ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৪
নেই দেশের নাগরিক
হালেমা ভুল কিছু বলছেন না। নিটোল কোমরের এই তন্বী নদীটা আজ যেন সত্যিই একটা কবর। এই দুনিয়ার সব থেকে বড় গণকবর। জলের কবর। হদ্দিন শত শত মানুষকে হত্যা করে এই নদীর বুকেই ছুড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আর কুলকুল করে বয়ে চলা নদীটা বোবা হয়ে সেসব হাঁ করে গিলে নিচ্ছে। তার সহ্য না হলেও তাকে জোর করে সহ্য করতে হচ্ছে। তাকে চোখ বুজে মুক ও বধির হয়ে এই রাহাজানি হজম করতে হচ্ছে।
যন্ত্রণায় তার ভেতরটা ছটফট করলেও কিছুই করার নেই। সে যেন অপয়া। অভাগী। তার দুই তীরে মানুষের যে বসতি গড়ে উঠেছিল, সে বসতি আজ ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। এপারে আগুনের ভস্ম ওপারে ত্রিপল-ছাউনির পৃথিবী। দিনরাত দুই পার থেকে ভেসে আসা মানুষের মরণ আর্তনাদ শুনে শুনে সে পাষাণ হয়ে উঠছে। এপারে জাহলিয়াত বার্মিজ সেনাদের রোহিঙ্গা কোতল করার আস্ফালন আর ওপারে শরণার্থীশিবিরের ‘নেইদেশ’ মানুষদের না খেতে পাওয়ার বুক ফাটা কান্না। বাপটার মুখে কথা ফুটতে দেখে, নুহুর জানটা একটুখানি বল পেল। সে মনে মনে ভাবল, যাক এ যাত্রা মনে হয় বাপটা বেঁচে গেল। সবই আল্লাহর রহম। এবার জলদি জলদি দাড় টানি। কুতুপালং মনে হয় আর বেশি দূর নেই। নুহু আরিফাভাবির কোল থেকে মাথা তুলে হঠাৎ চনমনে হয়ে উঠল। লতিফা রফিক যেন তার মন থেকে আচানক নদীর জলে নেমে গেল। হনহন করে এগিয়ে গিয়ে বৈঠাটার হাতল খামচে ধরে মতিকে বলে উঠল, ‘বড়ভাই, তুমি হক্ত করে হালটা ধরে থেকো, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আব্বা এ যাত্রা মরণের কাছ থেকে ফিরে এসেছে। ভোরের মধ্যেই হেকিমপাড়া বর্ডার পৌঁছাতে হবেই। কুতুপালং বড্ড দূর হয়ে যাবে।’
‘আল্লাহ মনে হয় আরেকবার সুযোগ দিল রে।’ দু-হাত উপরে তুলল মতি। মনে মনে আল্লাহকে ‘শুক্রিয়া’ দিল। চোখে মুখে ঠিকরে পড়ল খুশির অশ্রু।
‘সুযোগ না ছাই, ওই আল্লাহর উপর আমার কোনো ভরসা নাই। যে আল্লাহ এতবড় নিষ্ঠুর কাফের লোকেদের উপর গজব দিতে পারে না, সে আল্লাহ মানুষের কী কাজে লাগে? মানুষের জন্যেই তো আল্লাহ নাকি? মানুষ যদি বেঁচে নাইই থাকবে তো আল্লাহর ইবাদত কে করবে? পাথর ছাই করবে?’ বিড়বিড় করে ওঠেন হালেমা । ছইয়ে হেলান দিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন। মাথার ঘোমটাটা চোখের ভ্রূ ছুঁয়ে চোখের পাতায় টোকা মারছে। কয়েকটা ধবধবে পাকা সাদা চুল ঘোমটার ভেতর দিয়ে চোখে এসে পড়ছে। সে চুলে নদীর পুবালি হাওয়া লেগে ফিনফিন করে নড়ছে। এই মুখে একসময় চাঁদের আলো পড়লে মুখটা রূপোর মতো জ্বলজ্বল করত। যেন মনে হত, একমুখ রূপো ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। আর আজ দুশ্চিন্তা ঠেঁটেবেঁটে লাগানো। কেমন যেন পাংশু কেলঠে হয়ে উঠেছে। দাঁড়টা ধরে যেই হ্যাঁচকা টান দিয়েছে নুহু অমনি আরিফা চিৎকার করে উঠল! ‘কী হল?’ চোখ গরম করে তাকাল মতি। আরিফা তার ঢ্যালা চোখ ঢেঁড়িয়ে বলল, ‘লাল আলো!’
‘লাল আলো! কোথায়?’ ভ্রূ টান করল মতি।
‘কোন দিকে?’ খাড়া হয়ে দাঁড়াল নুহু। এদিক ওদিক ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে সন্ধিগ্ন দৃষ্টি ফেলল। চোখজোড়া গামলা হয়ে উঠছে দুজনেরই। আরিফার আর কথা বের হচ্ছে না। সমস্ত কথা যেন ভয়ে গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। তার গা হাত পা মানকচুর গাছের মতো হলহল করে হালছে। সে আলগোছে তার ডান হাত শূন্যে তুলে নৌকোর ছইয়ের গা দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব কোণটায় ইশারা করল। মতি এবং নুহু দুইভাইএর চোখের মনিদুটো টিপ্পির মতো চৌপর ঘুরে আরিফার দেখানো কোণটায় এসে থির হয়ে গেল। যেন কে বা কারা কোটরের মধ্যে পেরেক দিয়ে মণিদুটো পুঁতে দিল। নুহু শুকনো গলায় একটা শুকনো ঢোক গিলে ফিসফিস করল, ‘তাই তো!’ মতির গলা কেঁপে উঠল, ‘হাই আল্লাহ, এবার উপায়!’ তারা দেখল, আলোটা পিটিস পিটিস করতে করতে এদিকেই আসছে! আলোর তীব্রতা দেখে তারা আন্দাজ করল, চার-পাঁচ মাইল দূরে হবে। নুহু বলল, ‘শালোরা, পানিতেও ওত পেতে আছে!’
‘পানি কি ওদের বাপের?’ রাগে চিড়বিড় করে উঠল মতি।
‘গোটা দুনিয়াটা ওদের বাপের রে খোকা। কতি গিয়ে আর বাঁচবি? যেখানেই যাবি, ওই জল্লাদরা ঠিক ফণা তুলে আছে।’ হালেমা বিড়বিড় করে অভিশাপ দিতে লাগলেন। আঁচলে গিঁট দিচ্ছিল আরিফা। সে বিরক্ত প্রকাশ করল শাশুরির উপর, ‘মা, ছেলেদের কথার মধ্যে কথা ঢুকায়ও না তো?’
‘নুহু, তুই নৌকা ঘোরা। আরও দক্ষিণে টান। দরকার হলে থাংখালীর দিকে টান মার। উজানের দিকে যাওয়া আর ঠিক হবে না।’ মতি কিছু একটা ঠাহর করে কথাটা বলল। সে হালের বাঁধনটায় আরও একটা ফাঁস দিয়ে জাব্দা করে ধরল। বিপদ এবার স্থল থেকে জলে নেমে এসেছে। যেন পিছু ছাড়ছে না। এ কি কপাল চওড়া নাক বসা বার্মিজ সেনা, না বার্মিজ সেনার রূপের ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে আসলে জান কবজের ফেরেশতা আজরাইল? ভাগ্যিস আজ আকাশে চাঁদ নেই। অন্ধকার ঢলে আছে নদীর বুকে। জ্যোৎস্না থাকলে আজ তাদের রেহাত হত না। চাঁদের আলোয় চিকচিক করত নদীর উপরে ভেসে থাকা তাদের এই মাঝারি ‘ঘাটবাড়ি কৌশা’ নৌকাটা। নৌকোর ছইয়ে মাখানো আলকাতরা চাঁদের আলোয় ঝিলিক মারত। ফলে খুব সহজেই বার্মিজ সেনাদের চোখে পড়ে যেত তারা। বাঁচার আর কোনো পথই থাকত না। এই নাফ নদীর বুকেই হয়ে যেত তাদের ইহকালের ইন্তেকাল।
লাল আলোটা যেন বারুদের গোলার মতো ধেয়ে আসছে। নুহু জোরে হাত চালাল। মতিও ভাইকে যোগ্য সঙ্গ দিল। নৌকোটা ঢেউ ওঠা নীল জল কেটে সন সন করে এগোতে থাকল। নুহু বলল, ‘নদীতে পানি মনে হয় বাড়ছে গো’
‘হ্যাঁ, জোয়ার ঢুকছে।’ বলল মতি।
‘ভালোই হল। স্রোতে নৌকোর গা লাগাই। আমরা তো স্রোতের অনুকূলেই যাচ্ছি?’
‘ওরাও তো স্রোতের অনুকূলেই আসছে। বরং ওরা তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারবে। ওদের ইঞ্জিন লাগানো বোট। ওদের কি পেরে উঠব আমরা?’ গায়ে জ্বার কাঁটা দিলে যেমন গা’টা হেলে ওঠে কথাটা বলার সময় মতির গলাটা সেভাবেই হেলে উঠল। এই বুঝি খামচে ধরল বিপদ। নুহু ভাবল, মতিভাই তো ঠিকই বলছে। জোয়ারে তো ওদেরই বেশি ফায়দা। মনে কি যেন একটা অঙ্ক কষল নুহু। হাতের কব্জি শক্ত করে মিনমিন করল, সোজাপানে না গিয়ে আরও পশ্চিমে বেঁকে দক্ষিণসোজা টান মারি, ব্যস, তাহলেই দৃষ্টির বাইরে। সে মতিকে ভাবনাটা বলল, ‘ভাই, পশ্চিমে বেঁকে দক্ষিণে হাল দাও, উখিয়ার ঘা ঘেঁষে যাই, তাহলে উচিপুরং ক্যাম্পে উঠব।’
‘তাইই কর। ওটাই মনে হয় ভালো হবে।’ ঘাড় হেলাল মতি। ধুকপুক করে মতি আল্লাহকে ডাকতে লাগল। হালটাকে ডানে কাত করে টেনে ধরে ভয় মাখা গলাটা ফিসফিস করে বলল, ‘কুপিটা নিভিয়ে দাও, আরিফা।’ স্বামীর মুখ দিয়ে যেই কথাটা বেরিয়েছে, অমনি ফুক করে ফুঁ দিয়ে কুপিটা নিভিয়ে দিল আরিফা। ঝুপ করে এক নদী অন্ধকার গিলে ধরল নৌকোটাকে। অন্ধকারে কারও মুখ আর দেখা যাচ্ছে না। শুধু অন্ধকারের যে একটা নিজস্ব চোরা আলো আছে, তাতে মানুষগুলোর চোখের মণিগুলো বিন্দুর মতো জ্বলছে। নুহু মতির সেই আলোর বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, তুমি এ রাস্তাটা ভালো করে চেনো তো? আমি অবশ্য অনেকদিন আগে একবার উচিপুরং গেছিলাম। এখন ঠিক মনে নেই।’
‘আমি চিনি। তোর চিন্তা নেই।’ অভয় দিল মতি। মতির যে এ তল্লাটের কমবেশি সবই চেনা। নদীর উছাল, নদীর ভেক, নদীর ভোল, হেঁয়ালি-খেয়ালি, গভীরতা, সে গভীরতার ধরন, জলের রঙ, রঙের রকম, সে জল মিষ্টি না নোনতা সব চেনা মতির। এই নদীতে মাছ ধরেই তো তার দিনগুজরান। যখন এই হুলুস্থুল ছিল না, এই খুনখারাপি ছিল না, তখন রাতকে রাত এই নদীর বুকেই পড়ে থাকত মতি। নদীই ছিল তার ভাত-রুটি। দল বেঁধে আবার কখনো কখনো একা ডিঙি নিয়ে মাছ ধরতে চলে আসত মতি। নুহু মাঝেসাজে মাছ ধরলেও মূলত সে চাষ আবাদ করে। মতি মূলত মাছই ধরে। আসলে জাফরের তো সেরকম জমিজমা নেই যে, সব বেটা তাতে আবাদপানি করে খাবে। যা এট্টু আট্টু আছে, নুহুই দেখভাল করে। মতি নদীতে মাছ ধরে দংখালীর হাটে বিক্রি করে। কখনো কখনো মংডুর মেছোয়া বাজারেও মাছ চালান করে। তার কমপুঁজির কারবার টেনেটুনে চলে যায়। মাঝেসাজে মহাজনদের কাছে হাত পাততে হলেও, সেভাবে দেনায় জড়িয়ে যায় না। অন্যদিকে নুহু তাদের দংখালীর গাবতলার মাঠের বিঘেখানেক নাবাল জমিতে বছরে দু বার ধান চাষ করে। আউশ-আমনে তার গা-গতর তখন ফসল হয়ে ওঠে। যে বছর মেঘে ভালো বৃষ্টি হয় সে বছর তো কুঠিগুলো ভরে ওঠে। সচ্ছলতার এই সময়টায় সে বৌয়ের জন্যে হাট থেকে তাঁতের নতুন কড়কড়ে শাড়ি কিনে আনত। যেন পরব পরব ভাব। কোনো কোনো বার মরসুম ভালো থাকলে, হাওয়ার খেয়াল ভালো থাকলে, শস্যপাতিও ভালো হয়। নুহু নিজেদের এই বিঘেখানেক জমি আবাদ করা ছাড়াও বছরভর পরের জমিতে জনমুনিশ খাটে। লতিফা দুখ কাঁদলে, নুহু বলত, গরিবের সংসারে অ্যাই ই ঢের। অত ধনদৌলত কি আল্লাহ আমাদের কপালে লিখেছেন? না, অত ধনদৌলত আমরা সামলে রাখতে পারব? দুবেলা দুটো ডালভাত হয়ে গেলেই তো হল। আবার কী?
এদিকটায় নদীর জল কিছুটা নীলচে। আয়নার মতো একেবারে টলটল করছে। নদীটা আরাকান প্রদেশের আকিয়াবের এই দিকটায় এসে হাঁসুয়ার মতো বেঁকে গেছে। পশ্চিমে বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলা। একটা নদীর দুইপারে দুই দেশ। ভাগ্যিস ওপারে একটা হিতাকাঙ্ক্ষী পরদেশ আছে। তা নাহলে তাদের একজনও হয়ত এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকত না। নুহু, মাথা ঝুঁকিয়ে নদীর তলদেশে কি যেন খুঁজল। এখন অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। দিনের বেলা হলে, নদীর অনেকটাই তলা দেখা যেত। দেখা যেত, হরেক জলজ উদ্ভিদ। ছত্রাক শ্যাওলা। পানিকামড়ির ঝোপ। খিলখিল কিলবিল করে বেড়াচ্ছে নানা প্রজাতির প্রাণী। জীবজন্তু। মাছ। জলের পোকা। নিজের দেশে নিজের দুনিয়ায় নিশ্চিন্তে বেঁচেবর্তে আছে। নুহু আরও একটু মাথা ঝোঁকাল। কপালটা নৌকোর খোলের কিনারায় এসে ঠক করে লাগল। নুহুকে এভাবে বারে বারে ঝুঁকতে দেখে, মতি বিরক্ত হল, ‘ওভাবে কী মাহাল দেখছিস? উল্টে পড়ে যাবি তো?’
মতির কথা কিছুই শুনতে পেল না নুহু। সে যে এখন আর নৌকোতে নেই। দেহ-মন ঢেলে নদীর গর্ভে চলে গেছে। সে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে নদীর চারশ ফুট গভীরতায়। নদীর তলাতেও কি মাটি আছে? সে মাটিতেও তো বাস করে অসংখ্য জীবজন্তু। কই, তাদেরকে তো কেউ ভিটেছাড়া করে না? হাই আল্লাহ, এই দুনিয়াতে পোকামাকড়েরও দেশ আছে, অথচ আমাদের কোনো দেশ নেই! নুহু জলের তলায় কি যেন হন্যে হয়ে খুঁজছে। পাচ্ছে না। এদিক ওদিক হাত চালাচ্ছে। গলা ছেড়ে ডাকছে, ‘রফিক, রফিক, কই গো লতিফা, তোমরা কোথায়? এই দেখো, আমি চলে এসেছি। তোমাদের আর কোন চিন্তা নেই।‘
আচমকা নুহুর হাত থেকে বৈঠাটা ফস করে ফসকে গেল! টাল খেয়ে পড়ল নুহু। মতি খিজলিয়ে উঠল, ‘কী মাহাল অত ভাবছিস? একেবারে নদীর পানিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিস!’
‘কিচ্ছু না।’ আলগোছে বলল নুহু। বৈঠাটা হাত থেকে ফসকে হাতটা হাল্কা হয়ে যাওয়াই, তার ঘোর ভাঙল। সে মতিকে কিছু বুঝে উঠতে দেওয়ার আগেই, কথায় অন্য ফাংড়ি জুড়ল। বলল, ‘আচ্ছা ভাই, আল্লাহ যদি ফুঁ দিয়ে এই নদীটা শুকিয়ে দেন, তাহলে কী হবে!’
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ