন আনবোই, ইনশাল্লাহ। তুমি দোয়া করো।
চোখ ছলছল করে ওঠে আরিফার। মাথাটাকে ছইয়ের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দেয়। চোখ চুইয়ে গালে নামে অশ্রু। পানপাতার মতো মুখের তামাটে গালদুটো নদীর ভাঙা পাড় হয়ে ওঠে। চোখের জলের তোড়ে একটু একটু করে ধসে পড়ে সৌন্দর্যের লাবন্য। মুখ বড় অভাগী হয়ে ওঠে। দুঃখ আর যন্ত্রণা ঠাসাঠাসি করে লেগে থাকে এ গালে ও গালে।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
এসএন